মো: হাসানুজ্জামান:
মানবজাতির পার্থিব ও পারলৌকিক অর্থাৎ যাবতীয় কল্যাণের উদ্দেশ্যে যুগে যুগে স্রষ্টার পক্ষ থেকে তাঁর বার্তাবাহকগণ সত্যধর্ম নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন। সকল ধর্মই সত্য- ন্যায়, কল্যাণ এবং মানবজাতির শান্তির পক্ষে কথা বলে। কারণ স্রষ্টা হলেন যাবতীয় সত্য, ন্যায় ও কল্যাণের আধার। স্রষ্টা প্রেরিত সর্বশেষ দীন হলো দীনুল ইসলাম। পৃথিবী থেকে সকল প্রকার অন্যায়-অবিচার, অত্যাচার, যুদ্ধ-রক্তপাত এক কথায় অশান্তিকে নির্মূল করে, মানবজাতিকে এক জাতিতে পরিণত করার উদ্দেশ্যেই শেষ নবীর আগমন। এ জন্য মানবজাতির মধ্যে ঐক্য অপরিহার্য। এ জন্য ইসলাম ঐক্যকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। অন্যদিকে অনৈক্য এই মহাপরিকল্পনার পথে প্রধান অন্তরায়। তাই এই দীনের বিধানগুলোও অনৈক্যের বিরুদ্ধে অতিশয় কঠিন।
সারা দুনিয়ার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, জাত-পাত, হিংসা-বিদ্বেষ লুপ্ত করে তাদেরকে এক কাতারে নিয়ে আসার মতো অসাধ্য সাধন করা যার উদ্দেশ্য, সেই মহামানব সর্বপ্রথম যে কাজটিতে মনোনিবেশ করেছিলেন তাহল সীসা ঢালা প্রাচীরের ন্যায় একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠন করা। ইতিহাসে পাই- তদানীন্তন আরবের ৫ লাখের একটি জাতিকে তিনি (দ:) তাঁর জীবদ্দশাতেই ঐক্যবদ্ধ করে গিয়েছিলেন। এর কারণও অতি সোজা। তিনি এটা ভালোভাবেই জানতেন যে- তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব এক জীবনে পূর্ণ করে যাওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়।
তাই তিনি তাঁর যাবতীয় কর্মকাণ্ড, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই জাতিটিকে হাতে কলমে এমন শিক্ষা দিয়ে গেলেন যাতে এই ঐক্যবদ্ধ জাতিটি তাঁর চলে যাওয়ার পরেও আপ্রাণ সংগ্রাম করে সমস্ত পৃথিবীকে ঐ শিক্ষা পৌঁছে দিয়ে মানবজাতিকে এক জাতিতে পরিণত করতে পারে। তিনি জানতেন এই কাজ এই জাতি ততক্ষণ পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারবে যতক্ষণ তাদের মধ্যে ঐক্য বজায় থাকবে। ঐক্যের হানি ঘটলেই জাতি তার চলার গতি হারিয়ে ফেলবে এবং এক সময় স্থবির হয়ে পড়বে- উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে। এটা পৃথিবীর এক অমোঘ নিয়ম যে- একটি জাতি কিংবা একটি সংগঠন যত শক্তিশালীই হোক, ধনে-বলে যতই উন্নত হোক, যদি তাদের মধ্যে ঐক্য না থাকে তবে তারা কখনোই জয়ী হতে পারবে না। অতি দুর্বল শত্র“র কাছেও পরাজিত হবে। তাই আল্লাহ বহুবার কোর’আনে এই ঐক্য অটুট রাখার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। এই ঐক্য যাতে না ভাঙ্গে সে জন্য তাঁর রসুল (দ:) সদা শংকিত ও জাগ্রত থেকেছেন। ঐক্য নষ্ট হবার সম্ভাবনা আছে এমন কোনো কথা বা কাজ যখনই কাউকে করতে দেখেছেন তখনই তিনি ভীষণ রেগে গেছেন।
রসুলাল্লাহর জীবনী যারা ভাসা ভাসাভাবেও পড়েছেন তারাও এটা অস্বীকার করতে পারবেন না যে- তাঁর নবী জীবনের ২৩ বছরে তিনি কত অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। মক্কা ও তায়েফের মাটিতে তাঁকে মোশরেকদের ক্রীড়া-কৌতুকের পাত্র হতে হয়েছে, প্রস্তরাঘাতে পবিত্র দেহ থেকে রক্ত ঝরাতে হয়েছে। যুদ্ধের ময়দানে শত্র“র অস্ত্রের আঘাতে জর্জরিত হয়েছেন। কিন্তু তিনি ঐ মোশরেকদের উপর রেগে গিয়েছেন বা তাদের অভিসম্পাত করেছেন এমন কোনো নজীর কেউ দেখাতে পারবে না। বরং তিনি তাদের জন্য আল্লাহর কাছে মাগফেরাত কামনা করেছেন। কিন্তু সর্বরিপু জয়ী ঐ একই ব্যক্তির রাগও আমরা দেখতে পাই তাঁর পবিত্র জীবনীতে। না, সেটা মোশরেকদের জর্জরিত করা আঘাতের কারণে নয়, তাঁরই প্রাণপ্রিয় আসহাবদের মধ্যে কেউ যখন কোর’আনের কোনো আয়াত নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করতে দেখেছেন তখন তিনি রেগে লাল হয়ে গেছেন। তাঁর আসহাব এবং ঐতিহাসিকদের বর্ণনা মোতাবেক রসুলকে আমরা সর্বদাই একজন সদা হাস্যময় এবং শান্ত-সৌম্য মানুষ হিসেবে দেখতে পাই। অপরাধীকে ক্ষমা করে দেওয়া তাঁর চরিত্রে অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সেই মানুষটিও রেগে অগ্নিশর্মা হয়েছেন। কখন হয়েছেন? যখন তিনি কাউকে এমন কোনো কাজ করতে দেখেছেন যার ফলে তিলে তিলে গড়ে তোলা তাঁর আজীবনের সাধনা, অর্থাৎ মহান আল্লাহ তাঁকে যে কাজের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছেন তার প্রতি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, অর্থাৎ যে কাজের ফলে তাঁর সারা জীবনের সংগ্রাম ব্যর্থ হয়ে যাবে।
