রুফায়দাহ পন্নী:
এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত বলার আগে দু’টি পূর্বসিদ্ধান্ত-
(১) পারিবারিক জীবনের বিধান রাষ্ট্রে চলে না, উভয় অঙ্গনে আলাদা বিধান লাগবে।
মানবজাতিকে আল্লাহ সামাজিক জীব হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের মূল দায়িত্ব হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে এই পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে শাসন করা, শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা। এই মানুষের মধ্যে পৃথক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত দু’টি সৃষ্টি- নারী ও পুরুষ। শান্তিপূর্ণ মানবসমাজ গঠনে এদের উভয়েরই স্রষ্টা কর্তৃক সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। সেই দায়িত্ব সুস্পষ্টরূপে অনুধাবন করেই মানবসমাজ যাত্রা শুরু করে। যে বিধান একটি পরিবারের জন্য প্রযোজ্য তা দিয়ে রাষ্ট্র চলতে পারে না, আবার রাষ্ট্রীয় একটি আইন পরিবারের মধ্যে প্রয়োগ করাও অযৌক্তিক হতে পারে। এই উভয় অঙ্গনের জন্য পৃথক ব্যবস্থা থাকতেই হবে। সেই ব্যবস্থাগুলি আল্লাহ তাঁর প্রেরিতদের মাধ্যমে যুগে যুগে মানবজাতিকে দান করেছেন।
(২) আল্লাহর বিধানের ভারসাম্য এর অপূর্ব বৈশিষ্ট্য। এই ভারসাম্য নষ্ট হলে ধর্ম অধর্মে পরিণত হয়।
আত্মিক চরিত্র ও জাগতিক বিধান উভয়ের বিস্ময়কর সমন্বয়ে গঠিত এই শাশ্বত, সত্য জীবনব্যবস্থা, দীনুল হক্ব। মানবসমাজের এই ক্রমবিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে ইবলিস প্ররোচনা দিয়ে এই দীনের ভারসাম্য বিনষ্ট করেছে। ফলে মানুষ ভুলে গেছে কার কী কর্তব্য ও স্রষ্টা নির্ধারিত দায়িত্ব। দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট না থাকলে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা হতে বাধ্য। তাই অন্যায় অবিচারে ডুবে গেছে মানুষ। আল্লাহ আবার কোন নবী রসুল পাঠিয়ে সেই ভারসাম্যকে ফিরিয়ে এনেছেন। এভাবেই মানবজাতি লক্ষ লক্ষ বছর পার হয়ে, একটার পর একটা যুগ অতিক্রম করে শেষ যুগে এসে উপনীত হয়েছে। বর্তমানের ইহুদি-খ্রিষ্টান বস্তুবাদী সভ্যতা (দাজ্জাল) মানুষের জীবন থেকে সর্বপ্রকার নৈতিকতার শিক্ষাকে বিলুপ্ত করে দিয়েছে এবং স্রষ্টা ও আখেরাতের ধারণাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উচ্ছেদ করে দিয়েছে। সেই সঙ্গে সমাজে নারী ও পুরুষের কার কী অবস্থান, কার কী দায়িত্ব ও কর্তব্য তা মানুষ একেবারেই ভুলে গেছে। ধর্মগুলো বিকৃত হয়ে যাওয়ার কারণে এ বিষয়ে স্রষ্টার দেওয়া মানদণ্ড দুনিয়া থেকে হারিয়ে গেছে।
প্রচলিত বিকৃত ইসলামে নারী পুরুষের সঠিক অবস্থান নিয়ে বিস্তর মতভেদ আছে। তবে সকল আলেমই “সুরা নেসার ৩৪ নং আয়াতকে ভিত্তি হিসাবে উপস্থাপন করেন।
“আর-রিজালু কাওয়্যামুনা আলান্নেসায়ী”- ইসলামবিদ্বেষীরা এ আয়াতটিকে ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের অন্যতম হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে থাকে। এ আয়াতটির অনুবাদ করা হয়, “পুরুষেরা নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল এ জন্য যে, তারা তাদের অর্থ ব্যয় করে। সে মতে নেককার স্ত্রীলোকগণ হয় অনুগতা এবং আল্লাহ যা হেফাযতযোগ্য করে দিয়েছেন লোকচক্ষুর অন্তরালেও তার হেফাযত করে।” [সুরা নিসা: ৩৪]
