রিয়াদুল হাসান:
সময় পরিবর্তনশীল। জীবন পরিবর্তনশীল। তাই মানুষের জীবনপ্রণালী যদি সময়ের সাথে সাথে প্রয়োজনমাফিক পরিবর্তন না করা হয় তাহলে একসময় সেই জীবনপ্রণালী আর মানুষকে শান্তি দিতে পারে না, মানুষের বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলোর উপযুক্ত সমাধান দিতে পারে না, ফলে তা মানুষের কাছে আর গৃহীত হয় না। তখন জোর করে সেটা প্রয়োগের চেষ্টা করা হয়, ফলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়, ভালোবাসা বিদ্বেষে পরিণত হয়। যেমন একটি শিশু বেড়ে ওঠার সাথে সাথে তার পোশাকগুলো ছোট হয়ে যায়, নতুন পোশাক পরাতে হয়। আল্লাহ তাঁর আখেরি নবীর মাধ্যমে যে শেষ জীবনব্যবস্থাটি দিয়েছেন সেটি এমনভাবে প্রণয়ন করেছেন যা অত্যন্ত প্রাকৃতিক (Natural)। প্রকৃতি যেমন নিয়ত পরিবর্তনশীল তেমনি মানুষের জীবনেও সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন আসে, ইসলাম সেই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও সমানভাবে যৌক্তিক ও প্রয়োগযোগ্য থাকে। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় Pragmatic. অক্সিজেন যেভাবে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে প্রাণবায়ু হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং হবে, প্রকৃত ধর্ম তথা প্রকৃত ইসলামও তেমনি হাজার বছর আগে যেমন সমাজ থেকে শোষণ, বঞ্চনা দূর করতে পেরেছে তেমনি সবযুগেই পারবে। এটি হচ্ছে মৌলিক একটি সত্য। শর্ত হচ্ছে একে কোনোভাবে নির্দিষ্ট সময় ও স্থানের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখা যাবে না। কিন্তু বর্তমানে আমরা ইসলামের যে বিধানগুলো ইসলামিক পণ্ডিতদের কাছ থেকে জানতে পারছি, দেখতে পারছি সেগুলো আধুনিক সমাজের চিন্তা ও সংস্কৃতির সাথে বহুলাংশে দ্ব›দ্ব সৃষ্টি করছে। তাই ইসলামকে বহু আগেই ব্যক্তিজীবনের কিছু আনুষ্ঠানিকতার (Ritual) মধ্যে সংকীর্ণ করা হয়েছে। অর্থাৎ বর্তমান যুগে মানুষ ইসলামকে আর সামগ্রিক জীবনের প্রণালী হিসাবে গ্রহণ করছে না। ধীরে ধীরে ব্যক্তি পর্যায় থেকেও ইসলামের শিক্ষা হারিয়ে যাচ্ছে। শুধু যে বিষয়গুলোর সঙ্গে উৎসব, আনন্দ, ভোগের সম্পর্ক রচনা করা গেছে সেগুলো মহাসমারোহে বাণিজ্যিক রূপ নিয়ে পালিত হচ্ছে, যেমন রোজা, ঈদ, কোরবানি, শবে বরাত, বিয়ে-শাদী ইত্যাদি। ধর্মটা ওখানে টিকে আছে। কিন্তু ইসলামের মূল্যবোধগুলো সবই পশ্চিমা মূল্যবোধের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে গেছে। ব্যক্তিজীবনের আচরণ হিসাবেও ধর্ম আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছে বহু আগে। কিন্তু এটা তো হওয়ার কথা ছিল না। কেন হলো?
এর কারণ হলো, আমরা কোর’আনের মৌলিক শিক্ষাগুলোকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারি নি। কোর’আন তো সারা পৃথিবীর সব ভৌগোলিক পরিবেশে বসবাসকারী মানুষের জন্য এসেছে, শুধু আরবের মরু পরিবেশের জন্য নয়। তাই কোর’আনে এমন একটি বিধানও নেই যা কোনো স্থান-কাল-পাত্রের গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়ে অন্যত্র অকার্যকর হয়ে যায়। শুরুতেই বললাম যে ইসলামে কাঠিন্য (Rigidity) নেই, শুধু সময়ের প্রয়োজনে কিছু মূল্যবোধ রক্ষা করতে হবে সেটা সমাজে শান্তি বজায় রাখার স্বার্থে, যুক্তিহীন ও অন্ধভাবে সওয়াবের জন্য নয়। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। আল্লাহ পোশাক পরিধান করাকে ফরদ করেছেন। সেটা কতটুকু? সেটা হচ্ছে সতর ঢাকা, অর্থাৎ লজ্জা নিবারণ করার জন্য। এরপর পোশাকের সৌন্দর্য প্রকাশের কথাও বলা হয়েছে। এখন নবী এসেছেন আরবে, তাই তিনি আরবীয় পোশাক পরেছেন। আল্লাহ কিন্তু আরবীয় পোশাককে ইসলামে বাধ্যতামূলক করেন নি। করলে মেরু অঞ্চলের মানুষের সেই হুকুম মান্য করা সম্ভব হতো না। এমনকি আমাদের দেশের মতো কৃষিপ্রধান নদীমাতৃক দেশের ধানচাষী ও পাটচাষীদের সারাক্ষণ কাঁদা, হাঁটুপানি-কোমর পানিতে নেমে কাজ করতে হয়। আরবীয় জোব্বা পরে সেটা কি সম্ভব? না। কিন্তু ঘটনা হয়েছে কি, পূর্ববর্তী যুগের ফকীহ, ইমাম, মুফাসসিরগণ রসুলাল্লাহর সমস্ত আচরণকেই ইসলামের মাসলা মাসায়েলের মধ্যে, বিধি-বিধানের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন। তাঁদের যুক্তি হলো আল্লাহ রসুলকে অনুসরণ করার হুকুম দিয়েছেন। আলেম ওলামারা এই অনুসরণের মানে করেছেন যে রসুলের দাড়ি ছিল, তিনি খেজুর খেতেন, তিনি পাগড়ি, জোব্বা পরিধান করতেন – তাই এগুলোও সুন্নত। এগুলোকেও তারা শরিয়তের অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আরবের খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-আশাক ইত্যাদি ইসলামের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে গেছে, ঐ লেবাস না থাকলে এখন কারো ইসলামের কথা বলার অধিকারই থাকে না। এই যে শরিয়ত বা প্রথা প্রচলন করা হলো, এটা কিন্তু কোর’আনের শিক্ষা নয়, ইসলামেরও শিক্ষা নয়, এটা আলেম-ওলামা, বিভিন্ন মাজহাবের ইমামদের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তৈরি করা শরিয়ত। এমন আরো বহু উদাহরণ দেওয়া যাবে। এই জন্য জাতির ঐক্য গঠনের গুরুত্বের চেয়ে লেবাসের গুরুত্ব বেশি। এই অপ্রাকৃতিক বিধানগুলোকে আল্লাহ-রসুলের বিধান বলে প্রচার করছেন ইসলামের ধারক-বাহক এক শ্রেণির আলেমগণ। অথচ ইসলাম কোনো নির্দিষ্ট এলাকার সংস্কৃতিকে অন্য এলাকার মানুষের উপর জোর করে আরোপ করার পক্ষে নয়। সাংস্কৃতিক বিবর্তন একটি প্রক্রিয়া, এটিকে ঘটানো যায় না, এটি কালক্রমে ঘটে। এই মহাসত্যটি, ইসলামের এই অনন্য সৌন্দর্যটি নষ্ট করে ফেলার কারণে ইসলাম তার আবেদন সৃষ্টি করতে পারছে না। এখন সমাজের অর্থনৈতিক অবিচার, সামাজিক অশান্তি, নিরাপত্তাহীনতা, রাজনৈতিক সঙ্কট, বৈশ্বিক সঙ্কট, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, দারিদ্র্য, শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলো নিয়ে ইসলামের আলেমদের কোনো বক্তব্য নেই, সেখানে তাদের কোনো বিচরণ নেই। তারা আছেন নারীদের পোশাক কতটুকু ঢিলা হবে, প্রশ্রাব পায়খানার আগে ও পরে কী দোয়া পড়তে হবে, কুলুখ ব্যবহারের সঠিক পদ্ধতি কী হবে এগুলো নিয়ে। যে সময়টিতে প্রাচীন যুগের আলেমরা এই সব দোয়াকালাম রচনা করছিলেন তখন তাদের সমাজের সামষ্টিক অঙ্গনে আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থা কায়েম ছিল বলে সেখানে উপযুক্ত সমস্যাগুলো যথা অশিক্ষা, দারিদ্র্য, নিরাপত্তাহীনতা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবিচার, অপসংস্কৃতি ইত্যাদি ছিলই না। তাদের ক্ষুরধার মেধাকে তারা এই সব মাসলা উদ্ভাবনে ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছেন, কিন্তু এখন মানবজাতি সমস্যায় আক্রান্ত, মুসলিম নামধারী জনগোষ্ঠীর জীবন সবচেয়ে বেশি নাজুক। এমতাবস্থায় আলেম ওলামাদের উচিত ছিল সেই বিষয়গুলোর উপর গুরুত্ব দেওয়া যার উপর সমাজের শান্তি, নিরাপত্তা নির্ভর করে, সেটা অবশ্যই দাড়ি, টুপি,
পাগড়ি, মেসওয়াক, কুলুখ হতে পারে না। সেটা আসবে অনেক পরে, আগে জাতীয় স্বাধীনতা, মুক্তি।
প্রকৃত ইসলামে নারীকে যে সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছিল সেটা এখন ইতিহাস হয়ে গেছে, বর্তমানের বিকৃত ইসলামে তার লেশমাত্রও নেই। তাই এখন নারী অধিকার নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা ইসলামের ঘোর বিরোধী। হবে না-ই বা কেন, শত শত বছর ধরে নারীকে ঐ সব বিকৃত ফতোয়ার বলি হয়ে নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। ইসলামের নামে নারীকে অবরুদ্ধ করা হয়েছে, শোষণ করা হয়েছে, অবদমিত করা হয়েছে। কোর’আন নারী ও পুরুষকে একে অপরের সহযোগী বলে ঘোষণা দিয়েছে, সেটা অবশ্যই জীবনের সর্ব অঙ্গনে। কিন্তু ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে নারীকে সামাজিক সামষ্টিক জীবনের সকল কর্মকাণ্ড থেকেই নিবৃত করা হয়েছে।
ইসলামের নামে বহু শরিয়তি কেতাব রচনা করা হয়েছে, সেগুলো মেনে চললে মুসলিম মেয়েরা ঘর থেকেই বের হতে পারবেন না। অথচ আলেম সাহেবরা যাদেরকে কাফের বলছেন, সেই ইহুদি-খ্রিষ্টানরা তাদের মেয়েদেরকে বহু আগে মহাকাশে নিয়ে গেছে। এদেশের মেয়েরাও তাদের দেখাদেখি বিমানের ককপিটে বসছে। দুনিয়াটা অগ্রসর হয়ে এই জায়গায় এসেছে, এখান থেকে আর পেছনে যাওয়ার সুযোগ নেই। এখন ঐ মাসলার কেতাব কি এই অগ্রসর যুগের মেয়েরা মেনে নেবে?
