নুরুদ্দিন আবুল কাসিম মাহমুদ ইবনে ইমাদউদ্দিন জেনগি (ফেব্রুয়ারি ১১১৮ – ১৫ মে ১১৭৪) ছিলেন তুর্কি বংশোদ্ভূত জেনগি রাজবংশীয় শাসক। ১১৪৬ থেকে ১১৭৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি সেলজুক সাম্রাজ্যের সিরিয়া প্রদেশ শাসন করেছেন। তিনি ১১৪৬ থেকে ১১৭৪ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। তাঁকে দ্বিতীয় ক্রুসেডের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসাবে গণ্য করা হয়। তাঁর জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলা যাক।
আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্তি
সুলতান নুরুদ্দিন মাহমুদ জঙ্গি তখন সিরিয়াতে অবস্থিত খ্রিষ্টানদের দুর্ভেদ্য কেল্লা হারিম অবরোধ করে রেখেছেন। ওদিকে মিশরে আক্রমণ চালিয়েছে খ্রিষ্টানদের আরেকটি বাহিনী। সেখানে মুসলিমদের প্রসিদ্ধ দিময়াত নগরীকে রক্ষার জন্য লড়াই করছেন তাঁর একান্ত প্রিয়ভাজন মিশরের ওবায়দি সালতানাতের প্রধান উজির গাজী সালাহ উদ্দিন ইউসুফ আইয়ুবি।
একদিন তিনি অস্থির চিত্তে সন্নিকটস্থ একটি টিলায় উঠে গেলেন। এখানে তিনি সিজদায় মাথা রেখে অস্থির চিত্তে মাটির ওপর মুখমণ্ডল ঘষতে লাগলেন। আর মুখে বললেন, “হে আল্লাহ, এই মো’মেনরা তোমার বান্দা ও তোমার বন্ধু। আর ওরা তোমার বান্দা ও তোমার শত্রু। তুমি তোমার বন্ধুদেরকে তোমার শত্রুর ওপর বিজয় দান করো। এই অবাঞ্ছিত মাহমুদ মাঝখানে কোত্থেকে চলে এসেছে। হে আল্লাহ, তুমি চাইলে মাহমুদকে সহায়তা করো না; কিন্তু তোমার দীনের ওপর অবশ্যই সাহায্য নাজিল করো। মাহমুদের মতো কুকুরের কী এমন মর্যাদা যে, তুমি তাকে সহযোগিতা করবে?”
তাঁর এ বক্তব্যের তাৎপর্য হলো, আমি যদি আমার ব্যক্তিগত দোষ-ত্রুটির কারণে আপনার সাহায্যের যোগ্য বিবেচিত না হই, তাহলে অন্তত আমার কারণে মুসলিমদেরকে বঞ্চিত করবেন না। আল্লাহ তাঁর এই দোয়া কবুল করেন। আহযাবের যুদ্ধে যেমন প্রবল ঘুর্ণিঝড় এসে শত্রুদের শিবির লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল, এক্ষেত্রেও ঠিক সেটাই হলো। প্রচণ্ড ঝড়ের কবলে পড়ে শত্রুদের জাহাজগুলো উপকূলে ডুবে গেল। যারা জীবিত ছিল সালাহ উদ্দিনের প্রতি-আক্রমণের সামনে দাঁড়াতে না পেরে পালিয়ে গেল।
সে রাতেই দামেস্কের জনৈক ইমাম সাহেব স্বপ্নে রাসুলুল্লাহকে (সা.) দেখতে পান। নবিজি তাঁকে বলেন, “নুরুদ্দিনকে জানিয়ে দাও আজ রাতে শত্রুরা দিময়াত থেকে ফিরে যাবে।” ইমাম সাহেব তখন স্বপ্নের ভেতরেই নিবেদন করলেন, “হে আল্লাহর রাসুল, আমাকে এমন কোনো নিদর্শন দিন, যার মাধ্যমে আমার কথা সুলতানের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে।”
উত্তরে নবিজি বললেন, “নিদর্শন হলো, নুরুদ্দিন হারিমের টিলার ওপর সিজদা করে বলছে, হে আল্লাহ, তুমি চাইলে মাহমুদকে সহায়তা করো না; কিন্তু তোমার দীনের অবশ্যই তোমার নুসরাত নাজিল করো। মাহমুদের মতো কুকুরের কী এমন মর্যাদা যে, তুমি তাকে সহযোগিতা করবে?”
