রাকীব আল হাসান
বর্তমানে ধর্মের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। ছোটখাট বিষয় নিয়ে বিতর্ক করে করে জাতি বহু ভাগে বিভক্ত। অনেক বিষয়ে একমত হওয়া সত্তে¡ও একটা-দুইটা বিষয়ের মতদ্বৈততা আমাদেরকে বিভক্ত করে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে সমাধানটা কী হবে? এই লেখাটি ইনশাল্লাহ বিতর্ক অবসানের পথ নির্দেশ করবে।
মহান আল্লাহ বলেছেন, “অতঃপর রোজা পূর্ণ কর রাত পর্যন্ত” [ সুরা বাকারা- ১৮৭ ]। এখানে রাত বোঝাতে ‘লাইল’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। সম্প্রতি এই আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে আমাকে একজন প্রশ্ন করলেন, “আল্লাহ তো রাত পর্যন্ত সওম পূর্ণ করতে বলেছেন কিন্তু বর্তমানে তো মাগরেবের আযানের সাথে সাথে অর্থাৎ সন্ধ্যা বেলায় ইফতার করা হয়? এটা কি আল্লাহর হুকুমের লঙ্ঘন হচ্ছে না? তিনি তো ‘সন্ধ্যা’ শব্দটি ব্যবহার করতে পারতেন, কিন্তু তিনি ব্যবহার করেছেন ‘রাত’ অর্থাৎ ‘লাইল’ শব্দটি। কাজেই এখানে সুস্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে, ইফতার রাতেই করতে হবে, সন্ধ্যাতে নয়।”
কোর’আনের কোনো আয়াতের বা কোনো শব্দের অর্থ নিয়ে যদি মতোদ্বৈততা সৃষ্টি হয়, যদি অস্পষ্টতা থাকে তবে সর্ব প্রথম দেখতে হবে কোর’আনের অন্য কোনো আয়াতে এর ব্যাখ্যা আছে কি না এবং তারপর দেখতে হবে সে বিষয়ে রসুলাল্লাহ (সা.) কিছু বলেছেন কি না। যাঁর উপর এই কোর’আন নাজেল হয়েছে তিনি (সা.) এ আয়াতের আমল কীভাবে করেছেন সেটাই হলো এর সমাধানের উপযুক্ত পন্থা। আমরা বিশুদ্ধ (সহিহ) হাদিসগ্রন্থগুলোর বর্ণনা থেকে পাই, রসুলাল্লাহ (সা.) সূর্য ডুবে গেলেই ইফতার করতেন। (এ সংক্রান্ত হাদিসগুলো সহিহ বুখারী শরিফের তৃতীয় খণ্ডের সওম অধ্যায় পড়লেই পেয়ে যাবেন ইনশাল্লাহ)। এখানে উদাহরণ স্বরূপ একটি হাদিস উল্লেখ করলাম। ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক অনুবাদকৃত বুখারী শরীফের তৃতীয় খণ্ডের ১৮৩০ নাম্বার হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, “উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলাল্লাহ (সা.) বলেছেন: যখন রাত্র সেদিক থেকে ঘনিয়ে আসে ও দিন এ দিক থেকে চলে যায় এবং সূর্য ডুবে যায় তখন সায়িম (রোজাদার) ইফতার করবে।”
হাদিসগুলোতে সুস্পষ্ট বিবরণ থাকলেও ইফতার কখন করতে হবে এ নিয়েও মতোবিরোধ রয়েছে। একটা শ্রেণি আছে যারা মাগরেবের আজানের বেশ কিছুটা সময় পরে (আধা ঘণ্টা বা তার কিছুটা বেশি) ইফতার করেন। তাদের যুক্তি হলো- হাদিস বা ইতিহাস বিকৃত হতে পারে, কোর’আনই কেবল অবিকৃত। তাই কোর’আনে যা বলা হবে তা অক্ষরে অক্ষরে মানতে হবে। কাজেই তাদের প্রশ্নের উত্তরে হাদিস বা ইতিহাস থেকে উল্লেখ করলে তারা গ্রহণ করে না। তাই কোর’আনের ঐ আয়াতের অর্থ কী হবে সে বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন করে বললাম-
আভিধানিক অর্থে দিন হলো সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময় আর রাত হলো সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত সময়। ২৪ ঘণ্টা সময়কে প্রথমতো এই দুটো ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এবার দিনকে সকাল, দুপুর, বিকেল ইত্যাদি ভাগে ভাগ করা হয়েছে আর রাতকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যারাত, মধ্যরাত, শেষরাত ইত্যাদিতে ভাগ করা হয়েছে। রাত শুরু হয় সন্ধ্যা দিয়ে। আভিধানিক অর্থে সন্ধ্যা মানেই হলো দিন ও রাতের সন্ধিক্ষণ, রাতের শুরু। সূর্যের একটা নাম হলো দিবাকর। কারণ সূর্যের উদয়ের মাধ্যমেই দিবসের সৃষ্টি হয় আর তা অস্তমিত হবার মাধ্যমেই দিবসের সমাপ্তি ও রাতের সূচনা হয়। অর্থাৎ সওম পূর্ণ করো রাত পর্যন্ত- এর অর্থই হলো সূর্যাস্ত পর্যন্ত।- এ হলো এই আয়াতের ভাষাগত ব্যাখ্যা।
রাত বলতে যদি অন্ধকার রাত বোঝানো হয় তাহলে উত্তর মেরুর দেশ নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, সুইডেন প্রভৃতি দেশে তো বছরের প্রায় ৪ মাস অন্ধকার রাত আসেই না। তখন যদি রমজান মাস পড়ে তাহলে তারা কী করবে? তারা সূর্যাস্তকে রাত গণ্য করলেই কেবল সওম পালন সম্ভব। কয়েক ঘণ্টার জন্য সূর্য অস্ত যায় কিন্তু অন্ধকার রাত আসে না, সন্ধ্যা থেকে আবার ভোর হয়ে যায়।
আমি জানি, আমার এত যুক্তির পরেও বিতর্কের অবসান ঘটবে না, অনেকেই তাদের পূর্ব বিশ্বাস ছেড়ে দিতে পারে না। আবার তারা ভাববে যে, কোর’আনের সুস্পষ্ট আয়াত দেখানো সত্তে¡ও আমি যুক্তি-তর্ক, হাদিস, সেরাত ইত্যাদি নিয়ে কথা বলছি, তাদেরটা মেনে নিচ্ছি না, কাজেই আমি সত্য গ্রহণে মুক্তমনা নই।
এখানে তো একটি বিতর্কের উদাহরণ দিয়েছি মাত্র, এমন শত শত বিষয় আছে যা নিয়ে উভয় পক্ষে অনেক যুক্তি দাঁড় করানো যায় এবং বহু যুক্তি-তর্ক হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- এমন বিতর্কিত বিষয়ের সমাধান হবে কীভাবে? সমাধানের সঠিক পন্থাটা কী হবে?