ইসলামকে পশ্চাদপদ, নারীবিদ্বেষী মতবাদ, ইসলাম পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কায়েম করতে চায় ইত্যাদি পশ্চিমা গৎবাধা বর্ণনা করতে করতে নারীবাদীরা মাইক্রোফোন সিক্ত করে ফেলেন, তারা তাদের বক্তব্যের পক্ষে এই আয়াতের উল্লেখ করেন। অপরদিকে কূপমণ্ডুক, খ্রিষ্টানদের শেখানো বিকৃত ইসলামের ধ্বজাধারী আলেম মোল্লারা নারী-ক্ষমতায়নের বিরোধিতা করতেও আশ্রয় নেয় এই আয়াতটির। আসুন আমরা এই শতবর্ষী বিতর্কের একটি বিরাম চিহ্ন টানি।
আমরা একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে যে কাজের দায়িত্ব দেই, একজন শিশুকে তা দেই না। কারণ তাদের শারীরিক ও মানসিক অক্ষমতা ও সক্ষমতার তারতম্য। তারা উভয়েই একই পরিবারে থাকে কিন্তু উভয়ের কাজের ক্ষেত্র আলাদা। পরিবার হচ্ছে মানবসমাজের ক্ষুদ্রতম সংগঠন। এই আয়াতে ইসলামে নারী ও পুরুষের সমন্বয়ে গঠিত পরিবারে কার কী অবস্থান, অধিকার ও কর্তব্য সে সম্পর্কে একটি মূলনীতি ঘোষিত হয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে নারী কোনো ভোগ্যবস্তু নয়, দাসীও নয়। এই আয়াতে আল্লাহ পুরুষের ক্ষেত্রে বিশেষণ ব্যবহার করেছেন ‘কাওয়্যামুনা’। শাসক, কর্তৃত্বের অধিকারী, আদেশদাতা, ক্ষমতাশালী, নেতৃত্বের অধিকারী ইত্যাদি বোঝাতে আরবিতে আমীর, সাইয়্যেদ, এমাম, সুলতান, হাকীম, মালিক ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা হয়। এখন আসুন দেখি আল্লাহ এসব কোনো শব্দ ব্যবহার না করে ‘পুরুষ নারীর কর্তা’ বোঝানোর জন্য আল্লাহ ‘কাওয়্যামুনা’ শব্দটি কেন ব্যবহার করলেন। আল্লাহ কোন যুক্তিতে এবং কোন ক্ষেত্রে পুরুষকে নারীর উপরে কর্তৃত্বশীল করেছেন তা এর অর্থের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। কাউয়ামুনা শব্দের অর্থ হচ্ছে সুঠাম ও সুডৌল দেহবিশিষ্ট, মানুষের গঠন কাঠামো, ঠেক্না, পরিচালক, ব্যবস্থাপক, তত্ত্বাবধায়ক, অভিভাবক, শাসক, নেতা (আরবি-বাংলা অভিধান ২য় খ-, পৃ ৫৩১- ই.ফা.বা.)। সুতরাং এই আয়াতের মর্মার্থ হচ্ছে, পুরুষ শারীরিক দিক থেকে নারীর চেয়ে শক্তিশালী, তার পেশী, বাহু, হাড়ের গঠন, মেরুদণ্ড এক কথায় তার দেহকাঠামো নারীর তুলনায় অধিক পরিশ্রমের উপযোগী, আল্লাহই তাকে রুক্ষ পরিবেশে কাজ করে উপার্জন করার সামর্থ্য বেশি দান করেছেন, তাই পুরুষের দায়িত্ব হলো সে শক্তি সামর্থ্য প্রয়োগ করে, কঠোর পরিশ্রম করে রোজগার করবে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ভূমি কর্ষণ করে ফসল ফলিয়ে, শিল্পকারখানায় কাজ করে উপার্জন করবে এবং পরিবারের ভরণপোষণ করবে। এই শারীরিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই পুরুষকে আল্লাহ নারীর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দিয়েছেন, নারীর অভিভাবক করেছেন। এটা মানব সমাজে বিশেষ করে পরিবারে পুরুষের বুনিয়াদি দায়িত্ব। অপরদিকে নারীদেরকে আল্লাহ সন্তান ধারণের উপযোগী