মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রায় নারীর গুরুত্বপূর্ণ অবদান ইতিহাস ও বাস্তবতা হলেও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নারীর ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে বহু বিতর্ক প্রতিনিয়ত দেখা যায়। দেশে দেশে, সমাজে সমাজে নারীর ভূমিকার ফারাক একেবারে সুস্পষ্ট। বর্তমানে সারা দুনিয়ায় নারীর ভূমিকার মানদণ্ড হিসাবে ধরা হয় পাশ্চাত্যকে। যেসব দেশে পশ্চিমা মানদণ্ড পূরণ করা হচ্ছে না, সেসব দেশেই গজিয়ে উঠছে নারী অধিকার রক্ষার নামে বহুবিধ আন্দোলন। কিন্তু নারীর অধিকারের ব্যাপারে পাশ্চাত্যের দৃষ্টিভঙ্গিই কি চুড়ান্ত সঠিক?
ইতিহাসে দেখতে পাই, মাত্র কয়েক শতাব্দি আগেও পাশ্চাত্য দেশগুলোতে নারী ছিল অত্যন্ত অবহেলিত। তাদেরকে সকল সামাজিক সমস্যার উৎস বা মূল কারণ মনে করা হতো। প্রাচীন আরবে এমনকি প্রাচীন ভারতেও কন্যাসন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়াকে ভীষণ অশুভ বোলে বিবেচনা করতো। বহু লোকে কন্যা সন্তানকে জীবন্ত পুতে ফেলতো। চীনারা নারীদের কেমন মূল্যায়ন করত তার নমুনা পাওয়া যায় একটি চৈনিক প্রবাদে, সেটা হল- “তোমরা স্ত্রীর কথা শোন তবে বিশ্বাস করো না।” রুশ প্রবাদ, “দশটি নারীর মধ্যেও একটির বেশি আত্মা থাকে না।” স্পেনিশ প্রবাদ, “দুষ্টা নারীকে এড়িয়ে চলো, তবে বিদুষী নারীর প্রতিও ঝুঁকে পড়োনা।” এবং কিছু কিছু হিন্দু ধর্মগ্রন্থেও বলা হয়েছে “বিষ, সাপ, আগুন, মৃত্যু, নরক, ও ঝড়-বন্যা এসব কোন কিছুই নারীর চেয়ে খারাপ নয়।” খ্রীস্টধর্মের প্রথম যুগে যাজকগণ রোমান সমাজের অশ্লীলতা ও ব্যভিচারের ব্যাপক ছড়াছড়ি ও চরম নৈতিক অধঃপতন দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং এ সবকিছুর জন্য নারীকেই এককভাবে দায়ী করেন। তারতোলিয়ান [Quintus Septimius Florens Tertullianus (প. ১৬০ – প. ২২৫ ] নামক জনৈক খ্রিস্টান যাজক বলেন, “নারীরা হচ্ছে মানুষের হৃদয়ে শয়তান প্রবেশের সিংহদ্বার।” প্রাচীন সমাজে নারীর না ছিল কোন উত্তরাধিকার, না ছিল স্বামীর কাছে কোন অধিকার। এমনকি কিছু অভিজাত পরিবারের মেয়েদের ব্যতীত অন্যান্য মেয়েরা তাদের নিজের স্বামী নিজে পছন্দ করার অধিকারও ছিল না। খ্রীস্ট সমাজে মনে করা হতো নারীর সৃষ্টির একমাত্র উদ্দেশ্য হল স্বামীর সেবা করা। তাদের এই ধারা অব্যাহত থাকে মধ্যযুগ পর্যন্ত। মধ্যযুগে তাদের সমাজে মেয়েদের মর্যাদার কিছুটা উন্নতি হয় বটে কিন্তু তা মোটেও যথেষ্ঠ ছিলনা। ১৮০৫ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ আইনে স্ত্রীকে বিক্রি করে দেয়ার অধিকার স্বামীদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ফরাসী বিপ্লবের পর যখন মানুষের দাসত্ব ও হীনতার জীবনযাপন থেকে মুক্তি দানের ঘোষণা সম্প্রচারিত হলো, তখনও নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হলো না। এ আইনে দ্ব্যর্থহীনভাবে উল্লেখ করা হয় যে, নারী, শিশু ও পাগল-এই তিন শ্রেণীর মানুষ অধিকারহীন ও দায়িত্বহীন। এরই মধ্যে সমান্তরালভাবে অর্ধেক পৃথিবীতে বিকশিত হলো ইসলামী সভ্যতা, তার সুবাস আমোদিত করল দশ দিগন্ত। তার থেকে রং রূপ সংগ্রহ করে ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হতে লাগলো পাশ্চাত্য। কিন্তু তাদের সেই সমৃদ্ধি কেবলমাত্র একটি দিকে, জড়ের দিকে, যান্ত্রিক প্রগতির দিকে। একে তারা নাম দিল রেনেসাঁ। মানুষ সম্পূর্ণ আত্মাবিবর্জিত একটি প্রাণীতে পরিণত করার জন্য চেষ্টা সাধনা শুরু করল পশ্চিমা দার্শনিকগণ। কিন্তু তাদের এই নবজাগরণের প্রেরণাধারা যে প্রাচ্য তথা ইসলাম থেকে প্রবাহিত তা অকৃতজ্ঞের মত অস্বীকার করল। উল্টো তারা চাইল ইসলামকেই উপনিবেশবাদের বুটের তলায় পিষ্ট করে ফেলতে, একসময় সফলও হল। আজ ইসলামের অনুসারীরা পাশ্চাত্যের একটু স্বীকৃতির জন্য হা-পিত্যেষ করে চেয়ে থাকে, পশ্চিমের কেউ ইসলামকে আমলে নিলে ধন্য বোধ করে। কী নির্লজ্জতা! কী অধঃপতন!
