ধর্ম কথাটির অর্থ হলো ধারণ করা। অর্থাৎ কোনো বস্তুর অন্তর্নিহিত গুণই হল সেই বস্তুর ধর্ম। যেমন-আগুনের ধর্ম পোড়ানো, পানির ধর্ম ভেজানো। আগুন যদি তার পোড়ানোর ক্ষমতা হারায় তাহলে সেটা আর আগুন থাকে না, পানি যদি তার ভেজানোর ক্ষমতা হারায় তবে তা আর পানি থাকে না। কারণ, তারা তাদের নিজ ধর্ম বা গুণ ত্যাগ করেছে। ঠিক তেমনি মানুষের ধর্ম হলো মানবতা, মনুষ্যত্ব। একজন মানুষের দুঃখে অন্যজন দুঃখিত হবে, তার সাহায্যের জন্য এগিয়ে যাবে এবং অন্যের আনন্দে সে আনন্দিত হবে, এটাই মানুষ হিসেবে তার অšত্মর্নিহিত গুণ বা ধর্ম। মানুষের এই ধর্মই তাকে পশুর থেকে আলাদা করে। মানুষ হলো স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। কারণ মানুষ জ্ঞান, বিবেক, মানবতা ও মনুষ্যত্ববোধসম্পন্ন প্রাণী। তাই সে স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক হতে পারে না। পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রের ছোট থেকে বড় যে কোনো সংকট, অন্যায়, অশান্তি, ঐক্যহীনতা তাকে ভাবিয়ে তুলবে। আর তাই তার অন্তর্নিহিত মনুষ্য ধর্মের তাড়নাতেই সে এগিয়ে যায় সমাজের সকল অন্যায় অশান্তি দূর করে এক শান্তিপূর্ণ সমাজ নির্মাণের মানসে। যেখানে থাকবে না কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্ব, অন্যায়, অশান্তি, মানুষের জীবন ও সম্পদের অনিরাপত্তা। যেখানে নিরাপদ থাকবে প্রতিটি নারী ও শিশু। যেখানে প্রতিটি মানুষের মনের মূল মন্ত্রই হবে সমাজের উন্নতি সাধন। অপর দিকে পশু হলো জ্ঞান-বুদ্ধিহীন হিংস্র প্রাণী।
একটা পশুর জীবন পরিক্রমায় জন্মের পর থেকে শুধু মাত্র বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য সংগ্রহই তার জীবনের মূল লড়্গ্য। বয়স হলে সন্তান জন্ম দিবে, তার আহার যোগান দিতে সারা দিন পরিশ্রম করবে এবং একটা পরিণত বয়স হলে মারা যাবে। আর এই কাজের জন্য একে অপরকে হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করেনা বরং পশুর সমাজে এক পশু আরেক পশুকে হত্যা করা, এক পশু আরেক পশুর মাংস খাওয়াটাই সাধারণ চিত্র। যেটা মানব ধর্মের তথা মনুষ্য সমাজের সম্পূর্ণ বিপরীত। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো আজকে আমাদের পৃথিবীব্যাপী কোথাও এমন একটি জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে প্রতিদিন কোনো না কোনো অন্যায় সংঘটিত হয় না। পশুর সমাজে যাওয়ার সময় মানুষ পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিয়ে যায়, বন্য পশুর হাত থেকে রড়্গা পাওয়ার জন্য সাথে অস্ত্র রাখেন। ঠিক তেমনি এই মনুষ্য সমাজেও মানুষ নিজের নিরাপত্তার জন্য সাথে অস্ত্র রাখেন, দেহরড়্গী নিয়োগ করেন মানুষেরই হাত থেকে রড়্গা পাওয়ার জন্য।
যারাই মোটামুটি পত্রিকা, টেলিভিশনে খবরের চ্যানেলগুলোতে চোখ রাখেন তারা সকলেই জানেন যে প্রতি সেকেন্ডেই পৃথিবীর কোথাও না কোথাও খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ লুট, অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে সাদাকে কালো, কালোকে সাদা করা হচ্ছে। যেখানে এক বাংলাদেশের মতো ছোট আয়তনের দেশে গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ৩ হাজার ৫৮৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তাহলে পুরো পৃথিবীর পরিসংখ্যান কী হতে পারে তা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। এখন এই সকল অপরাধ কোনো এলাকা, সমাজ, বা রাষ্ট্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এখনতো বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে এক দেশ আরেক দেশের সম্পদ লুট করা, নিরীহ মানুষকে কচুকাটা করা, নারী ও শিশুকে তারই পিতা, ভাই বা স্বামীর সামনে ধর্ষণের মতো জঘন্য কাজেরও রেওয়াজ শুরম্ন হয়ে গেছে। এত কিছুর পরও যারা নিরাপদে এসির বাতাসে জীবন যাপন করছেন, যাদের ঘরের চালে কোনো শত্রম্নর শকুন দৃষ্টিপরেনি, যেই ঘরের মেয়েরা কোনো বখাটের লালসার শিকার হয়নি এখনো তারা বলে, সমাজে তো শান্তি অবারিত, আমরাতো ঐক্যবদ্ধ। সরকারপক্ষ বলে এই সরকার যতদিন থাকবে ততদিন কেউ কোনো ড়্গতি করতে পারবে না, বিরোধীপড়্গ বলে যতদিন এই সরকার থাকবে ততদিন মানুষ শান্তি পাবে না।
আমি বলি ভাই, আর কত নিরীহ মানুষের রক্ত দিলে, আর কত নারী ও শিশু ধর্ষিতা হলে একটি সমাজের আর কতটুকুু অধঃপতন হলে আমরা বুঝতে পারবো যে, আমরা আর মানুষ নেই, আমরা সবাই পশু হয়ে গেছি। মানুষ তার মনুষ্য ধর্ম হারিয়েছে। এই পৃথিবীতে মানবতা আজ ভুলুণ্ঠিত, এটা মনুষ্যধর্মহীন এক পশুর সমাজে পরিণত হয়েছে। কান পাতলেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের শত শত অনাথ, ক্ষধার্ত শিশুর কান্না, হাজার হাজার ধর্ষিতা নারীর হৃদয়ের আর্তনাদ এখনো যারা শুনতে পাই না, এখনো যারা ঐক্যবদ্ধ একটা জাতি তৈরির প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারছি না তাদের এই উদাসীনতার খেসারত হয়তো আমাদের ১৬ কোটি বাঙালির জীবন, সম্পদ এবং ইজ্জত দিয়েই চুকাতে হবে। আর সমস্ত অনৈক্য ভুলে যদি মানবতাবাদী এক জাতি, এক দেশ, ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ হতে পারি, তবে এই ষোল কোটি বাঙালি হয়তো পাল্টে দিতে পারে পৃথিবীর এই ঘৃণিত প্রেড়্গাপট। যার জন্য প্রয়োজন কিছু নিস্বার্থ, মানবতাবাদী মানুষের একটা ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত। যারা এই সমাজকে পরিবর্তনের জন্য গড়ে তুলবে আরেকটি রেনেসা। যার ফলে মানুষের মনের জগতে ঘটবে পরির্তন। সমাজের প্রতিটি স্তরে বিরাজ করবে মানবতা , মনুষ্যত্যবোধ, ন্যায়, সততা, ঐক্য। যার ভিত্তিতে গড়ে উঠবে মনুষ্যধর্মসম্পন্ন একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ।