মাননীয় এমামুযযামানের লেখা থেকে:
বিশ্বনবী (দ:) মানবজাতিকে যে জীবন-বিধান দীন উল ইসলাম দিয়ে গেছেন সেটা, আর আজ আমরা যেটাকে ইসলাম মনে কোরছি, নিষ্ঠা ভরে পালন কোরছি, এই দুটো শুধু সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস নয়, দু’টো পরস্পরবিরোধী। মহানবী (দ:) তাঁর আসহাবদের যা শিক্ষা দিয়েছেন, আজ আমাদের ওলামায়ে দীন, পীর মাশায়েখরা তার ঠিক উল্টো শিক্ষা দেন। এই জাতি যেটাকে ইসলাম বোলে মনে করে, সেটা প্রকৃত ইসলাম থেকে এত বিকৃত যে প্রকৃতটা বোঝানো অতি কঠিন হোয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের আজ যারা ইসলাম শেখান তাদের ইসলাম সম্বন্ধে আকিদা বিকৃত। এই দীনের উদ্দেশ্য কী, ঐ উদ্দেশ্য অর্জনের প্রক্রিয়া কী, দীনের মূল্যবোধের গুরুত্ব অর্থাৎ Priority কী এসব তাদের বিকৃত, উল্টাপাল্টা হোয়ে গেছে। এরা ওয়াজ করেন, শিক্ষা দেন-নামাজ পড়ো নামাজ পড়ো, যেন নামাজই উদ্দেশ্য। নামাজ উদ্দেশ্য নয়, নামাজ প্রক্রিয়া, উদ্দেশ্য অর্জনের প্রক্রিয়া। সংগ্রামের মাধ্যমে সমস্ত পৃথিবীতে আল্লাহর আইনের শাসনে আনার মতো দুরূহ ও বিরাট কাজের দায়িত্ব যে জাতির উপর অর্পণ করা আছে তাদের যে চরিত্র প্রয়োজন, যে কোরবানি করার শক্তির প্রয়োজন, যে ঐক্য ও শৃঙ্খলার প্রয়োজন তা সৃষ্টি করে এই নামাজ।
আকিদার বিকৃতি অর্থাৎ সালাহকে জেহাদের প্রশিক্ষণের বদলে উদ্দেশ্য মনে করা ও একে অন্যান্য ধর্মের মতো শুধু আল্লাহর নৈকট্য লাভের প্রক্রিয়া বোলে বিশ্বাস করার ফলে এই দীনে শত রকমের বিকৃতি প্রবেশ কোরেছে। নামাজের লাইন ধনুকের ছিলার মতো সোজা করার উপর রসুলাল্লাহর (দ:) এত তাগিদ সত্ত্বেও আজ অতি মোসলেমদের লাইন সোজা হয়না। শুধু তাই নয় এমামের তাকবিরের সঙ্গে সঙ্গে রুকু, এ’তেদাল, সাজদা ইত্যাদি হয় না, সমস্ত জামাতের বিচলন, নড়া-চড়া একসঙ্গে হয় না। লাইন ধনুকের ছিলার মতো সোজা করার উপর মহানবীর (দ:) গুরুত্ব দেয়া থেকে এ কথা পরিষ্কার বোঝা যায় যে নামাজের সমস্ত বিচলন সৈন্যবাহিনীর কুচকাওয়াজের মতোই সমস্ত জামাতের এক সঙ্গে হোতে হবে; একটি মাত্র দেহের বিচলনের মতো। এমামের প্রতিটি তকবিরের সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যবাহিনীর প্যারেডের মতো দ্রুত এবং এক সঙ্গে হোতে হবে। আজকের নামাজের লাইনও ধুনকের ছিলার মতো সোজা নেই, বিচলনও দ্রুততার বদলে অসুস্থ, মৃত-প্রায় মানুষের মতো অতি ধীরে এবং এক সঙ্গের বদলে বিচ্ছিন্ন, এক এক জন এক এক গতিতে। তাই বিশ্বনবীর (দ:) বাণী মোতাবেক এই জাতির মুখ আল্লাহ ও বিশ্বনবী (দ:) যেদিকে স্থাপন কোরেছিলেন আজ তার বিপরীত দিকে ঘুরে গেছে। শেষ নবী মোহম্মদ (দ:) তাঁর উম্মাহকে সারা জীবনের