রিয়াদুল হাসান
ধর্ম আর ধর্মব্যবসাকে গুলিয়ে ফেলার কারণে অধিকাংশ মানুষ ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে ভাবে- ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলছি না তো? ধর্মব্যবসায়ীদেরকে ত্যাগ করতে গিয়ে ভাবে ধর্মকে ত্যাগ করছি না তো? ধার্মিক ও ধর্মব্যবসায়ীর মধ্যে একটি সুস্পষ্ট সীমারেখা তাই আমাদের টানতে হবে। মনে রাখতে হবে, ধর্ম মানুষকে মুক্তি দেয়। এটা যেমন ব্যক্তিকে তেমনি সমাজকেও যাবতীয় অন্যায়-অনাচার থেকে মুক্তি দেয়; যাবতীয় সমস্যার সমাধান দেয়, উন্নতি ঘটায়। অপরপক্ষে ধর্মব্যবসা ধর্মকেই ধ্বংস করে দেয়, ধর্মের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট করে দেয়।
ধর্ম এবং ধর্মব্যবসা আলাদা করার অন্যতম কষ্টিপাথর হলো- কর্মটিতে ব্যক্তিগত স্বার্থ আছে কি না তা পরখ করে দেখা। ধর্মের কাজ হয় নিঃস্বার্থভাবে। ধর্মের কাজ করতে গেলে স্বার্থ ত্যাগ করতে হয় এবং বিনিময় কেবল আল্লাহর নিকট থেকে আশা করতে হয়। যখনই দেখা যাবে কেউ ধর্মের নাম দিয়ে ব্যক্তিগত বৈষয়িক স্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ উদ্ধার করছে তখনই বুঝতে হবে – এটা ধর্মব্যবসা।
ধর্মব্যবসায়ীরা হয় ভোগী আর ধার্মিকরা হয় ত্যাগী। ধর্মব্যবসায়ীরা দান গ্রহণ করে আর ধার্মিকেরা দান করে। ধর্মব্যবসায়ীরা ধর্মকে ব্যবহার করে আর ধার্মিকরা ধর্মকে ধারণ করে। ধর্মব্যবসায়ীরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে হয় নীরব, কাপুরুষ আর ধার্মিকরা হয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার, তারা আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করে না। ধর্মব্যবসায়ীরা যেটুকু ধর্ম পালন করে তা কেবল মানুষকে দেখানোর জন্য আর ধার্মিকরা ধর্ম পালন করে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য।
অর্থাৎ ধার্মিক আর ধর্মব্যবসায়ীর প্রভেদ তাদের বেশ-ভূষা, ভাবমূর্তির মধ্যে খুঁজলে হবে না। খুঁজতে হবে তাদের চরিত্রে এবং তাদের কাজে। আল্লাহর রসুল বলেছেন, “কেয়ামতের দিন মিজানের পাল্লায় সবচেয়ে ভারি বস্তু হবে মো’মেনের উত্তম চরিত্র (হাদিস – তিরমিযি)।