সোয়াইব আল বান্না
সমস্ত পৃথিবীর কোটি কোটি আদম সন্তানকে, ভৌগোলিক, অর্থনীতিক, জাতীয় ইত্যাদি শত-সহস্র ভাগে বিভক্ত করে রেখেছে পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতা। এসব বিভক্তির মধ্যে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক যে বিভক্তি করা হয়েছে তাহলো- ধর্মীয় বিভক্তি। এর পরিণাম হয়েছে সুদূরপ্রসারী, আজও তার ঘানি টেনে বেড়াচ্ছে মানবজাতি। অনেকে বলতে পারেন ধর্মীয় বিভক্তি তো আগে থেকেই ছিল। এটা সত্য যে এটা আগে থেকে ছিল, কিন্তু পশ্চিমা ‘সভ্যতা’ একে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। মাত্র কিছুদিন আগে প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার সভাপতি ও সাবেক বিচারপতি মার্কেন্ডি কাতজু বলেছেন, ১৮৫৭ পর্যন্ত ভারতে সাম্প্রদায়িকতা বলতে গেলে ছিলই না। হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে পার্থক্য ছিল বটে, কিন্তু শত্র“তার সম্পর্ক ছিল না। সিপাহী বিদ্রোহের সময়ও হিন্দু ও মুসলিম একতাবদ্ধভাবে ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। বিদ্রোহ দমনের পরে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দেরকে উরারফব ধহফ জঁষব অর্থাৎ ঐক্যহীন করে শাসন করার নীতি গ্রহণ করেন।” ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা যে ব্রিটিশদের সৃষ্টি তার ভুরি ভুরি প্রমাণ দেওয়া যাবে। ইতিহাসে ফকীর আন্দোলন ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ বলে যে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের কথা জানা যায়, সেটা আসলে একই বিদ্রোহের দু’টি নাম। এতদঞ্চলের হিন্দু এবং মুসলিম শাসক ও জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় ও উভয় সম্প্রদায়ের প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় ব্রিটিশ শাসকের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল, যে বিদ্রোহই পরবর্তীতে সিপাহী বিদ্রোহের রূপ পরিগ্রহ করে। এ সময়ের কথা পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিতে কাজী নজরুলের একটি লাইন উল্লেখ করছি।
হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন?
কাণ্ডারি বলো, ‘ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার’।
অর্থাৎ ভেদাভেদ তৈরির যে প্রচেষ্টা ব্রিটিশ সরকার নিয়েছিল তার বিরুদ্ধে এই কথাগুলি ছিল কবির সাহসী উচ্চারণ। তারা এই উপমহাদেশকে আপাতঃ স্বাধীন করে চলে গেলেও যাওয়ার আগে ধর্মের ভিত্তিতে পাক-ভারতকে ভেঙ্গে ভাগ ভাগ করে রেখে যায় যে ভাগগুলি বিগত বছরগুলিতে নিজেদের মধ্যে বহু যুদ্ধ করেছে এবং আজও একে অপরের বিরুদ্ধে শত্র“ভাবাপন্ন, রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত। এমনকি নিজেদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার দাবিতেও সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে বহু মানুষ। এভাবে অশান্তি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে।
হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে কত যে ভাগ আছে তা বলতে গেলে লেখা অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে। এক এলাকায় যে দেবতার পূজা করা হয়, অন্য এলাকায় সেই দেবতার নামও অজানা। হৃদয় বিদারক বর্ণভেদ প্রথা আজও হিন্দু সমাজকে কুরে কুরে খাচ্ছে। খ্রিস্টানরা তো শুরুতেই দু’টি প্রধান ভাগে ভাগ হয়ে গেল: ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্ট। মুসলমানরা বিভক্ত হলো শিয়া, সুন্নি, হানাফি, সালাফি, ওহাবী, মালেকী, শাফেয়ী, হাম্বলী ইত্যাদি শত শত সর্বনাশা ভাগে। শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে পাশ্চাত্য সভ্যতা এগুলিকে জাতিগুলির আত্মায় একেবারে পাকাপোক্ত করে দিল। মাদ্রাসাগুলিতে এই শিয়া ও সুন্নী মতবাদ, বিভিন্ন ইমামের মতবাদগুলিকে আলাদাভাবে শেখানো হল, ফলে এই শিক্ষায় শিক্ষিতরা চিরকালের তরে একে অপরের শত্রু বনে গেল। একটি বিষয়ের নামই রাখা হল তর্কশাস্ত্র। অর্থাৎ যত পার মত তৈরি কর, যত পার পথ তৈরি কর। পথ-মত তৈরি করতে করতে এখন এক ইসলামেই হলো হাজার হাজার ভাগ, মত, ফেরকায় বিভক্ত। সারা বিশ্বে মারেফতি তরিকাগত বিভক্তি যে কত আছে তার হিসাব নেই, চিশতীয়া, কাদেরিয়া, মোজদ্দেদীয়া, নকশবন্দিয়া পীরের অনুসাসারীরা আরেক পীরের অনুসারীদের শুধু বিরোধিতা, বা ঘৃণাই করে না হামলা করে হতাহত পর্যন্ত করছে। ভৌগোলিক সীমা থেকে ধর্মীয় সীমারেখা আরো মারাত্মক। ভৌগোলিক সীমারেখা গুলি খেয়ে, ড্রামের ভিতরে ঢুকে, লাশের গাড়িতে করে হলেও পার হওয়া যায়, কিন্তু এই ধর্মীয় সীমানা কোনো অবস্থাতেই পার হওয়া যায় না। একজন খ্রিস্টানকে বৌদ্ধ বানানো বা হিন্দুকে মুসলমান বানানো যতটা না কঠিন, একজন শিয়াকে সুন্নী বানানো বা সুন্নীকে শিয়া বানানো তার চাইতে কঠিন। প্রতি বছর শুধুমাত্র শিয়া, সুন্নি সংঘর্ষে কত হাজার লোক যে নিহত হয় তার সঠিক হিসাব নেই। কি নিদারুন পরিহাস!