এমন একটি সময়ে আমরা উপনীত হয়েছি যখন আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ গুজব-হুজুগ দ্বারা সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক তাণ্ডবের শিকার, যখন আমাদের দেশসহ অত্র অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে ধর্মান্ধতার ভয়াবহ উত্থানের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবে প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশকে যাবতীয় সন্ত্রাসবাদ থেকে নিরাপদ রাখার জন্য “করণীয়” নির্ধারণ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ প্রসঙ্গে হেযবুত তওহীদের প্রস্তাবনা হচ্ছে- “সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ ও গুজব-সন্ত্রাস মোকাবেলার একমাত্র পথ জনসচেতনতা।”
জনসাধারণের ধর্মবিশ্বাসের অপব্যবহার করা হচ্ছে
আমাদের দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। তাদের ধর্মীয় আবেগ রয়েছে কিন্তু ধর্মীয় জ্ঞান সবার সমান নয়। এই সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে মানুষের ধর্মানুভূতিকে নানাভাবে ব্যবহার করছে কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী। তাদের মধ্যে বিভিন্ন মতবাদে বিশ্বাসী ধর্মব্যবসায়ী ও মাদ্রাসাকেন্দ্রিক গোষ্ঠী যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ধর্মকে ব্যবহারকারী নানা লেবাসধারী গোষ্ঠী। তারা বিভিন্ন ইস্যু সৃষ্টি হলে সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে মানুষকে উত্তেজিত করে তোলে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার নামে বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে শুরু করে উন্মাদনা সৃষ্টি করে তথাকথিত তওহীদী জনতার হামলাযজ্ঞ, ভিন্ন মতাবলম্বী মানুষের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, গুজবের বিস্তার করা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপাসনালয় ও পল্লীতে হামলা, হত্যাকাণ্ড চালানো ইত্যাদি সন্ত্রাস সৃষ্টিতে তারা মানুষের পবিত্র ধর্মীয় অনভূতিকে ব্যবহার করে থাকে। ধর্মপ্রাণ মানুষ তাদের হাতিয়ারে পরিণত হয়। এভাবে ধর্মকে ধ্বংসের কাজে ব্যবহার করা হয়। এতে ইন্ধন যোগায় বিভিন্ন রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী মহল এবং হাসিল করে গোষ্ঠীস্বার্থ, দলীয় সুযোগ সুবিধা। অপর একটি গোষ্ঠী তরুণদেরকে জেহাদের কথা বলে হাতে ধরিয়ে দেয় চাপাতি ও মারণাস্ত্র। তাদের দৃষ্টিতে যারা কাফের, মুরতাদ তাদেরকে তারা নির্মমভাবে কুপিয়ে জবাই করে হত্যা করে। তারা প্রয়োজনে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায়, সৃষ্টি করে আতঙ্ক।
ইসলাম যখন এসেছিল তখন এর কিন্তু এত রকম ব্যাখ্যা ছিল না। আজ হাজারো মতবাদ, ফেরকা, তরিকায় ইসলাম বিভক্ত। ফলে মুসলিম জনগোষ্ঠীও বিভক্ত। তাদেরকে যে যেদিকে পারছে টেনে নিয়ে স্বার্থ হাসিল করছে। ইসলামের সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণেই এটা করা সম্ভব হচ্ছে। তাই ধর্মের এরূপ অপব্যবহার রোধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে, আজকের স্বার্থসর্বস্ব ইসলামের মুখোস উন্মোচন করা এবং আল্লাহর রসুলের আনীত ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য মানুষের সামনে তুলে ধরা। তাদের ধর্মীয় অনুভূতিকে যেন কেউ যেমন খুশি তেমনভাবে ব্যবহার করতে না পারে, সেজন্য তাদের ঈমানকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করতে হবে, মানবকল্যাণকর কাজে ব্যবহার করতে হবে।
বিশ্বজুড়ে ধর্মই এখন এক নম্বর ইস্যু
গত শতাব্দীর প্রথমার্ধে আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতি, যুদ্ধ-মহাযুদ্ধ ও সাম্রাজ্যবাদী তাণ্ডবের মুখ্য বিষয় ছিল একনায়কতন্ত্র, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি মতবাদ। ধর্ম তখন মুখ্য বিষয় ছিল না। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঠাণ্ডা লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে হঠাৎ করেই ধর্ম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠতে থাকে। বিভিন্ন পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো তাদের সামরিক, অর্থনৈতিক, ভূরাজনৈতিক, মতাদর্শিক ফায়দা হাসিলের জন্য ধর্মকে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করে। ফলে একদিকে ধর্মের নামে সন্ত্রাস ও উন্মাদনা বাড়তে থাকে, আরেকদিকে বাড়তে থাকে ধর্মবিদ্বেষ। এই নতুন প্রেক্ষাপটে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয় মুসলিমপ্রধান দেশগুলো। বিশেষত, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। এরই পরিণতিতে বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের শিয়া সুন্নি সংঘাত, ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত, সিরিয়া লিবিয়া ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও উদ্বাস্তু সঙ্কট চরম আকার ধারণ করেছে।
এদিকে বিগত চার দশক যাবৎ আফগানিস্তান নামক রাষ্ট্রটি ধর্মীয় উগ্রপন্থা ও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের শিকার হয়ে আসছে। সাম্প্রতিককালে উগ্রবাদী গোষ্ঠীর পুনরায় ক্ষমতা দখলের প্রেক্ষাপটে আবার দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ- যেমন ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদের পুনরুত্থানের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সম্প্রতি আমরা দেখেছি, দুর্গাপূজার সময় উদ্দেশ্যমূলকভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে দেওয়া হয়েছে যার ফলে বেশ কিছু প্রাণনাশের ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে। এমন পরিস্থিতিতে এদেশে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান কঠিন হয়ে উঠছে, বিরাজ করছে চাপা উত্তেজনা। দক্ষিণ এশিয়ার সবদেশেই সামান্য ইন্ধন পেলেই জ্বলে ওঠে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দাবানল। প্রতিবেশী দেশ ভারতে চলছে উগ্র হিন্দুত্ববাদের তাণ্ডব। হিন্দুত্ববাদী চেতনাকে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ রয়েছে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে। বর্তমানে ভারতের কাশ্মীর, উত্তর প্রদেশ, আসাম ইত্যাদি রাজ্যে মুসলিমরা দমন, পীড়ন, নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে। এ ধরনের উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী কর্মকাণ্ডও দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্মীয় উগ্রপন্থার বিস্তারে ইন্ধন যোগাচ্ছে।
এরই মধ্যে মিয়ানমার ও শ্রীলংকায় চলছে উগ্রবাদী বৌদ্ধদের তাণ্ডব। মিয়ানমারে উগ্রবাদী বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ ও মুসলিমবিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য বারবার বৌদ্ধ ভিক্ষু আশ্বিন উইরাথুর নাম উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। এছাড়া দেশটিতে উগ্র মুসলিমবিদ্বেষ ছড়ানোর কাজে লিপ্ত “বৌদ্ধ ধম্ম পরহিত ফাউন্ডেশন” নামের আরেকটি সংগঠনকে ২০১৭ সালে নিষিদ্ধ করে মিয়ানমার সরকার। এদেরই উস্কানি ও প্রচারণায় রোহিঙ্গারা হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছিল। একইভাবে শ্রীলংকায় ‘বুদ্ধিস্ট ফোর্স’ নামে উগ্রবাদী বৌদ্ধদের একটি সংগঠনের উস্কানিতে ২০১৮ সালে বহু নির্দোষ মুসলমানের বাড়িঘর, মসজিদ, দোকান ইত্যাদিতে হামলার ঘটনা ঘটে এবং পরিস্থিতি এতই খারাপ হয়ে ওঠে যে, সরকার জরুরি অবস্থা জারি করতে বাধ্য হয়। বর্তমানে দেশ দু’টিতে উগ্র জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ সংগঠনগুলো ক্রমাগত মুসলিমবিদ্বেষী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে। এ ধরনের মুসলিমবিদ্বেষী ঘটনাগুলো সারাবিশ্বে ইসলামের নামে উগ্রবাদ বিস্তারে বড় ধরনের ভূমিকা রেখে যাচ্ছে।
![](https://www.hezbuttawheed.org/wp-content/uploads/2023/03/এমামুযযমান.jpg)
প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