শরীর দান করেছেন, সন্তানবাৎসল্য ও সেবাপরায়নতা দান করেছেন। তাই প্রকৃতিগতভাবেই তাদের মূল কাজ হচ্ছে সন্তানধারণ করা, তাদের লালন-পালন করা, রান্না-বান্না করা এক কথায় গৃহকর্ম করা। পবিত্র তওরাতেও নারী ও পুরুষের প্রকৃত কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যা পবিত্র কোর’আনের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। সংসদ বাঙ্গালা অভিধানে স্বামী শব্দের অর্থ দেওয়া হয়েছে পতি, ভর্তা, প্রভু, মনিব, অধিপতি, মালিক। আল্লাহর একটি সিফত হচ্ছে রাব্বুল আলামীন বা বিশ্বজগতের প্রতিপালক। আল্লাহ যেমন কোন প্রাণী সৃষ্টি করার আগেই তার রেজেকের বন্দোবস্ত করে রাখেন, কেবল আহার্য নয় জীবনোপকরণ হিসাবে তার যখন যা দরকার তাই তিনি নিরন্তর সরবরাহ করে যান। বিশ্বজগতে প্রতিপালক হিসাবে আল্লাহর যে ভূমিকা, একটি পরিবারে আল্লাহরই প্রতিভূ (খলিফা) হিসাবে পুরুষেরও অনেকটা সেই ভূমিকা, কিন্তু ক্ষুদ্র পরিসরে।
সংসার ও বাস্তব সমরাঙ্গণে পুরুষ প্রথম সারি, নারী দ্বিতীয় সারি:
সালাহ হচ্ছে উম্মতে মোহাম্মদী জাতিটির মডেল। এখানে প্রথম সারিতে পুরুষ এবং দ্বিতীয় সারিতে নারী। বাস্তব জীবনেও এই মডেলের রূপায়ণ ঘটা ইসলামের কাম্য। উপার্জন করা পুরুষের কাজ, তাই বলা যায় জীবিকার অঙ্গনে মেয়েরা দ্বিতীয় সারির সৈনিক। কখনও কখনও যদি অবস্থার প্রয়োজনে নারীকে প্রথম সারিতে গিয়ে জীবিকার লড়াইতে অবতীর্ণ হতে হয় সেটার সুযোগ আল্লাহ রেখেছেন। শোয়াইব (আ.) বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং তাঁর পুত্র সন্তান না থাকায় তাঁর দুই তরুণী কন্যা তাঁদের পশুপালের দেখাশোনা করতেন (সুরা কাসাস ২৩)। এছাড়া ইসলামের বিধান হলো স্বামীর উপার্জনের উপর স্ত্রীর অধিকার রয়েছে কিন্তু স্ত্রীর উপার্জনের উপর স্বামীর কোনো অধিকার নেই। এখানেও নারীর উপার্জন করার অধিকারকে সম্পূর্ণরূপে স্বীকার করে নেওয়া হলো। রসুলাল্লাহর অনেক নারী আসহাব পরিবারে পুরুষ সদস্য না থাকায় বা পুরুষ সদস্যরা জেহাদে অধিক ব্যস্ত থাকায় নিজেরাই কৃষিকাজ করে, কুটির শিল্পের মাধ্যমে উপার্জন করতেন, অনেকে ব্যবসাও করতেন। রসুলাল্লাহর আহ্বানে সর্বপ্রথম যিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন তিনি একজন নারী, আম্মা খাদিজা (রা.)। তিনি তাঁর সকল সম্পদ আল্লাহর রাস্তায়, মানবতার কল্যাণে বিলিয়ে দিয়েছিলেন, শিয়াবে আবু তালেবের বন্দীদশার তিন বছরে তিনি তাঁর ব্যবসার যাবতীয় পুঁজি পর্যন্ত শেষ করে ফেলেছিলেন। এ সময়ে খাদ্যাভাবের দরুন তিনি অত্যন্ত রুগ্ণ হয়ে পড়েন এবং বন্দীদশা থেকে মুক্তিলাভের অব্যবহিত পরেই পরলোকগমন করেন। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, তাঁর ইন্তেকালের কারণ ছিল অপুষ্টিজনিত অসুস্থতা। আবার ইসলামের জন্য সর্বপ্রথম যিনি জীবন দিলেন, শহীদ হলেন তিনি একজন নারী, সুমাইয়া (রা.)।