এর সমাধানের জন্য প্রয়োজন একটা চ‚ড়ান্ত কর্তৃপক্ষ, একটা সার্বভৌম, যার মতো সবাই বিনাবাক্যে মেনে নেবে, আর কেউ বিতর্ক করবে না। চ‚ড়ান্ত কর্তপক্ষ না থাকলে এমন শত শত বিষয় নিয়ে বিতর্ক চলতে থাকবে কিয়ামত পর্যন্ত, নতুন নতুন ফেরকা, মাজহাব জন্ম নিতে থাকবে, দ্ব›দ্ব-সংঘাত হতে থাকবে ভাইয়ে ভাইয়ে, যেটা গত ১৩০০ বছর ধরে চলে আসছে।
যতদিন রসুলাল্লাহ (সা.) ছিলেন ততদিন তিনিই ছিলেন চ‚ড়ান্ত কর্তৃপক্ষ। তিনি যে ফায়সালা দিতেন সেটি একবাক্যে সকলেই মেনে নিত। তাঁর ওফাতের পরে কর্তৃপক্ষ হলেন আবু বকর (রা.), তারপর উমর (রা.)- এভাবে কিছুদিন চললো। এক সময় মুসলমানরা শিয়া-সুন্নিতে বিভক্ত হয়ে পড়ল, তখন চ‚ড়ান্ত কর্তৃপক্ষ বলতে আর কিছু রইল না। শিয়াদের একটা কর্তৃপক্ষ হলো, সুন্নিদের একটা কর্তৃপক্ষ হলো। শিয়ারা আবার বহু ইমামের অনুসরণ করে করে আরও বিভক্ত হলো, সুন্নীরাও মাজহাব-ফেরকায় বিভক্ত হলো। একই বিষয় নিয়ে বহু মতের সৃষ্টি হলো। সব মতের পক্ষে বহু রকমের যুক্তি, রেফারেন্স যোগ হতে থাকল। কিন্তু এর ফলে- মুসলিমরা অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ল। বিভক্তি মানেই দুর্বলতা। সময় গড়াতে লাগল, আমরা সমস্ত দিক দিয়ে পেছাতে লাগলাম। ইহুদি-খ্রিষ্টানরা এগিয়ে যেতে লাগল। এক সময় ইউরোপীয় জাতিগুলো আমাদের সব ভূখণ্ড দখল করে শাসন ও শোষণ করতে লাগল। আল্লাহর হুকুমের পরিবর্তে আমরা ঐ ইউরোপীয় খ্রিষ্টানদের হুকুম দ্বারা পরিচালিত হতে লাগলাম। আমরা কলেমা থেকেই বিচ্যুত হয়ে গেলাম। কার্যত আর মুসলিমই রইলাম না, মো’মেন রইলাম না। আমাদের কর্তৃপক্ষ বলতে আর কিছুই রইল না। আজও আমাদের সমাজ পরিচালিত হয় পাশ্চাত্য ইহুদি-খ্রিষ্টান বস্তুবাদী ধর্মহীন ‘সভ্যতা’র তৈরি আইন-বিধান, অর্থনীতি, দণ্ডবিধি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি দিয়ে। যাদের সমাজ চলে সুদভিত্তিক অর্থনীতি দিয়ে, যাদের আদালতে আল্লাহর হুকুমের পরিবর্তে ব্রিটিশ আইন চলে, যাদের রাষ্ট্র পাশ্চাত্য ধর্মহীন দেশগুলোর দানের উপর নির্ভরশীল তাদের ধর্মীয় খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে তর্ক-বাহাস করা চরম মূর্খতা। যে কোর’আনের হুকুম চলে না, যে কোর’আনের কোনো একটি আইন রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত নেই, যে জাতির কোনো কর্তৃপক্ষই নেই সেই জাতি শত শত বছর থেকে দাড়ি, টুপি, সেওয়াক, ঢেলা-কুলুখ, টাখনুর উপর পাজামা পরা, ইফতার কখন করতে হবে, কী করলে রোজা হালকা হয়ে যাবে, বিবি তালাকের মাসলা কী হবে, হায়েজ-নেফাসের সূ²াতিসূ² মাসলা ইত্যাদি নিয়ে তর্কাতর্কী আর কত?
এখন বিতর্কের সময় নয়, এখন ঐকবদ্ধ হবার সময়, চ‚ড়ান্ত কতৃপক্ষ ঠিক করে নেবার সময়। সকলে মিলে আগে কলেমার উপর (আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা নেই, মোহাম্মদ সা. আল্লাহর রসুল) ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আগে এ বিষয়ে সকলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে যে, আল্লাহর হুকুম সমাজে, রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা কররেত হবে, এটা না করতে পারলে আমরা মো’মেন, মুসলিমই হতে পারব না। এরপর আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা, সংগ্রাম, জেহাদ করতে হবে, প্রকৃত মো’মেন হবার চেষ্টা করতে হবে। যে বিষয়গুলোতে ঐকমত্য আছে সে বিষয়গুলো একসাথে করতে হবে, যে বিষয়গুলো নিয়ে এখনো ঐকমত্য তৈরি হয়নি সেটার ব্যাপারে পরে ভাবা যাবে। আগে আমাদের গোলামী থেকে বের হতে হবে, সমাজে ন্যায়, সুবিচার, শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করার তওফিক দান করুন।