বাংলাদেশের গত চার দশকের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে আমরা বলতে পারি, এদেশে ধর্মান্ধতার বিস্তার ঘটার জন্য প্রধানত তিনটি গোষ্ঠী দায়ী। যথা- ধর্ম নিয়ে অপরাজনীতিকারী গোষ্ঠী, ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও উগ্রবাদী জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী। বিগত প্রায় তিন যুগ ধরে বাংলাদেশে চলছে ধর্ম নিয়ে অপরাজনীতি। রাজনৈতিক অঙ্গনে ধর্মের অপব্যবহার দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকার ফল হয়েছে এই যে, দিনদিন ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, হুজুগ, গুজব, ধর্মীয় উন্মাদনা ইত্যাদি সমাজে বেড়েই চলেছে। আবহমান কাল থেকে চলে আসা বাঙালির উদার ও অসাম্প্রদায়িক চরিত্র বদলে গিয়েছে এবং ক্রমেই জনগণের মধ্যে উগ্রবাদী ধ্যান-ধারণা ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বিষ ছড়িয়ে পড়ছে, যা সুস্থ চিন্তার মানুষের কাছে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে ধর্মব্যবসায়ী আরেকটি গোষ্ঠী রয়েছে, যাদেরকে সরাসরি রাজনীতির সাথে যুক্ত না থাকলেও বিভিন্ন ইস্যুতে একজোট হয়ে জ্বালাও পোড়াও সহিংসতা করতে দেখা যায়। এরা অনেকে প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতি করে না, কিন্তু সাম্প্রদায়িক বিভিন্ন ইস্যুতে এদেরকে সংগঠিতভাবে রাস্তায় নামতে ও সহিংসতা করতে দেখা যায়। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে- বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে যত সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে, ধর্ম অবমাননার গুজব ছড়িয়ে ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি করে ও মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোক জড়ো করে যেসব হামলার ঘটনা ঘটেছে, দেখা গেছে অধিকাংশ ঘটনাতেই এই ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী সরাসরি জড়িত ছিল এবং পেছন থেকে এদেরকে সহযোগিতা করেছে বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা। সেই সাথে সেক্যুলারদের নীরব ভূমিকা এবং ক্ষেত্রবিশেষে সহযোগিতাও তাদের পথকে সহজ করে দিয়েছে। ২০১৬ সালের ১৪ মার্চ নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীতে হেযবুত তওহীদের সদস্যদের উপর বর্বরোচিত হামলা ও দুইজন সদস্যকে জবাই করে হত্যার ঘটনাটি এমনই এক যৌথ আক্রমণ ছিল। এই ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুললেই তার বিরুদ্ধে শুরু হয় ফতোয়াবাজি, মিথ্যাচার, উস্কানিমূলক ওয়াজ ও হুমকি-ধামকি। তারপর শুরু হয় তাণ্ডবলীলা।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী হামলার ঘটনাও কম নয়। পত্র-পত্রিকার ভাষ্যমতে, বাংলাদেশে অন্তত চল্লিশের বেশি উগ্রবাদী সন্ত্রাসী দল সক্রীয় রয়েছে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া জঙ্গি হামলাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো-২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা, ২০০৫ সালে ৬৩ জেলায় জেএমবির বোমা হামলা, ২০১৫ সালে ব্লগার অভিজিৎ রায়কে অমর একুশে বইমেলার পাশে কুপিয়ে হত্যা, ২০১৬ সালে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদের জামাতের পাশে বোমা হামলা ও একই বছর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে ১৯ জন বিদেশিকে জবাই করে হত্যা করে।
সাম্প্রদায়িক হামলা ও সন্ত্রাসবাদী হামলা মোকাবেলায় সরকারের উদ্যোগ
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের প্রেক্ষাপটে এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা মোকাবেলায় সরকার এখন পর্যন্ত যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- সন্ত্রাসবিরোধী কঠোর আইন প্রণয়ন, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি, সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ক্রয় ও ব্যবহার, সন্ত্রাস দমনে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত বিশেষায়িত বাহিনী গঠন, সন্ত্রাসীদেরকে কঠোর সাজা প্রদান, জঙ্গিদের আস্তানায় ব্যাপক মাত্রায় অভিযান, রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে অর্থ খরচ করে আলেম ওলামাদেরকে দিয়ে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বক্তব্য প্রদান ইত্যাদি। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় আদৌ কি উগ্রবাদ ও সাম্প্রদায়িক হামলা নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে?
সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে শক্তি প্রয়োগের ব্যর্থতা প্রমাণিত
২০০১ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র আল কায়েদা, তালেবান ইত্যাদি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ভয়ংকর এক যুদ্ধ আরম্ভ করেছিল। এই যুদ্ধের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ও ইরাক দখল করে নেয়। শুধু ইরাকেই দশ লক্ষ মানুষ হত্যা করে। এই যুদ্ধে ২০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা মিত্ররা সর্বাত্মক সামরিক শক্তি, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করার পর আমরা দেখতে পেলাম- যুক্তরাষ্ট্র তালেবানদের হাতে আফগানিস্তান ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো এবং লজ্জাজনক একটি চুক্তি করে আফগানিস্তান থেকে শেষ মার্কিন বিমানটি উড়ে গেল পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে। অর্থাৎ সামরিক অভিযান চালিয়ে তারা কোনো সফলতাই পেল না।
আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের গ্লানিময় পশ্চাদপসরণ ও তালেবানের পুনরুত্থান এটাই প্রমাণ করে যে, শুধুমাত্র শক্তি প্রয়োগ করে সন্ত্রাসবাদ নির্মূল সম্ভব নয়। বিষয়টি এখন দিনের আলোর মত পরিষ্কার। পাশ্চাত্যের বিশ্লেষকরা, সামরিক বিশেষজ্ঞরা ও নিরাপত্তাবোদ্ধারাও অনেক আগে থেকে বলে আসছেন শুধু শক্তি প্রয়োগের পন্থায় সফল হওয়া যাবে না। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর সাবেক প্রধান মাইকেল হেইডেন বলেন, “আমরা যদি কেবল মানুষ হত্যা করেই সব কিছুর সমাধান করতে পারতাম, তাহলে ১৪ বছর আগেই আমরা সফল হতাম। কোন্ কোন্ বিষয়ে প্রভাবিত হয়ে তরুণ সুন্নিরা জিহাদের দিকে ঝুঁকছে, সেগুলো সবার আগে চিহ্নিত করতে হবে। নতুবা তাদের নির্মূল করা সম্ভব হবে না।’
সিআইএর আরেক সাবেক কর্মকর্তা ব্রুস রিডেল বলেন, ‘আইএস কিংবা আল-কায়েদার শীর্ষ নেতাদের হত্যা করার যে কৌশল বর্তমানে রয়েছে, তা যথার্থ নয়। কী কী কারণে আইএস সৃষ্টি হচ্ছে, তা এই কৌশল মোকাবেলা করতে পারে না। তাই কৌশল বদলাতে হবে।’ তিনি বলেন- ‘যুদ্ধটা করতে হবে আরো গভীর থেকে। যেটা হবে অবশ্যই মতাদর্শিক লড়াই। আমরা ¯্নায়ুযুদ্ধের সময় যেটা করেছি। আমরা কমিউনিস্ট মতাদর্শের বিরুদ্ধে লড়েছি এবং সফল হয়েছি।” এমনকি জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুনকেও আমরা বলতে শুনেছিলাম ‘জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থায় জঙ্গিবাদ আরো বেড়েছে’। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদের একটি অধিবেশনের প্রশ্নোত্তরে বলেছিলেন, ‘কেবল অস্ত্র দিয়ে জঙ্গিবাদ দমন সম্ভব নয়’। (প্রথম আলো, ৫ অক্টোবর ২০১৬) এছাড়াও শুধু শক্তি প্রয়োগ করে জঙ্গিবাদ নির্মূল সম্ভব নয় এমন মন্তব্য করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া (২৮ মার্চ, ২০১৭), সাবেক বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) আ.ল.ম ফজলুর রহমান (চ্যানেল আই-তৃতীয় মাত্রা, ১৯ অক্টোবর ২০১৫), কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম (২২ জানুয়ারি, ২০১৭, টকশো- ‘মুখোমুখী’, চ্যানেল ২৪), বিশ্লেষক এম আবুল কালাম আজাদ (মতামত, ডেইলি স্টার, ০১/০৭/২০১৮), অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান (২৪ নভেম্বর, ২০১৫), আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক এম সাখাওয়াত হোসেন (১২ নভেম্বর, ২০১৪), রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. তোফায়েল আহমেদ (০২ এপ্রিল, ২০১৭, বিবিসি বাংলা) সহ দেশের বহু জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি।
তাহলে উপায় কী?