তাহলে ইসলামকে যারা আবার তার অতীত গৌরবের অবস্থানে দেখতে চান তাদের এখন কী করণীয়? এই যুগে যদি তারা ইসলাম চান তাহলে বস্তুবাদী, ভোগবাদী সভ্যতার ধারক বাহকদের এটা বলতে হবে যে, “তোমরা দু একটা মেয়েকে চাঁদের দেশে নিয়ে গেছো বটে কিন্তু তোমরা সমাজে থাকা নারীদের স্বাধীনতা দিতে পারো নি। স্বাধীনতা দেব আমরা। একা একটা মেয়ে মানুষ রাতের অন্ধকারে স্বর্ণালঙ্কার পরিহিত অবস্থায় হেঁটে যাবে। বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে, বেইজিং থেকে টরেন্টোতে। তার মনে কোনো ভয় থাকবে না। তোমাদের পুঁজিবাদী গণতন্ত্র, সাম্যবাদ, প্রথাগত রাজতন্ত্র এই স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও অধিকার দিতে পারে নি, কিন্তু সেটা আমরা দেব।” কিন্তু আলেম সাহেবরা তো এটা বলতেই পারবেন না, কারণ তাদের নিজস্ব মতের উপর তৈরি করা শরিয়ত এ কথা বলতে দেবে না। তারা লিখেছেন, মেয়েরা ঘরে থাকবে, বাইরে গেলেও নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে যাবে। যদিও আল্লাহ সমস্ত বিশ্বে বিচরণ করার নির্দেশ দেন সেখানে নিরাপত্তার অজুহাত তুলে মেয়েদেরকে মসজিদেই যেতে দিতে নারাজ, তাহলে তারা বিশ্বের অপর প্রান্তে নারীদেরকে যেতে দেবেন কোন মাসলা মোতাবেক? ওখানেই তো প্রচলিত ইসলামের শরা-শরিয়ত শেষ। আমার প্রশ্ন, যে সমাজে দুই তিন বছরের শিশুকন্যা ধর্ষিতা হয় সেখানে পর্দা নিয়ে ওয়াজ করা গুরুত্বপূর্ণ, নাকি সমাজ পাল্টানোর জন্য আলেমদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া গুরুত্বপূর্ণ?
ধর্মের প্রয়োজন হয় জীবন চালানোর জন্য। ধর্মগুলো যখন মানুষের জীবন চালানোর প্রণালী হিসাবে ব্যর্থ হলো তখন মানুষ বাধ্য হয়ে নিজেরা দীন রচনা করলো, ফলে মানুষ কুফর করলো। পুঁজিবাদী গণতন্ত্র, সাম্যবাদ, রাজতন্ত্র ইত্যাদি হচ্ছে সেই মানবরচিত ধর্ম যার অধীনে থেকে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা তার অর্থনীতি, দণ্ডবিধিসহ যাবতীয় অপরিহার্য ক্ষেত্রগুলোর বিধান তৈরি করে নিচ্ছে। আল্লাহর তৈরি করা একটা বিধানও তাদের সমাজে নেই, তবু দিন থেমে থাকছে না। হতে পারে যে মানুষের রচিত এই ধর্মগুলো তাদেরকে শান্তি দিতে পারছে না, কিন্তু প্রচলিত ধর্মগুলোও তে সেই অভাব পূরণ করতে পারছে না। বর্তমানে পুঁজিবাদী শোষণের পরিণতিতে নিদারুণ অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে, মাত্র ৮ জন