পরিশ্রমে, সাধনায় একটি অপরাজেয়, দুর্দ্ধর্ষ যোদ্ধা বাহিনীতে পরিণত কোরেছিলেন। তিনি অবশ্যই এ কাজ তাঁর নিজের ইচ্ছায় করেন নি, নিশ্চয়ই আল্লাহর নির্দেশেই কোরেছিলেন, কারণ তিনি ছিলেন আল্লাহর সত্য নবী। আল্লাহ ঐ নির্দেশ তাঁর রসুলকে দিয়েছিলেন এই জন্য যে, এই শেষ জীবনব্যবস্থা ‘দীন’ যেটাকে সমস্ত মানবজাতির জন্য তিনি পাঠালেন তা জেহাদ ছাড়া পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না। কাজেই যে নবীর উম্মাহর উপর এই দায়িত্ব অর্পণ করা হোল সেই উম্মাহকে একটি দুর্দ্ধর্ষ যোদ্ধা বাহিনীতে পরিণত করার নির্দেশ নবী করিম (দ:) আল্লাহর কাছ থেকেই পেয়েছিলেন এবং এই উম্মাহর ইতিহাস সাক্ষী যে, তিনি নিখুঁতভাবে আল্লাহর নির্দেশ কাজে পরিণত কোরেছিলেন। তাঁর উম্মাহকে যুদ্ধবিদ্যায় এমন পারদর্শী কোরে দিয়েছিলেন যে, ইসলামের আগে যে আরব জাতি নিজেরাই স্বীকার কোরত যে – তারা দশ জন একজন মাত্র পারসিক সৈন্যের সমান, তারাই যুদ্ধক্ষেত্রে পারসিকদের চেয়ে সংখ্যায়, সমরসজ্জায়, প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্রে সব দিকে দিয়ে নগণ্য হোয়েও প্রতি যুদ্ধে তাদের শোচনীয়ভাবে পরাস্ত কোরে দিলো। এটা সম্ভব হোয়েছিল এই জন্য যে বিশ্বনবী (দ:) নিজে তাঁর উম্মাহকে সমরবিদ্যা শিক্ষা দিয়েছিলেন। প্রথমে নিজে শিক্ষা দিয়ে এবং নিজে নেতৃত্ব দিয়ে তারপর পরবর্তী যুদ্ধগুলিতে সেনাপতি নিযুক্ত কোরে দিতেন। উদ্দেশ্য ছিল নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করা; যারা তাঁর (দ:) পৃথিবী থেকে চোলে যাবার পর তাঁর উম্মাহকে জেহাদে ও কেতালে সঠিক ও সফল নেতৃত্ব দিতে পারেন। বিশ্বনবীর (দ:) ঐ প্রচেষ্টা যে কতখানি সফল হোয়েছিল, কী দুর্দমনীয়, অজেয়, সুশৃঙ্খল যোদ্ধার বাহিনী ও সেই বাহিনীকে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রচণ্ড ঝড়ের মতো চালনা করার উপযুক্ত সেনাপতির দল তিনি (দ:) তৈরি কোরে গিয়েছিলেন, যিনি এই উম্মাহর ইতিহাস পড়েছেন তাকে বোলে দিতে হবে না। মহানবীর (দ:) নিজের হাতে গড়া ও নামাজের মাধ্যমে শৃঙ্খলা শিক্ষিত ঐ বাহিনী পৃথিবীর অন্যায়কারী, অত্যাচারী শক্তিগুলির আতংক হোয়ে দাঁড়িয়েছিল। জেহাদবিমুখ বর্তমানের এই জাতির পক্ষে আজ তা ধারণা করাও অসম্ভব। সাধারণ মানুষ বাদ দেন, ইসলামের আত্মা অর্থাৎ জেহাদ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এই জাতির ধর্মীয় নেতাদেরও যদি প্রশ্ন করেন যে এই উম্মাহর অবিশ্বাস্য সামরিক সাফল্যের কারণ কী? তারা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেন- ঈমানের জোর। বহুবার এ জবাব শুনেছি এবং শুনে ইচ্ছে হোয়েছে যে এই চিন্তাহীন লোকদের বলি যে, তাই যদি হয় তবে আপনাদের মধ্যে যাদের মোকাম্মল ঈমান সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই, অর্থাৎ যারা রামাদানের
রোজা ছাড়াও নফল রোজা রাখেন এবং নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়েন (মোকাম্মাল ঈমান ছাড়া ঐ দুই কাজ সম্ভব নয়) তাদের যে কেউ অন্য ধর্মের একজন কুস্তিগীর পালোয়ানের সঙ্গে লড়ুন, দেখি ঈমানের জোরে তিনি জিতেন কিনা। অবশ্যই তিনি জিতবেন না, ঐ বিধর্মী পালোয়ান তাকে মাটিতে আছড়ে ফেলবেন। এই ইসলাম ‘দীনে ফিতরাত’ স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মের দীন। ঐ প্রাকৃতিক নিয়ম মোতাবেকই শারীরিক শক্তি না থাকলে কুস্তির প্যাঁচ না জানলে শত ঈমান থাকলেও ঐ হিন্দু বা খ্রিস্টান বা ইহুদি পালোয়ানের সাথে পারবেন না। রসুলাল্লাহ (দ:) ও তাঁর সৃষ্ট জাতি তা জানতেন, তারা আজকের এই জাতির মতো প্রায়ান্ধ ছিলেন না। ঈমান তাদের অবশ্যই ছিলো, সে সম্বন্ধে তো কোন প্রশ্নই ওঠে না, কিন্তু ঐ ঈমানের সঙ্গে এ জ্ঞানও ছিলো যে, অতি দক্ষ না হোলে শুধু ঈমানের জোরে যুদ্ধে জেতা যায় না। কাজেই তারা প্রশিক্ষণ নিতেন, অবিশ্রান্ত প্রশিক্ষণ নিতেন, প্রকৃত সালাহ কায়েম কোরতেন; যার ফলে শুধু সম্মিলিতভাবে নয়, রোমান ও পারসিকদের অপরাজেয় বোলে বিখ্যাত যোদ্ধাদের দ্বন্দ্ব-যুদ্ধে (Single Combat) পরাজিত কোরে শত্র“র হৃদয়ে ত্রাসের সৃষ্টি কোরেছিলেন। এই প্রশিক্ষণ এই দীনে এত গুরুত্বপূর্ণ যে এর খেলাধুলার (Sports) ব্যাপারেও এর নীতি হোচ্ছে শুধু সেই সব খেলাধুলাকে জায়েজ করা, স্বীকৃতি দেয়া যেগুলো যুদ্ধে কাজে আসবে। মোহাদ্দিসরা জানেন যে মহানবী (দ:) ঘোড়ায় চড়া, ঘোড়দৌড়, তীর চালনার প্রতিযোগিতা, তলোয়ার ও ছুরি চালানোর প্রতিযোগিতা ইত্যাদি খেলাধুলাকে শুধু অনুমতিই দেন নাই, এই খেলাধুলাকে উৎসাহিতও কোরেছেন। এমন কি এগুলোতে নিজে অংশ গ্রহণ কোরেছেন। কারণ এগুলো যুদ্ধের কাজে আসবে। এক কথায় এই দীনে সব কিছুতো বটেই, এমন কি খেলাধুলা পর্যন্ত— যুদ্ধমুখী-সংঘাতমুখী (Battle oriented) এবং ঘরে বোসে বোসে যে সব খেলা আছে, তাস-দাবা ইত্যাদি এগুলো নিষিদ্ধ কোরে দিয়েছেন।
বর্তমানের ধর্মের ধারক-বাহকরা তাদের লেখায়, কথায়, ওয়াজে নানা ছোট খাটো অপ্রয়োজনীয় খুঁটি-নাটি নিয়ে চায়ের পেয়ালায় তুফান সৃষ্টি করেন, কিন্তু ইসলামের যে মর্মবাণী জেহাদ (দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম) সে সম্বন্ধে তারা চুপ। কারণ, ওগুলোতে বড় কষ্ট, বড় কোরবানি, এমন কি জানের ভয়। তারা জানেন না তাদের ঐ সংগ্রামহীন ইসলাম আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দ:) ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান কোরবেন।