প্রতারণা করার জন্য বেশভূষা গুরুত্বপূর্ণ ছদ্মবেশ। তাই যারা ধার্মিক সেজে ধর্মব্যবসা করে তারা বেশভূষায় একেবারে নিখুঁত থাকার চেষ্টা করে যেন কেউ তাদের বাহ্যিক অবয়বে, চালচলনে ভুল ধরতে না পারে। যারা ধর্মব্যবসা করে তাদেরকে বেশভূষা আর লোক দেখানো আমল বিচার করে দীনের ধারক-বাহক মনে করা মস্ত বড় পথভ্রষ্টতা। কারণ এ বিষয়ে আল্লাহর রসুল (সা.) জাতিকে সাবধান করে গেছেন এই বলে যে, যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ, কোনো মানুষের ঈমান সঠিক হতে পারবে না যতক্ষণ না সে সৎ ও বিশ্বাসী হয়। আমি তোমাদেরকে হেদায়েত করছি যে তোমরা কোনো ব্যক্তির অধিক সালাহ আদায় ও অধিক সিয়াম পালন করা দেখে ভুল করো না, বরং লক্ষ্য করো সে যখন কথা বলে সত্য বলে কি না এবং তার কাছে রাখা আমানত বিশ্বস্ততার সাথে ফিরিয়ে দেয় কিনা। এবং নিজের পরিবার পরিজনের জন্য হালাল উপায়ে রোজগার করে কিনা। যদি সে আমানতদার ও সত্যবাদী হয় এবং হালাল উপায়ে রেযেক হাসিল করে তাহলে নিশ্চয়ই সে কামেল মো’মেন (রসুলাল্লাহর ভাষণ, সিরাত বিশ্বকোষ ১২ খণ্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশন)।
বর্তমানে মুসলিম চেনার জন্য চারিত্রিক মাহাত্ম্য নয় বরং দাড়ি, টুপি, বেশভূষাকেই মানদণ্ড হিসাবে ধরা হয়। কারণ এটাই প্রচার করা হয়েছে, শেখানো হয়েছে। দাড়ি, টুপি নেই এমন কেউ যদি আজ প্রকৃত ইসলামের সত্যগুলো এবং প্রচলিত ইসলামের বিকৃতিগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরতে যান, এমন কি ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য শহীদ হতেও পণ করেন তখনও প্রথম যে প্রশ্নটির মোকাবেলা তাকে করতে হবে সেটা হচ্ছে, “আপনি ইসলামের কথা বলছেন, কিন্তু আপনার সাড়ে তিন হাত শরীরেই তো ইসলাম নাই? আগে তো নিজেদের শরীরে ইসলাম কায়েম করতে হবে। ইসলামের আপনি কী বুঝেন, মাদ্রাসায় পড়েছেন?” খুব আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে সম্পূর্ণ যুক্তিহীন ও হাস্যকর এই প্রশ্নটি করা হয়। মুসলিম জাগরণের কবি, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘আমার কৈফিয়ৎ ’কবিতায় কম দুঃখে এ কথা বলেন নি,
ফতোয়া দিলাম কাফের কাজী ও,
যদিও শহীদ হইতে রাজি ও।
একজন ব্যক্তির শুধুমাত্র মাদ্রাসায় না পড়া অথবা দাড়ি-টুপি ধারণ না করার অপরাধে তার সকল সত্য ও ন্যায়সঙ্গত বক্তব্যকেই যারা তুড়ি দিয়ে বাতিল করে দিচ্ছেন, এখন যদি তাদেরকে পাল্টা প্রশ্ন করা হয় যে, দাড়ি, টুপি, পাগড়ি ধারণ না করলে ইসলামের কথা বলা যাবে না এমন কোনো কথা পবিত্র কোর’আন-বা হাদিসে উল্লেখ আছে কি? এমন কোনো শর্ত তো আল্লাহ বা রসুল (স.) দেন নি। তাহলে এমন প্রশ্ন কেন উঠল?