উপায় একটাই- শক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি হুজুগ, গুজব, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় উন্মাদনার বিরুদ্ধে আদর্শিক লড়াই করতে হবে। হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী ২০০৯ সালে সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ থেকে সৃষ্ট যাবতীয় সংকট নির্মূলে আদর্শিক লড়াইয়ে সরকারকে সহযোগিতার জন্য। সেই প্রস্তাবনায় তিনি যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে তুলে ধরেছিলেন- যেহেতু উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো কোর’আন, হাদিস ও ইসলামের ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যা দ্বারা উদ্বুদ্ধ, কাজেই তাদের সামনে কোর’আন হাদিসের সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরেই সাম্প্রদায়িকতার অসারতা প্রমাণ করতে হবে। ধর্মীয় ব্যাখ্যার বাইরে অন্য কোনো ব্যাখ্যা তাদের সামনে তুলে ধরে তাদেরকে নিবৃত করা সম্ভব নয়। আল্লাহর রহমে হেযবুত তওহীদের কাছে ইসলামের সেই প্রকৃত আদর্শ (সঠিক আকিদা, উগ্রবাদের কাউন্টার ন্যারেটিভ) রয়েছে, যা উগ্রবাদের অসারতা প্রমাণ করতে সক্ষম। আমরা শুধু সরকারকে প্রস্তাব দিয়েই বসে থাকিনি, বরং নিজেদের সীমিত সামর্থ্যরে সর্বোচ্চটা দিয়ে আমরা চেষ্টা করছি উগ্রবাদ নির্মূলে আদর্শিক মোকাবেলার জন্য। আমরা ইতোমধ্যেই দেশব্যাপী জনপ্রতিনিধিদেরকে নিয়ে হাজার হাজার আলোচনা সভা, মতবিনিময় সভা, র্যালি, মানববন্ধন, পথসভা ইত্যাদির আয়োজন করেছি। সে সব অনুষ্ঠানে উপস্থিত লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মানুষের সামনে আমরা ইসলামের সঠিক আদর্শ তুলে ধরেছি। এছাড়া আমরা গণমাধ্যম কর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মী ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের সাথে যোগাযোগ, মতবিনিময় অনুষ্ঠান, সভা-সেমিনার ইত্যাদি আয়োজন করে সাম্প্রদায়িকতা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সবাইকে ভূমিকা রাখার উপায় প্রস্তাব করেছি। ইনশা’আল্লাহ, হেযবুত তওহীদ বাংলাদেশকে সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানের মতো সন্ত্রাসবাদ কবলিত রাষ্ট্রে পরিণত হতে দিবে না। এটা হেযবুত তওহীদের অঙ্গীকার। তবে তার জন্য অবশ্যই সকল শান্তিকামী মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে সন্ত্রাসবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, অপরাজনীতি, ধর্মান্ধতা ও ধর্মের নামে যাবতীয় অধর্মের বিরুদ্ধে।