এবার আসা যাক সত্যিকার যুদ্ধের ক্ষেত্রে। অন্যায়ের বিরুদ্ধের সংগ্রাম করার জন্যই উম্মতে মোহাম্মদীর সৃষ্টি। যে সংগ্রামমুখী নয় সে উম্মতে মোহাম্মদীর প্রাথমিক সদস্য হওয়ারও যোগ্যতা রাখে না। যুদ্ধক্ষেত্রেও প্রথম সারিতে থেকে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেওয়ার দায়িত্ব পুরুষদের। এখানেও কারণ পুরুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্য, শক্তি, সামর্থ্য, কষ্টসহিষ্ণুতা ইত্যাদি। জেহাদে নারীর স্বাভাবিক অবস্থান দ্বিতীয় সারিতে।
দ্বিতীয় সারির কাজের মধ্যে সর্বপ্রথম হচ্ছে রসদ সরবরাহ। যুদ্ধের বেলাতে রসদ সরবরাহকে যুদ্ধের অর্ধেক বলে ধরা হয়। সৈনিকদের খাদ্য, পানি, যুদ্ধাস্ত্র, যুদ্ধের আনুষঙ্গিক উপাদান সরবরাহ, আহতদেরকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া ও চিকিৎসা সেবা দেওয়া, নিহতদেরকে দাফন করা ইত্যাদি সবই দ্বিতীয় সারির কাজ। রসুলাল্লাহর সময় নারীরা প্রায় সকল যুদ্ধেই প্রথমে এই দ্বিতীয় সারির দায়িত্ব পালন করেছেন। তারা আহতদের চিকিৎসা দিয়েছেন, নিহতদের দাফনে সহায়তা করেছেন, যুদ্ধক্ষেত্রে আহত সৈন্যদেরকে পানি পান করিয়েছেন। তাছাড়া মসজিদে নববীর এক পাশে যুদ্ধাহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যার প্রধান ছিলেন একজন নারী রুফায়দাহ (রা.)। যোদ্ধাদেরকে যদি রসদ ও এই সেবাগুলি দিয়ে সাহায্য না করা হয় তবে তারা কখনোই যুদ্ধ করতে পারবে না। তাই যে কোনো সামরিক বাহিনীতে এই দ্বিতীয় লাইনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় সারির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, প্রথম সারিকে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করা। যে কোনো যুদ্ধজয়ের সবচেয়ে বড় উপাদান হলো সৈনিকদের আত্মপ্রত্যয়, মনোবল। মনোবল না থাকলে সৈন্যসংখ্যা ও অস্ত্রশস্ত্র বোঝায় পরিণত হয়। দ্বিতীয় সারির বড় দায়িত্ব সৈন্যদের এই মনোবল বৃদ্ধি করা। আমরা আম্মা খাদিজার (রা.) কথা যদি বলি, দেখব যখন আল্লাহর রসুল নব্যুয়তের দায়িত্ব পেলেন, তিনি সারাদিন মানুষের কাছে সত্যের বাণী প্রচার করে সর্বত্র প্রত্যাখ্যাত হয়ে অবসন্ন হয়ে পড়তেন। সেই ক্লান্ত শ্রান্ত রসুলাল্লাহকে অনুপ্রেরণা দিয়ে উদ্দীপ্ত করে তুলতেন আম্মা খাদিজা (রা.)। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লবী মহানায়ককে যে নারী অনুপ্রেরণা ও সাহস যুগিয়ে বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ করেছেন যে নারী তাঁর অবদানকে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। ইয়ারমুকের যুদ্ধে নারীদের ভূমিকা ছিল বিস্ময়কর। রোমান বাহিনীর প্রচ- ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে মুসলিম বাহিনীর পদাতিক ও অশ্বারোহীরা যখন ধীরে ধীরে পিছু হটে নিজেদের ক্যাম্পের কাছে চলে এসেছিলেন সেখানে তারা পেছন থেকে আক্রমণের শিকার হন। না, রোমান বাহিনী নয়, তাদেরকে পেছন থেকে তাবুর খুটি আর পাথর দিয়ে আক্রমণ করে বসে মুসলিম নারীরা। তারা সমস্বরে চিৎকার করে বলতে থাকেন, “যারা শত্রুর নিকট হতে পলায়ন করে তাদের উপর আল্লাহর অভিশাপ নাজেল হোক।” এবং তারা স্বামীদের প্রতি চিৎকার করে বলেন, “তোমরা যদি আমাদেরকে অবিশ্বাসীদের হাত থেকে রক্ষা করতে না পারো তাহলে তোমরা আমাদের স্বামী নও।” সারিবদ্ধ অন্য নারীরা ড্রাম বাজিয়ে রণসঙ্গীত গাইতে থাকেন। নারীদের দ্বারা এভাবে অপমানিত হয়ে পুরুষ যোদ্ধারা পুনরায় ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নেন।
কিন্তু মেয়েরা কি সবসময় কেবল দ্বিতীয় লাইনেই থাকবেন? না। যুদ্ধে এমন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যখন মেয়েদেরকেও অস্ত্র হাতে নিতে হয়, সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হতে হয়। ওহুদের যুদ্ধে যখন মুসলিম বাহিনী বিরাট বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়, বহু সাহাবী শহীদ হয়ে যান, স্বয়ং রসুলাল্লাহ মারাত্মকভাবে আহত হন, কাফেররা প্রচার করে দেয় যে, রসুলাল্লাহও শহীদ হয়ে গেছেন এমনই বিপজ্জনক মুহূর্তে মেয়েরা আর দ্বিতীয় সারিতে থাকলেন না, তারা অস্ত্র হাতে নিয়ে রসুলাল্লাহকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য কাফের সৈন্যদের বিরুদ্ধে বিপুল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ওহুদ যুদ্ধে নারী সাহাবী উম্মে আম্মারার (রা.) অবিশ্বাস্য বীরত্ব সম্পর্কে রসুলাল্লাহ বলেছিলেন, ‘ওহুদের দিন ডানে-বামে যেদিকেই নজর দিয়েছি, উম্মে আম্মারাকেই লড়াই করতে দেখেছি।’
ইয়ারমুকের যুদ্ধে বীর যোদ্ধা দেরার বিন আজওয়ার যখন শত্রুর হাতে আটকা পড়েন তখন তারই বোন খাওলা ঘোড়ায় চড়ে এমন লড়াই শুরু করে ভাইকে উদ্ধার করেন যে স্বয়ং খালিদ (রা.) বিস্ময় প্রকাশ করেন। সত্যপ্রিয় পাঠকের বোঝার জন্য এ উদাহরণ দু’টিই যথেষ্ট যে, রসুলাল্লাহর সময়ে নারীরা প্রথম সারির ভূমিকাও কিভাবে পালন করেছেন। মাসলা মাসায়েলের জটিল জাল বিস্তার করে কোনো কাজেই তাদের অংশগ্রহণে বাধা সৃষ্টি করা হয় নি, আজ যেমনটা করা হচ্ছে। নারীর নেতৃত্ব প্রদানের যোগ্যতাকে ইসলাম মোটেও অস্বীকার করে না। যদি অবস্থার প্রেক্ষাপটে কোন নারীকে দ্বিতীয় সারি থেকে প্রথম সারিতে আসতে হয় এবং সেখানে তিনি যদি তার জ্ঞান, প্রতিভা, যোগ্যতা, দক্ষতা, সামর্থ্যবলে নেতৃত্বদানের উপযুক্ত বলে সাব্যস্ত হন, সেক্ষেত্রে অবশ্যই তিনি বহু পুরুষের উপরও নেত্রী হিসাবে নিয়োজিত হতে পারবেন। উটের যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন উম্মুল মো’মেনীন আয়েশা (রা.)। বহু সাহাবী তাঁর অধীনে থেকে যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধটির বিভিন্ন দিক নিয়ে ঐতিহাসিকরা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন, সমালোচনা করেছেন কিন্তু “ইসলামে নারী নেতৃত্ব হারাম” বলে তখন তাঁর পক্ষে বিপক্ষে যুদ্ধরত কোনো সাহাবী ফতোয়া দিয়েছেন বলে ইতিহাসে পাওয়া যায় না।
আল্লাহর বিধান মতে কেবল একটি মাত্র পদ নারীকে দেওয়া বৈধ নয়, সেটি হলো- উম্মতে মোহাম্মদী নামক মহাজাতির এমামের পদ। আল্লাহ নারী ও পুরুষের দেহ ও আত্মার স্রষ্টা, সচেতন মন ও অবচেতন মনের স্রষ্টা। এদের উভয়ের দুর্বলতা সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো জানেন মহান আল্লাহ। তিনি জানেন যে নারীর শারীরিক গঠন যেমন পুরুষের তুলনায় কোমল, তার হৃদয়ও পুরুষের তুলনায় কোমল, আবেগপ্রবণ ও সংবেদনশীল। সহজেই তার চিত্তচাঞ্চল্য ঘটে, তার স্থৈর্য্য, দূরদর্শীতা পুরুষের চেয়ে