এই প্রশ্ন ওঠার কারণ ইসলামের বিষয়গুলোর মধ্যে গুরুত্বের ওলোট-পালোট। ইসলামের মূল বিষয়বস্তুকে বাদ দিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণের ফলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এখন যদি জিজ্ঞেস করা হয় ইসলামের উদ্দেশ্য কী? তাহলে ১৬০ কোটি মুসলিমের কাছে অন্ততঃ ভিন্ন ধরনের কয়েক কোটি উত্তর পাওয়া যাবে। তাই পোশাক আশাকের বিষয়টি সম্যকভাবে বুঝতে হলে আগে আমাদেরকে ইসলামের উদ্দেশ্য কী সেটা উপলব্ধি করতে হবে।
মানবসৃষ্টির সূচনালগ্নে মহান আল্লাহর সঙ্গে ইবলিসের একটি চ্যালেঞ্জ হয়। সেই চ্যালেঞ্জটির বিষয়বস্তু ছিল মানবজাতি পৃথিবীতে শান্তিতে বসবাস করবে, নাকি মারামারি কাটাকাটি হানাহানি, যুদ্ধ, রক্তপাতে লিপ্ত থাকবে? মানুষ যদি শান্তিতে থাকে তাহলে চ্যালেঞ্জে আল্লাহ বিজয়ী হবেন, আর যদি অশান্তি অরাজকতার মধ্যে বাস করে তাহলে ইবলিস বিজয়ী হবে। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ নবী-রসুলদের মাধ্যমে জীবনবিধান পাঠালেন। সেটা মানুষের সামগ্রিক জীবনে প্রতিষ্ঠা করলে সমাজে শান্তি আসবে। আর অন্য জীবনব্যবস্থা দিয়ে জীবন চালালে অশান্তি বিরাজ করবে। নবী-রসুলগণ এভাবে আল্লাহকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে গেছেন।
সত্য দীনের ফল হচ্ছে শান্তি, এ কারণে ইসলামের শাব্দিক অর্থই হচ্ছে শান্তি। আজ ধর্মের নামে বহু বাহ্যিক আড়ম্বর করা হয়, উপাসনা, আনুষ্ঠানিকতার কোনো শেষ নেই, অথচ আমরা আমাদের সামগ্রিক জীবন পরিচালনা করছি আল্লাহর হুকুম বাদ দিয়ে। আজ সর্বত্র ঘোর অশান্তি, যার অর্থ আজ ইবলিস বিজয়ী হয়ে আছে। আর আল্লাহর দীন, জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ব্যতিরেকে আর কোনো কিছু দিয়েই আল্লাহকে বিজয়ী করা সম্ভব না। ফলে যে কাজের দ্বারা আল্লাহ বিজয়ী হন না, সমাজে ন্যায়, শান্তি, সুবিচার প্রতিষ্ঠা হয় না, সে কাজের সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই।
এখন চিন্তা করুন, ইসলামের সাথে দাড়ি, টুপি, পাগড়ি, জুব্বার সম্পর্ক কোথায়? ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন-ব্যবস্থা অর্থাৎ ব্যক্তি, পরিবার, যুদ্ধনীতি, বাণিজ্যনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি সব কিছুই ইসলাম নামক জীবন-ব্যবস্থার এক একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সুতরাং যারা আমাদের শরীরে ইসলাম নাই এই প্রশ্ন করেন তাদের কাছে এই প্রশ্নটি করা দরকার যে, একটি দেশের সব মানুষ যদি দাড়ি রাখে, টুপি পরে, জোব্বা গায়ে দেয় কিন্তু তাদের সামষ্টিক জীবনের ঐ বিষয়গুলো যদি ইসলামের না হয় তাহলে কি সেই দেশে শান্তি এসে যাবে? আসবে না। কারণ রসুলের (স.) আগমনের পূর্বেও আরবের মানুষগুলো