ইসলাম যখন স্পেনে প্রবেশ করল তখন জ্ঞানে-বিজ্ঞানে নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিতে ও সামরিক শক্তিতে মোসলেমরা পৃথিবীর শীর্ষ স্থানে, আর ইউরোপ মধ্যযুগীয় বর্বরতার অন্ধকারে নিমজ্জিত। ইউরোপিয়রা দেখার সুযোগ পেলো ইসলাম মেয়েদেরকে কি পরিমাণ অধিকার এবং মর্যাদা দেয়। এ থেকে শিক্ষা নিলেও অসভ্য ইউরোপ নারীর ব্যবহার শুরু করল, তবে যথারীতি ভিন্নমাত্রায়। ইউরোপে যখন শিল্পবিপ্লব শুরু হয় তখন কৃষি পণ্যের উপর বাজার দখল শুরু করলো কারখানায় উৎপাদিত শিল্পপণ্য। এক পর্যায়ে এই সব শিল্পপণ্য প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়লো। এই প্রতিযোগিতার বাজারে পণ্যের বিজ্ঞাপন হিসাবে ব্যবহার শুরু হল নারীদেহের। স্বভাবতই নারীদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করল আর তা ইসলামের মত পরিশিলিতভাবে নয়; সেটা হল- লাগামহীনতা, অনৈতিকতা, অবাধ যৌনাচার, অশ্লীলতা এবং পরিবার ব্যবস্থার প্রায় বিলুপ্তিসহ নারীর আত্মিক, চারিত্রিক ও মানসিক অবস্থার ভয়াবহ ক্ষতি সাধন। স্বাধীনতার অপর নাম হল লাগামহীন যৌনতা। শরীরের যে অংশ ঢেকে রাখার জন্য ইসলাম বিধান দিয়েছে, পশ্চিমা দুনিয়া সেই আবৃতকরণকে মৌলবাদিতা আখ্যা দিয়ে তাদের ভাষায় ‘আধুনিক’ পোশাক পরিধানের সংস্কৃতি চালু করল, যে সংস্কৃতির কারণে পশ্চিম ও তাদের প্রভাবপুষ্ট সমাজে আজ ধর্ষণ আর ব্যভিচারও একটি সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। মানুষ নেমে গেছে পশুরও নিচে, ৪ বছরের শিশুও তাদের কাছে লালসার বস্তু।
সৃষ্টিগতভাবে মানুষকে সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করতে হয়, প্রাকৃতিকভাবেই তাদের প্রয়োজন পরিবারের, যা গঠনের শর্ত হচ্ছে বিয়ে। এটা প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকে সকল ধর্মের শিক্ষা, ইসলামেরও শিক্ষা। কিন্তু আজ পাশ্চাত্য সমাজ সেই বিবাহ প্রথাকে নিরুৎসাহিত করছে। পাশ্চাত্য সমাজের ছেলে মেয়েরা নিজেদের সম্পর্কের নাম ‘বন্ধুত্বে’র মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে। তারা এভাবে অবিবাহিত অবস্থাতেই একসাথে একই ছাদের নিচে বসবাস (Live together) করে, বাচ্চাও জন্ম দিয়ে থাকে। আবার ইচ্ছে হলেই আলাদা হয়ে যায়, কেউ কাউকে আটকে রাখার অধিকার নেই। এই প্রথাটি পশ্চিমা সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত থাকার পেছনে নারীর অবদানই প্রধান থাকে কারণ এ ধরণের সম্পর্কে বেশিরভাগ সময়ই মেয়েরা ছেলেদের ব্যয় বহন করে এবং সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে চায়। তবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এ সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত টেকে না, ছেলেদের অনাগ্রহের কারণেই একসময় তা ভেঙ্গে যায়। ইতিমধ্যে ‘ভুলবশত’ যদি দু’একটি সন্তান জন্ম নিয়েও থাকে, তাদের সঙ্গে পারিবারিক কোন সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। বয়স হয়ে গেলে এই সমাজের নারীদের মধ্যে নেমে আসে হতাশা। তারা বিভিন্ন মাদকের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। পাশ্চাত্য সামাজের অধিকাংশ নারী নেশাগ্রস্ত হয় এই হতাশাজনিত কারণে। ফলে সামাজে নারীর নিরাপত্তা লোপ পায়, সমাজে শুরু হয় বিশৃংখলা। সারাজীবন যে ‘অধিকার’ ‘অধিকার’ বলে তারা গলা ফাটিয়েছে, শেষ বয়সে সেই অধিকার থেকে চরমভাবে তারা বঞ্চিত হয়। পরিবার না থাকায় সেবা ও আশ্রয়ের অধিকারটুকুও তাদের থাকে না। জন্মের পরই ‘সন্তান’দের ডে কেয়ার সেন্টারে এ পাঠিয়ে দেয়ার কারণে তাদের সাথে আর প্রগাঢ় সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। তাই বাবা-মা যখন বার্ধ্যকে উপনীত হয় তারাও বৃদ্ধনিবাসে পাঠিয়ে নিজেদের দায়িত্ব পালন করে। এভাবেই সম্পন্ন হয় প্রাকৃতিক প্রতিশোধ।
বৃদ্ধনিবাসের বাসিন্দাদের জীবন যাপন কতটা করুণ তা বোঝানোর জন্য একটি মাত্র উদাহরণ দেওয়াই যথেষ্ট মনে করছি। কয়েকদিন আগে একটি পত্রিকায় পড়লাম, যুক্তরাষ্ট্রে বৃদ্ধাশ্রমের এক কেয়ারটেকারের বিরুদ্ধে বহুসংখ্যক বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাকে হত্যা করার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তি হত্যার দায় স্বীকার করেন, তবে তিনি কেন এই হত্যাকাণ্ডগুলি করলেন তাও আদালতে বিবৃত করেন। তিনি বলেন, এই বৃদ্ধাশ্রমের বৃদ্ধ ও বৃদ্ধারা আত্মীয়হীন পরিবেশে প্রচণ্ড একাকীত্ব ও হতাশায় ভুগতেন। এ থেকে তারা মুক্তির কোন পথ না পেয়ে বন্ধুপ্রতীম ঐ কেয়ারটেকারকে অনুরোধ করত যে কোনভাবেই হোক তাদেরকে এই অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য। কিন্তু এই কাজ করা থেকে ঐ কেয়ারটেকার বহু বছর বিরত থাকেন। এই বৃদ্ধ মানুষগুলির আত্মার ক্রন্দন একসময় তাকেও ব্যথিত করে। তিনি বুঝতে পারেন, বৃদ্ধাশ্রমের মর্মান্তিক জীবন থেকে কাউকে মুক্তি দিলে সেটা তার উপকারই করা হবে। এজন্য একসময় তিনি সেই অনুরোধকারী বৃদ্ধদের খাদ্যে অল্প পরিমাণে বিষ মেশাতে আরম্ভ করলেন।
পরিবার ব্যবস্থা ভেঙ্গে দেওয়ার এই হচ্ছে ফলাফল। অথচ আমাদের দেশেও কিছুদিন আগে শোনা যেত বৃদ্ধ বয়সে মানুষ নাকি আরও বেশীদিন বেঁচে থাকতে চায়, দুনিয়ার প্রতি, সংসারের প্রতি নাকি বয়সকালে মায়া মহব্বত আরও বেড়ে যায়। এটা কেন হয়? কারণ ইসলামের কিছু কিছু সংস্কৃতি অবচেতনভাবে হলেও এই মোসলেম দাবিদার জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্রিয়াশীল ছিল, এখনও কিছু কিছ আছে, ফলে যৌথ পরিবারে একজন বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা তার নাতি ও নাতনিদের নিয়ে বেশ আনন্দেই সময় পার করতেন। তাদের মনে একাকীত্ব আসতো না, হতাশা আসতো না। তারা আগের চেয়ে আরও বেশী সম্মান পেতেন। তাই তারা এই সন্তান, আত্মীয়, পরিজন, নাতি-নাতনিদেরকে নিয়ে সুখেই থাকতেন। কিন্তু পশ্চিমা অপ-সংস্কৃতির আগ্রাসনে এমন দৃশ্য দিন দিন দুর্লভ হয়ে যাচ্ছে। (চোলবে…)
লেখিকা: শিক্ষার্থী, বিবিএ (২য় বর্ষ)
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ বিজনেস এন্ড টেকনোলজি