কম, তাকে প্রভাবিত করা সহজতর। ইবলিস নারীকেই প্রথম আল্লাহর হুকুম থেকে বিচলিত করেছিল। এ কারণেই আল্লাহর অগণ্য নবী-রসুলের মধ্যে একজনও নারী নেই। পারস্যের সঙ্গে রোমের যুদ্ধের সময় রসুলাল্লাহ একটি পূর্বাভাসে বলেছিলেন, নারীর হাতে যে জাতি তার শাসনভার অর্পণ করেছে সে কখনো সফল হতে পারে না (তিরমিজি)। সুতরাং পৃথিবীময় উম্মতে মোহাম্মদী নামক যে মহাজাতি হবে সেই মহাজাতির এমাম কেবল নারী হতে পারবেন না, স্বীয় যোগ্যতাবলে অন্যান্য যে কোন পর্যায়ের আমীর বা নেতা সে হতে পারবে। শুধু নারী হওয়ার কারণে কেউ নেতৃত্ব দিতে পারবে না এটা ইসলামের দৃষ্টিতে যোগ্যতা অযোগ্যতার মাপকাঠি নয়।
পারিবারিক বিধানকে জাতীয়করণ করা মূর্খতা:
পুরুষ যেহেতু পরিবারের সবাইকে ভরণ-পোষণ করাচ্ছে, লালন-পালন করছে কাজেই তার কথা পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে শুনতে হবে, এটা একটি পারিবারিক শৃঙ্খলা। কিন্তু পারিবারিক জীবনের শৃঙ্খলা সম্পর্কিত এই আয়াতটিকে অনেকেই সামষ্টিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বত্র প্রয়োগ করার চেষ্টা করে থাকে। তাদের এই অপচেষ্টার ফলে নারী সমাজের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী বিকশিত হচ্ছে না, তারা তাদের যোগ্যতার প্রমাণও দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আজকের বিকৃত ইসলামের কূপম-ূক ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণি সুরা নেসার ৩৪ নং আয়াত উল্লেখ করে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীকে পুরুষের অধীন করে রাখার পক্ষে ফতোয়া দিয়ে থাকেন। তারা এটা বুঝতে সক্ষম নন যে, একটি পরিবার পরিচালনার শৃঙ্খলা দিয়ে রাষ্ট্র চলতে পারে না, বা জীবনের অন্যান্য অঙ্গনগুলি চলতে পারে না। জীবনের অন্যান্য অঙ্গনে যার নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা বেশি সে পুরুষই হোক আর নারীই হোক, তাকেই নেতা মনোনীত করা যাবে। সেখানে পারিবারিক জীবনের শৃঙ্খলাকে টেনে এনে অযোগ্য পুরুষকে নারীর কর্তা করতে হবে এমন সিদ্ধান্ত ইসলাম সমর্থন করে না। যেমন একটি প্রতিষ্ঠানে এক হাজার জন কর্মকর্তা, কর্মচারী আছে। সেখানে যদি জ্ঞান, যোগ্যতা, দক্ষতায় কোন নারী অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকে সেখানে সেই নারীকে প্রধান অর্থাৎ নেতৃত্বদানকারী হিসাবে মেনে নিতে বাধা কোথায়? সেই হিসাবে একজন নারী কোনো এলাকার রাজনৈতিক প্রশাসকও হতে পারেন। আজকের বিকৃত ইসলামের ধ্বজাধারীরা ইসলামে পুরুষ ও নারীর অবস্থানকে এমনভাবে ভারসাম্যহীন করে ফেলেছে যে তারা নারীদের গৃহবন্দী করেছে, অপরদিকে পুরুষকে দিয়েছে স্বৈরশাসকের অধিকার। তথাকথিত প্রগতিশীলরাও মোল্লা শ্রেণির এইসব মূর্খতাকে অসার প্রমাণ করতে গিয়ে আল্লাহ-রসুলকেই দোষারোপ করছে। তারা নিজেরাও পাশ্চাত্য জড়বাদী ‘সভ্যতা’র শিক্ষায় অন্ধ হয়ে আছেন। নইলে তারা বুঝতে পারতেন যে, ইসলাম নারীদেরকে কেমন অধিকার দিয়েছে।
লেখক: হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা এমাম,
এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী’র কনিষ্ঠ কন্যা।