দাড়ি রাখত, টুপি, পাগড়ি, জোব্বা পরত। এটা প্রাচীন যুগ থেকেই আরবীয় সংস্কৃতি। কথিত আছে দাড়ি ছিল আরবদেশে নেতা নির্বাচনে যোগ্যতার অন্যতম মাপকাঠি এবং পৌত্তলিকদের প্রথা (Tradition, Custom)। রসুলাল্লাহ এসে জাহেলিয়াতের যুগের বহু রসুম-রেওয়াজকে কবর দিয়ে ভারসাম্যপূর্ণ ও যৌক্তিক সংস্কৃতি আচার প্রথা চালু করলেন। পরবর্তীকালে যখন উমাইয়া রাজতন্ত্র চালু হয় তখন দাড়িকে ইসলামের চিহ্ন বলে এবং রসুলের মহা গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত বলে চালু করা হলো। দরবারী আলেমগণ এই আকিদার প্রসারে বেশ ভূমিকা রাখেন। খলিফার আসনে উপবিষ্ট ইয়াজিদের বেশ লম্বা দাড়ি ছিল এটা ঐতিহাসিক সত্য। লম্বা দাড়ি ছিল তার পিতা মুয়াবিয়া (রা.) এবং পিতামহ আবু সুফিয়ানেরও। সেই লম্বা দাড়ি নিয়েই আবু সুফিয়ান রসুলাল্লাহর বিরুদ্ধে হাজারো ষড়যন্ত্র করেছে, দীনের চূড়ান্ত বিরোধিতা করেছে, শুধু তা-ই নয়, একের পর যুদ্ধ করে শত শত সাহাবিকে হত্যা করেছে। কী লাভ হলো আবু সুফিয়ান, আবু জেহেল, আবু লাহাবদের দাড়ি রেখে? প্রকৃতপক্ষে দাড়ি ছিল আরবীয় ঐতিহ্য ও বিশেষত কোরায়েশ বংশীয় অভিজাত্যের প্রতীক। সুতরাং সে ঐতিহ্য যেন কায়েম থাকে সেটারই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করা হয়েছিল জাল হাদিসে দাড়ির গগনস্পর্শী গুরুত্ব প্রদানের মাধ্যমে।
প্রকৃতপক্ষে এই শেষ দীনে কোনো নির্দিষ্ট পোষাক হতে পারে না, কারণ এটা এসেছে সমস্ত পৃথিবীর মানুষের জন্য। পৃথিবীর মানুষ প্রচণ্ড গরমের দেশে, প্রচণ্ড শীতের দেশে, নাতিশীতোষ্ণ দেশে, অর্থাৎ সর্বরকম আবহাওয়ায় বাস করে, এদের সবার জন্য এক রকম পোষাক নির্দেশ করা অসম্ভব। বিশ্বনবীর (সা.) সময়ে তাঁর নিজের এবং সাহাবাদের পোষাক-পরিচ্ছদ ও তখনকার আরবের মোশরেক ও কাফেরদের পরিচ্ছদ যেমন একই ধরনের ছিল, বর্তমানেও মুসলিম আরব, খ্রিষ্টান আরব ও ইহুদি আরবরাও একই ধরনের পোষাক-পরিচ্ছদ পরে। নবী এসেছেন আরবে, তাই তিনি আরবীয় পোশাক পরেছেন। তিনি পুরুষ, শুধু পুরুষ নন – সুপুরুষ, বীরপুরুষ, মহাপুরুষ। তাঁরও দাড়ি ছিল তবে সে দাড়ি উসকো-খুসকো, উলুঝুলু, হাওয়ায় ওড়ানো অনিয়ন্ত্রিত দাড়ি ছিল না। তাঁর দাড়ি ছিল সুন্দরভাবে নির্দিষ্ট মাপে ছাঁটা যেন তাঁকে সুন্দর (Smart) দেখায়। আল্লাহ দাড়িকে পবিত্র কোর’আনে বাধ্যতামূলক (ফরদ) করেন নি, করলে গোটা মানবজাতির মধ্যে বিরাট একটি অংশই সেটা পালন করতে পারত না। তেমনি আরবীয় পোশাককেও তিনি ইসলামে বাধ্যতামূলক করেন নি। করলে মেরু অঞ্চলের মানুষের সেই হুকুম মান্য করা সম্ভব হতো না। এমনকি আমাদের দেশের মতো কৃষিপ্রধান নদীমাতৃক দেশের ধানচাষি ও পাটচাষিদের সারাক্ষণ কাঁদা, হাঁটুপানি-কোমর পানিতে নেমে লুঙ্গি কাছা দিয়ে কাজ করতে হয়। আরবীয় জোব্বা পরে সেটা কি সম্ভব? না। আল্লাহ সেটা জানেন বলেই আরবের পোশাক তিনি সকল এলাকার মুসলমানদের জন্য বাধ্যতামূলক করেন নি বা উৎসাহিতও করেন নি।