তাঁর পবিত্র জীবনীতে আমরা পাই, একদিন দুপুরে আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) রসুলাল্লাহর গৃহে গিয়ে দেখেন তাঁর মুখ মোবারক ক্রোধে লাল হয়ে আছে। কারণ তিনি দু’জন আসহাবকে কোরানের একটি আয়াত নিয়ে মতবিরোধ করতে দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি (দঃ) বললেন- কোরানের আয়াতের অর্থ নিয়ে যে কোনরকম মতভেদ কুফর। নিশ্চয়ই তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিসমূহ (উম্মাহ) তাদের (ওপর অবতীর্ণ) কেতাবগুলোর (আয়াতের) অর্থ নিয়ে মতো বিরোধের জন্য ধ্বংস হয়ে গেছে। তারপর তিনি আরও বললেন (কোরানের) যে অংশ (পরিষ্কার) বোঝা যায় এবং ঐক্যমত আছে তা বল, যেগুলো বোঝা মুশকিল সেগুলোর অর্থ আল্লাহর কাছে ছেড়ে দাও (মতবিরোধ করো না) [হাদিস-আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) থেকে- মুসলিম, মেশকাত]।
এটা একটা প্রাকৃতিক নিয়ম যে মতভেদ থেকেই অনৈক্যের সূত্রপাত। আর অনৈক্য মানেই ব্যর্থতা, দুর্বল শত্র“র কাছেও পরাজয়। সুতরাং সামান্য বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক ও মতভেদের মাধ্যমে তাঁর পবিত্র জীবনের সব সংগ্রাম, ত্যাগ যদি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় তবে তা কি করে তিনি মেনে নিতে পারেন? এ কারণেই আমরা সর্ব রিপু জয়ী এই জিতেন্দ্রিয় মহামানবকেও রেগে লাল হতে দেখেছি।
তাই মুসলিম জাতির ঐক্যের গুরুত্ব কতখানি তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ইসলামের বিরুদ্ধে, রসুলাল্লাহর বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধের চেয়েও বড় অপরাধ হলো মুসলিম জাতির মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি করা। কারণ জাতির মধ্যে যে কোনো রকমের মতভেদের সূত্রপাতই অনৈক্য সৃষ্টি এবং পরিণামে জাতি ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট। এ কারণে রসুলাল্লাহ ঐক্য নষ্ট হয় এমন কোনো কথা, কাজ বা ইশারা-ইঙ্গিতকেও কুফর বলে আখ্যায়িত করেছেন।
কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় এই যে জাতির অখণ্ডতা ও অবিভাজ্যতা সম্পর্কে আল্লাহ ও রসুলের এমন স্পষ্ট আদেশ-নিষেধ সত্ত্বেও মুসলিম জাতি আজ শরিয়াহগতভাবে শিয়া-সুন্নি, হানাফি, মালেকি, শাফেয়ী, হাম্বলী, আহলে হাদিস; আধ্যাত্মিকভাবে- কাদেরিয়া, নক্শবন্দিয়া, মোজাদ্দেদিয়া, আহলে বাইত, ভৌগোলিকভাবে ৫৫ টিরও বেশি রাষ্ট্রে এবং ইহুদি খ্রিস্টানদের নকল করে রাজনৈতিকভাবে কেউ গণতন্ত্রী, কেউ সমাজতন্ত্রী, কেউ সাম্যবাদী, কেউ রাজতন্ত্রী, কেউ পুঁজিবাদী ইত্যাদি হাজার হাজার ভাগে বিভক্ত।
কোর’আনে আল্লাহ বলেছেন- ‘সকল মুমিন ভাই ভাই।’ হাদিসে রসুলাল্লাহ বলেছেন- ‘উম্মতে মোহাম্মদী জাতি যেন একটি শরীর, তার একটি অঙ্গে ব্যথা পেলে সারা শরীরেই ব্যথা অনুভূত হয়।’ অথচ আজ আর তারা এক জাতি, ভাই-ভাই তো নয়-ই উপরন্তু নিজেরা নিজেরা মারামারি-হানাহানি, রক্তপাত, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, বোমাবাজি করে চূড়ান্ত ঐক্যহীন ও শতধা বিচ্ছিন্ন একটি জাতিতে পরিণত হয়েছে। আর তাই রসুলাল্লাহ তাদেরকে যে মহান উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন সেই উদ্দেশ্য অর্জন করাও তাদের দ্বারা সম্ভব হোচ্ছে না।
শুধু শেষ রসুলের উম্মাহ হিসেবেই নয়, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও যদি আমরা মানব জাতির কল্যাণ ও উন্নতি কামনা করি তাহোলে মানুষকে সমস্ত প্রকার বিভক্তি- ব্যবধান ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। মানুষ একই দম্পতি বাবা আদম (আঃ) ও মা হাওয়া (আঃ) থেকে আগত, সুতরাং মানুষকে সেই আদি পরিচয়ে ফিরে যেতে হবে। ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এর কোনো বিকল্প পথ খোলা নেই।