মানুষের কাছে পুঞ্জীভ‚ত হয়েছে দুনিয়ার অর্ধেক মানুষের সম্পদ। প্রতিটি দেশে সর্বপ্রকার অপরাধ ধাঁই ধাঁই করে বাড়ছে। রক্তের বন্যায় পৃথিবীর মাটি লাল হয়ে গেছে। কোটি কোটি মুসলমান উদ্বাস্তু হয়ে ইউরোপের পথে পথে ঘুরছে। অর্থনির্ভর ভোগবাদী সভ্যতায় দরিদ্র মানুষের মানবিক অধিকার ও মর্যাদা পদে পদে ভ‚লুণ্ঠিত হচ্ছে। মানুষের সাথে মানুষের কোনো বন্ধনই আর অবশিষ্ট নেই, কেবল অর্থের বন্ধন ছাড়া। সন্তানকে বাবা-মা হত্যা করছে, বাবা-মাকে সন্তান হত্যা করছে।
এই যে মানবতার বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে সেটা কিন্তু গণতন্ত্র, পুঁজিতন্ত্র, কম্যুনিজমেরই ফল। এ থেকে মানুষকে উদ্ধার করার জন্য এখন নতুনরূপে মানুষকে বিকল্প কোনো নবতর আদর্শের দিকে ডাকতে হবে, মানুষকে আবারও মুক্তির পথ দেখাতে হবে, মুক্তির গান শোনাতে হবে। প্রচলিত ফতোয়ার কেতাবকে যারা ইসলাম বলে প্রতিষ্ঠা করতে চান, তারা কিন্তু এমন কোনো আদর্শ মানুষকে দিতে পারেন নি, দিতে পারবেনও না। তারা বিরাট হস্তী হয়েও বাঁধা পড়ে আছেন রদ্দি মাসলা-মাসায়েলের বাঁশের খাঁচাতে, দাড়ি-টুপি-টাখনু, ঢিলা কুলুখ, ডান কাত হয়ে শুয়ে আর বিভিন্ন জনের বিরুদ্ধে ফতোয়াবাজি করতে করতেই তাদের শত শত বর্ষের গোলামের জিন্দেগি পার হয়ে যাচ্ছে। যে জাতি এখনো দাড়ি এক মুষ্টি হবে না বড় হবে, টাখনু কতটুকু দেখা যাবে, নবী নূরের তৈরি না মাটির তৈরি তা নিয়ে বিতর্ক করে, ঝগড়া করে, তাদের কাছে মানবজাতি কী আশা করবে?
এখন ১৩০০ বছরে দীনের অতি বিশ্লেষণের ফলে সৃষ্টি হওয়া সঙ্কীর্ণ মাসলা-মাসায়েলের খাঁচার মধ্যে মানবজাতি স্বেচ্ছায় ঢুকবে না বুঝতে পেরে মোল্লাতান্ত্রিকদের একটি অংশ আবিষ্কার করেছেন জঙ্গিবাদ। কোর’আনে ঘোষিত ইসলামের মৌলিক নীতি – এই দীনে কোনো জবরদস্তি নেই, এই নীতিকেই কোরবান দিয়েছেন। অতঃপর পশ্চিমাদের ভিক্ষা দেয়া ও পরিত্যক্ত অস্ত্র বাগিয়ে গোঁয়ারের মতো প্রাচীন আলেমদের তৈরি করা তাদের সময়ে প্রযোজ্য শরিয়ত (আল্লাহর বিধান নয়) এ যুগের জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। হ্যাঁ, মানছি আল্লাহ-রসুলের নামে এই অনাচার তারা করে যেতে পারবেন কেয়ামত পর্যন্ত। আর মাঝে মধ্যে জানালা খুলে দেখবেন মাহদী (আ.) বা ঈসা (আ.) আসলেন কিনা। কিন্তু ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না। ইসলাম তো তাদের কাছে নাই, প্রতিষ্ঠা করবেনই বা কী করে?