তখনও ফজরের ওয়াক্ত আসেনি। ইমাম সাহেব ঘুম থেকে জেগে সোজা মসজিদে চলে এলেন। সুলতান নুরুদ্দিন প্রত্যহ এ সময়ে মসজিদে চলে এসে সুবহে সাদিক পর্যন্ত নফল সালাহ কায়েম করে থাকেন। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি চলে এলেন। ইমাম সাহেব তখন তাঁকে স্বপ্নের কথা শোনালেন; কিন্তু সেখানের ‘কুকুর’ শব্দটি উচ্চারণ করার সাহস পেলেন না। তখন নুরুদ্দিন বললেন, “আমাকে পুরো কথাটা শোনাও।” ইমাম সাহেব ইতস্তত বোধ করছিলেন; কিন্তু নুরুদ্দিনের পীড়াপীড়ির কারণে তিনি পূর্ণ বাক্য উচ্চারণ করতে বাধ্য হলেন। নুরুদ্দিনের চোখ থেকে টপটপ অশ্রু বেরিয়ে এলো।
ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য
সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গি ছিলেন ইসলামের ইতিহাসের সেই মুষ্টিমেয় সেনানায়কদের একজন, যাঁদের জীবনে ইসলামের সোনালি যুগের মুসলমানদের দীপ্তি জ্বলজ্বল করে উঠেছিল। তিনি ছিলেন দিবসে ঘোড়সওয়ার ও রাতে তাহাজ্জুদ আদায়কারী। সহজাত নেতৃত্ব, ঋজু শরীর, প্রশস্ত ললাট, জ্বলজ্বলে গাত্রবর্ণের কারণে যে কোনো মজলিসে তিনি স্বতন্ত্র অবস্থানে থাকতেন। তিনি ছিলেন সবার চেয়ে ভদ্র ও দয়ালু। তাঁর দৃষ্টিতে কখনই বিজয়ীর অহংকার ফুটে উঠত না। তিনি কখনই কারও দিকে তাচ্ছিল্য বা অহংকারের দৃষ্টিতে তাকাতেন না। প্রতিটি দর্শকের চোখে তাঁর স্নেহমাখা মিষ্টি সম্ভাষণই সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ কাড়ত।
তাঁর মুখাবয়ব ছিল অপেক্ষাকৃত লম্বাটে। তিনি অনেকটা পশমহীন ছিলেন। এতদ্সত্ত্বেও তাঁর ব্যক্তিত্বের মাঝে এতটাই দাপট ও গাম্ভীর্য ছিল যে, দরবারের বড় বড় আমির বা অফিসারগণ পর্যন্ত ভয়ে থরথর করে কাঁপত। শত ক্রোশ দূর থেকেও তার নাম শুনে শত্রুর কলজে শুকিয়ে যেত। সেই যুগে জঙ্গি বা যেনগি সালতানাত (Zengid dynasty, Atabeg dynasty) ছিল বিশ্বের বৃহৎ ইসলামি সালতানাতগুলোর একটি। সিরিয়া (শাম) ছাড়াও মক্কা মদীনা মসজিদের খোতবাতেও তাঁর নাম উচ্চারিত হতো। তাঁর জীবনের শেষ বছর যখন ইয়েমেনের ওপর তুরান শাহর দখল প্রতিষ্ঠিত হয় তখন সেখানে আব্বাসি খলিফাদের নামে খোতবার প্রচলন শুরু হয়। তথাপি সেখানে সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গির নামও যুক্ত করা হয়।
বাস্তবতা হলো, তিনি মানুষের অন্তরেরও রাজা ছিলেন। প্রতিটি মসজিদে, প্রতিটি ঘরে প্রতিদিন তাঁর জন্যে দোয়া করা হতো। মুসলিম জাতির সে এক ঘোর সংকটকাল। ক্রুসেডের যুদ্ধে মুসলিমদের বিজয়ের জন্য অপরিহার্য শর্ত ছিল ঐক্যবদ্ধ হওয়া। এই কাজটি করার ক্ষেত্রে নুরুদ্দিন জঙ্গি বিরাট ভূমিকা রেখেছেন। যদি কখনও কোনো মুসলিম শাসক এই ঐক্যের পথে প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছেন তখন প্রয়োজনে তিনি তার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে তাকে পরাজিত করে হলেও মুসলিম উম্মাহর শক্তি-সামর্থ্যকে একীভূত করতে চেষ্টা করেছেন।