কিন্তু ঘটনা হয়েছে কি, পূর্বের ফকীহ, ইমাম, মুফাসসিরগণ রসুলাল্লাহর সমস্ত আচরণকেই ইসলামের মাসলা মাসায়েলের মধ্যে, বিধি-বিধানের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন। তাদের যুক্তি হলো আল্লাহ রসুলকে অনুসরণ করার হুকুম দিয়েছেন। আলেম ওলামারা এই অনুসরণের মানে করেছেন যে রসুলের দাড়ি ছিল, তিনি খেজুর খেতেন, তিনি পাগড়ি, জোব্বা পরিধান করতেন – তাই এগুলোও করতে হবে। এগুলোকেও তারা শরিয়তের বিভিন্ন স্তরের অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন। সেখানেও আছে উপর্যুপরি মতভেদ। ফকীহ-মুফতিদের কেউ বলছেন এগুলো ওয়াজিব, কেউ বলছেন সুন্নত। সেই সুন্নতের মধ্যেও আছে প্রকারভেদ। কেউ বলছেন সুন্নতে মোয়াক্কাদা, কেউ সুন্নতে যায়েদা ইত্যাদি। এখন আরবের খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-আশাক ইত্যাদি ইসলামের এতই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে গেছে, ঐ লেবাস না থাকলে এখন কারো ইসলামের কথা বলার অধিকারই থাকে না। এই যে শরিয়ত বা প্রথা প্রচলন করা হলো, এটা কিন্তু কোর’আনের শিক্ষা নয়, ইসলামেরও শিক্ষা নয়, এটা আলেম-ওলামা, বিভিন্ন মাজহাবের ইমামদের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তৈরি করা শরিয়ত।
এমন আরো বহু উদাহরণ দেওয়া যাবে। এই জন্য জাতির ঐক্য গঠনের গুরুত্বের চেয়ে লেবাসের গুরুত্ব বেশি। তাদের অধিকাংশ সদস্য জানেই না যে দীন প্রতিষ্ঠা কী জিনিস, কিন্তু দাড়ির বিষয়ে তারা খুব সতর্ক। গুরুত্বের এরই সাংঘাতিক ওলট-পালট কী করে হলো সে আলোচনা অন্যত্র করেছি। বাস্তবতা হলো, এই অপ্রাকৃতিক বিধানগুলোকে আল্লাহ-রসুলের বিধান বলে প্রচার করছেন ইসলামের ধারক-বাহক এক শ্রেণির আলেমগণ। অথচ ইসলাম কোনো নির্দিষ্ট এলাকার সংস্কৃতিকে অন্য এলাকার মানুষের উপর জোর করে আরোপ করার পক্ষে নয়। ইসলামে পোশাকের ব্যাপারে আল্লাহ এমন বিশ্বজনীন একটি নীতি দিয়েছেন যা পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের মানুষের জন্যই অনুসরণযোগ্য, সেটা হচ্ছে তিনি পুরুষদের জন্য সতর নির্ধারণ করেছেন নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত (এ নিয়েও মতভেদ আছে)। তবে আল্লাহ বা রসুল কেউই বলে দেন নি যে দেহের এই স্থান কী পোশাক দিয়ে আবৃত করতে হবে।