তাদের এই জবরদস্তির নীতি তো রহমাতাল্লিল আলামিন রসুলাল্লাহর (সা.) সুন্নাহ নয়, এটা তো হালাকু-চেঙ্গিস-তৈমুরের নীতি। এভাবে জোর করে, ভয় দেখিয়ে, হালাকু চেঙ্গিসের নীতি অনুসরণ করে কি কোনো মহান সভ্যতা প্রতিষ্ঠা হয়? সাম্রাজ্যবাদ আর সভ্যতা এক বস্তু নয়। এই সব জঙ্গিবাদীদের কাজে মুসলিমরাই ধ্বংস হবে, উদ্বাস্তু হবে, তাদের নারীরা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের দ্বারা ধর্ষিতা হবে, তারা বারবণিতা হবে, পুরুষরাও দেহব্যবসায়ী হবে – যা এখন হচ্ছে। কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে বিকৃত শরিয়তপন্থীরা লড়াই করছেন তাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারবেন না। তারা সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিতে কতটা এগিয়েছে সেটা তারা ভাবতেও পারেন না, সেটা যে বিবেচ্য বিষয় সেটাও তারা বোঝেন না। তারা ভাবেন যে শুধু ধর্মীয় আবেগ আর জোশ দিয়েই বুঝি বিশ্বজয় করে ফেলবেন। অথচ মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য মুসলিম দেশগুলো ধূলায় মিশিয়ে দিতে তাদের একটি সিদ্ধান্ত এবং এক সেকেন্ড সময় প্রয়োজন। গুড়িয়ে যে দিচ্ছে না সেটা মানবতার জন্য নয়, ১৬০ কোটি জোড়হস্ত মুসলমানের ভয়েও নয়, সেটা নিজেদের স্বার্থে। অস্ত্র বিক্রি করার স্বার্থে, সম্পদ লুট করার স্বার্থে।
তাদের দর্শন হচ্ছে জয়ী না হলে অসুবিধা নেই, জান্নাতে তো গেলাম। তারা জান্নাতে গেলেন না কোথায় গেলেন সেটা তো আর দুনিয়াবাসীরা আলমে বরজখে উঁকি দিয়ে দেখতে পারছে না। তাই অন্ধভাবেই বিশ্বাস করতে হচ্ছে। এই সুযোগে জঙ্গিরাও জান্নাতে যাচ্ছে, ঠিক বিপরীত আকিদার পীর-মুরিদরাও জান্নাতে যাচ্ছে, রাজনৈতিক ইসলামিক দলের লোকেরাও জান্নাতে যাচ্ছে, তারা সকলেই আত্মতৃপ্তিতে আছেন। কিন্তু আমরা বলতে চাই, যারা দুনিয়াটাকে জাহান্নাম বানিয়ে স্বার্থপরের মতো নিজেরা কানাগলি দিয়ে জান্নাতে চলে যাওয়ার চিন্তা করেন তারা জান্নাতের সুবাতাসও পাবেন না।
আজকে কেউ যদি বলেন যে “ইসলামের প্রচলিত ধ্যান-ধারণাগুলো কোর’আনের মূলনীতি বজায় রেখে বর্তমান যুগের আলোকে সংস্কার করতে হবে”, এ প্রস্তাবনার পক্ষে যদি তিনি হাজারটা অকাট্য যুক্তি ও প্রমাণ উপস্থাপনও করে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, এই সংস্কারকার্যটি ইসলামের নীতিপরিপন্থীও নয়, এটাই স্বাভাবিক। বরং না করা হলে ইসলামেরই অবমাননা হবে, তাহলে তার বিরুদ্ধে এই ধর্মের যারা ধারক-বাহক সেজে আছেন তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ফতোয়ার বাণ ছুঁড়ে মারবেন। সত্যিকার মিসাইল থেকে সেই ফতোয়ার বাণ কম শক্তিশালী নয়।
তবুও যারা ইসলামকে মানবজাতির জীবনব্যবস্থা হিসাবে দেখতে চান তাদেরকে মনে রাখতে হবে, যুগের চাহিদা মেটানোই ধর্মের বৈশিষ্ট্য। তা যদি না হতো তাহলে যুগে যুগে একলক্ষ চব্বিশ হাজার নবী-রসুল মানবজাতির সমস্যার যুগোপযোগী সমাধান নিয়ে আসতেন না। সুতরাং মুসলিমদেরকে এখন প্রাচীন ধ্যান-ধারণা ও মাসলা মাসায়েলে কেতাব থেকে বেরিয়ে বাস্তবমুখী চিন্তা করতে হবে, ইসলামকে বর্তমান যুগে গ্রহণযোগ্য, প্রয়োগযোগ্য জীবনব্যবস্থা হিসাবে উপস্থাপন করতে হবে। ইসলাম নিঃসন্দেহে সেই অনন্য গুণাবলীর অধিকারী।