তিনি এত বেশি সাহসী ছিলেন যে, প্রতিটি যুদ্ধে একাই মূল ভূমিকা পালন করতেন। সাধারণ সৈন্যদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই তিনি কখনই কুণ্ঠিত হতেন না। ইসলামের এই শ্রেষ্ঠ সন্তান হাতে দু’টি লোহার কামান নিয়ে ও কোমরে দুটি তূণীর বেধে শত্রুপক্ষের ওপর তীরবৃষ্টি বর্ষণ করতেন। সুলতানের অসামান্য প্রশংসনীয় গুণাবলির স্মৃতিচারণ করে ইবনুল আসির লিখেছেন, “আমি বিগত সুলতানদের মাঝে খোলাফায়ে রাশেদিন ও উমার ইবনু আবদুল আজিজ ব্যতিরেকে অন্য কাউকে নুরুদ্দিন মাহমুদ জঙ্গির থেকে উত্তম চরিত্রের অধিকারী ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত পাই নি। তিনি রাতে প্রচুর নফল নামাজ পড়তেন।”
সুলতান নুরুদ্দিন মাহমুদ জঙ্গি এ পরিমাণ দুনিয়াবিমুখ ছিলেন যে, রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে স্রেফ জীবনধারণের জন্য প্রয়োজন পরিমাণ ভাতাই গ্রহণ করতেন। তাঁর স্ত্রী রদি খাতুন একবার আর্থিক সংকটের অভিযোগ তুললে তিনি হিমস শহরে তাঁর নিজের তিনটি দোকান স্ত্রীর নামে লিখে দেন। অবশ্য সেগুলো এতই ছোট দোকান ছিল যে সেগুলো থেকে প্রতিবছর মাত্র বিশ দিনার অর্থ সুলতানের কাছে আসত। ফলে অবস্থার পরিবর্তন হলো না। কিছুদিন পর স্ত্রী পুনরায় আর্থিক দুরবস্থার অভিযোগ পেশ করলে তিনি বলেন, “আমার নিজের এতটুকুই সম্পদ। এর বাইরে আমার কাছে যা দেখতে পাও, সেগুলো মালিক মুসলিম উম্মাহ। আমি স্রেফ সেগুলোর হিসাবরক্ষক। তোমার জন্যে আমি খেয়ানত করে নিজেকে জাহান্নামের আগুনে জ্বালাতে পারি না।”
জেহাদের ময়দানে তিনি নিজের জীবনকে এতটাই তুচ্ছ মনে করতেন যে অবলীলায় শত্রুদের কাতারে ঢুকে পড়তেন। একদিন বিখ্যাত ফিকাহবিদ কুতুব নাশাভি তাকে বলেন, “আল্লাহর দোহাই, এভাবে আপনি নিজেকে বিপদে ফেলবেন না। আপনার কিছু হয়ে গেলে শত্রুদের তরবারি থেকে মুসলিমদের রক্ষা করার মতো কেউ থাকবে না।”
এ কথা শুনে সুলতান নুরুদ্দিন জঙ্গি বিরক্তির সুরে বললেন, “আপনি যেসব কথা বলছেন, তার সামনে মাহমুদের কী মূল্য! আমার মাধ্যমে ওইসব জনপদ ও ইসলামি স্থাপনাগুলোর হেফাজত কে করাচ্ছেন? স্রেফ আল্লাহ, যিনি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো হুকুমদাতা নেই।”
ক্রুসেডারদের আতঙ্ক এই মহান যোদ্ধা মাত্র ৫৮ বছর হায়াত পেয়েছিলেন। ১২ শাওয়াল ৫৬৯ হিজরিতে তিনি ইনতিকাল করেন। তাঁর ইনতিকালের পর মিসরে সালাহ উদ্দিন আইয়ুবি জেহাদের মশাল বহনে এগিয়ে আসেন। তিনি সিরিয়া ও মিসরকে একত্র করে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে একটি বিশাল শক্তি গড়ে তোলার মিশনে পূর্ণ মনোযোগ নিবদ্ধ করেন। এই এলাকার শিয়া-সুন্নীসহ বিভিন্ন মতবাদগত বিভক্তির প্রাচীরকে তিনি ভেঙে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন যা ইসলামের ইতিহাসে অপর কেউ করতে পারে নি।
(সহায়ক গ্রন্থ: মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বিশ্বকোষ – ৯ম খণ্ড, লেখক: মওলানা ইসমাইল রাইহান)