বর্তমানের মুসলিম জাতির মধ্যে একটি ধারণা প্রতিষ্ঠিত আছে যে নফসের বিরুদ্ধে জেহাদ করাই সবচেয়ে বড় জেহাদ। কিন্তু এই কথাটির সত্যতা কতটুকু? আল্লাহ তাঁর রসুলকে মক্কার আইহ্যামে জাহেলিয়াত যুগে প্রেরণ করলেন এবং আল্লাহর রসুল সেই আইহ্যামে জাহেলিয়াতের যুগ অর্থাৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগে এসে সেই যুগকে তেইশ বছরে পরিবর্তন করে, সেই যুগের অশিক্ষিত, বর্বর, অসভ্য মানুষদের এমনভাবে গড়ে তুললেন যে তারা পরবর্তীতে সমগ্র বিশ্বের সামনে শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে মর্যাদা পেল। আল্লাহ তাঁর রসুলকে যে দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছিলেন সে দায়িত্ব , রসুল চলে যাওয়ার আগে, তিনি তাঁর গড়া এই উম্মাহর উপর অর্পন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় আল্লাহর রসুলের ওফাতের পরপরই এই উম্মাহ সে দায়িত্ব নিয়ে বের হয়ে পড়ে এবং অর্ধ পৃথিবীতে আল্লাহর শান্তিপূর্ণ শেষ দীন ইসলাম প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু রসুল (স.) এর ওফাতের ৬০-৭০ বছর পর এ জাতি তাঁদের এই দায়িত্ব ভুলে যায়, ইসলামের প্রকৃত আকিদা ভুলে যায়। আকিদা ভুলে যাওয়ার ফলে দায়িত্ব সম্পন্নের একমাত্র মাধ্যম জেহাদ বা সর্বাত্মক সংগ্রামের চেহারাও পাল্টে যায়। আল্লাহর রাস্তায় সকল অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে করা সর্বাত্মক সংগ্রাম কে পাল্টে নফসের (আত্মা) সাথে সংগ্রাম করাকেই বড় জেহাদ বলে প্রতিষ্ঠা করা হয়।
আল্লাহর রসুল এসেছিলেন সমগ্র মানবজাতির জন্য রহমতস্বরূপ তাই রসুলকে (স.) ডাকা হয় রহমাতাল্লিল আলাামিন। কারণ আল্লাহ তাঁর মাধ্যমে যে দীন প্রেরণ করেছেন তা প্রতিষ্ঠিত হলে, ক্ষুদ্র পরিবার জীবন থেকে শুরু করে বৃহৎ রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত সকল জায়গায় শান্তি অবধারিত। কিন্তু সেই দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম যখন এ জাতি ভুলে যায় তখন সর্বাত্মক সংগ্রাম হিসেবে আত্মার কু-প্রবৃত্তির সাথে সংগ্রামকে বেছে নেয়া হয়। মূলত এই কাজের উদ্দেশ্য ছিল প্রচণ্ড গতিশীল, বহির্মুখী মুসলিম জাতিকে স্থবির ও অন্তর্মুখী করে ফেলা। এ কারণেই যে সর্বাত্মক সংগ্রামকে আল্লাহর রসুল তাঁর সুন্নাহ বলে আখ্যা দিয়ে গেছেন তাকে পরিবর্তন করে রসুলের ব্যক্তিগত অভ্যাস, পছন্দ-অপছন্দগুলোকে জীবনের মূল সুন্নাহ বলে চালিয়ে দেয়া হল। প্রকৃত সংগ্রাম বিকৃত হয়ে যাওয়ার ফলে উম্মাহ অস্ত্র ফেলে দিয়ে তসবিহ উঠিয়ে খানকায় প্রবেশ করল এবং তারই ফলস্বরূপ জাতির আজ এই অবস্থা।
প্রথমে দেখা যাক নফসের বিরুদ্ধে জেহাদ যে বড় জেহাদ নয় এ ব্যাপারে মুহাদ্দিসরা কী বলছেন। হাদীস শরীফে নফসের বিরুদ্ধে জেহাদ বড় জেহাদ এ সম্পর্কে তিনটি হাদিসের উল্লেখ পাওয়া যায়। একটি বর্ণনা করেছেন ইবনে নাজ্জার, একটি দায়লামি ও তৃতীয়টি খতিব। কিন্তু সমস্ত মুহাদ্দিসগণ এক বাক্যে এই তিনটি হাদিসকে দয়ীফ অর্থাৎ দুর্বল বলে রায় দিয়েছেন। হাফেজ ইবনে হাজারের মতো বিখ্যাত মুহাদ্দিসগণ হাদিসগুলোকে হাদিস বলেই স্বীকার করেননি। তাঁদের মতে নফসের সাথে যুদ্ধ জেহাদে আকবর এটা হাদিস নয়, একটি আরবী প্রবাদ বাক্য মাত্র।
দ্বিতীয়ত একটি হাদিস সত্য কী মিথ্যা তা যাচাই করার অন্যতম প্রধান সূত্র হচ্ছে কোর’আন। আল্লাহর রসুল নিজে এই মাপকাঠি নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “আল্লাহর বাণী আমার বানীকে বাতিল বা রদ করবে, কিন্তু আমার বাণী আল্লাহর বাণীকে বাতিল করবে না।” তাহলে দেখা যাক কোর’আনে আল্লাহ কী বললেন। সুরা ফোরকানের ৫২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, “কাফেরদের কথা শুননা, মেননা, এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর, চূড়ান্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাও।” এই আয়াতে আল্লাহ যে শব্দটি ব্যবহার করেছেন সেটি হচ্ছে ‘জেহাদান কবিরা’। কবির ও আকবর দুটো শব্দই একই মূল থেকে এসেছে এবং একই অর্থ বহন করে। অর্থাৎ আল্লাহ কোর’আনে বললেন যে জেহাদে আকবর বা বড় জেহাদ হচ্ছে সত্য অস্বীকারকারী, অন্যায়কারী কাফেরদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রাম করা, তাদের প্রতিহত করা আর বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে যে জেহাদে আকবর বা বড় জেহাদ হচ্ছে নফসের সাথে, নিজের আত্মার সাথে সংগ্রাম করা। আল্লাহর রসুলও এ ব্যাপারে একই অভিমত দিয়েছেন। “রসুল (স.) কে একবার প্রশ্ন করা হল- কোন জেহাদ সর্বোত্তম, সর্বশ্রেষ্ঠ? রসুল জবাব দিলেন, জীবন ও সম্পদ দির্য়ে আল্লাহর রাস্তায় মোশরেকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা (হাদিস আব্দুল্লাহ বিন হাবশী (রা.) থেকে আবু দাউদ, নেসায়ি, মেশকাত)।” দেখা যাচ্ছে রসুল আল্লাহর কথারই প্রতিধ্বনী করেছেন। অতএব বিষয়টি পুরোপুরি স্পষ্ট হয় যে নফসের বিরুদ্ধে জেহাদ, জেহাদে আকবর বা বড় জেহাদ হতে পারে না।
অতএব বর্তমান মুসলিম জাতিকে নফসের বিরুদ্ধে জেহাদ করা জেহাদের আকবর, এই প্রবঞ্চনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জাতিকে আল্লাহর রসুলের প্রকৃত সুন্নাহ বুঝতে হবে এবং ইসলামের সঠিক আকিদা বুঝার মাধ্যমে প্রকৃত জেহাদে আকবর অর্থাৎ সকল অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নামতে হবে। তাহলেই এই মুসলিম জাতির বর্তমান দুর্দশা ঘোচানো সম্ভব।