টুপি ইহুদি, শিখ বা অন্যান্য ধর্মের ধর্মগুরুরাও পরেন, তাদেরও দাড়ি আছে, তারাও জুব্বা পরেন, তাদের অনেকেই পাগড়ি পরেন। আল্লাহর অস্তিত্বে সম্পূর্ণ অবিশ্বাসী হিসাবে পরিচিত অনেকেরই দাড়ি ছিল যেমন কার্ল মার্কস, চার্লস ডারউইন, আব্রাহাম লিঙ্কন প্রমুখ। হয়ত বলতে পারেন তাদের টুপি, জুব্বা, পাগড়ি, দাড়ি মুসলিমদের মতো না। হ্যাঁ, তা হয়ত ঠিক, কিন্তু টুপির আকার-আকৃতি (কল্লি) ও রং নিয়ে, জুব্বার আকার-আকৃতি নিয়ে, পাগড়ির রং (সবুজ না সাদা), দাড়ির পরিমাণ ইত্যাদি নিয়ে আলেম ওলামাদের মধ্যেও মতভেদ কম নেই। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মতবিরোধে গিয়ে মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে যাওয়ার চেয়ে বড় মূর্খতা আর কিছু নেই, হতে পারে না। গত কয়েক শতাব্দী ধরে এ জাতির দুর্ভাগ্যজনক পরাজয়ের কারণ এগুলোই। অথচ এটা ইতিহাস যে রসুলের একদল সর্বত্যাগী সাহাবী যাদেরকে আসহাবে সুফফা বলা হতো, তাঁরা বাড়ি-ঘরে যেতেন না, মসজিদে নববীতে থাকতেন আর অপেক্ষা করতেন রসুল (সা.) কখন কী হুকুম দেন এবং সঙ্গে সঙ্গে সে হুকুম বাস্তবায়ন করতেন, সেই সাহাবীদের অনেকেরই গায়ে জোব্বা তো দূরের কথা ঠিকমত লজ্জাস্থান ঢাকার মতো কাপড় সংস্থান করতেও কষ্ট হত।
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি ৭০ জন আসহাবে সুফফাকে দেখেছি, তাদের গায়ে কোনো চাদর ছিল না। তাদের পরনে থাকত একখানা লুঙ্গি কিংবা একখণ্ড কাপড়, যা তারা গলদেশের সঙ্গে বেঁধে রাখতেন। আর নামাজের সময় তা হাত দিয়ে চেপে ধরতেন যেন সতর খুলে না যায়।
আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর (রা.) বলেন, আসহাবে সুফফা ছিলেন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত। তাদের আর্থিক অবস্থা এতই শোচনীয় ছিল যে, শীত নিবারণ কিংবা পুরো শরীর আবৃত করার মতো কোনো কাপড় তাদের ছিল না। এ অবস্থায় অর্ধ আবৃত পোশাক নিয়ে তারা বাইরে আসতে লজ্জাবোধ করতেন। অন্যদিকে সুফফার (মসজিদে নববীর একটি অংশ) চারপাশ খোলা ছিল বলে অবাধে ধুলাবালি ঢুকত। ফলে তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ ময়লা হয়ে যেত। (সিরাতুন্নবী- আল্লামা শিবলি নোমানী, হেকায়েতে সাহাবা)।
সুতরাং অতি উৎকৃষ্ট মো’মেন হওয়ার জন্য বড় বড় জোব্বা পরতে হবে এমন কোনো শর্ত ইসলামে থাকতে পারে না। তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই, বিশ্বনবী (সা.) তার অনুসারীদের একটা নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যরে দাড়ি রাখতে বলেছেন। কেন বলেছেন? এই জন্য বলেছেন যে, তিনি যে জাতিটি, উম্মাহ সৃষ্টি করলেন তা যেমন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি তেমনি বাইরে থেকে দেখতেও যেন এই উম্মাহর মানুষগুলো সুন্দর হয়। আদিকাল থেকে দাড়ি মানুষের পৌরুষ ও সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে আছে। সিংহের যেমন কেশর, ময়ূরের যেমন লেজ, হাতির যেমন দাঁত, হরিণের যেমন শিং, তেমনি দাড়ি মানুষের প্রাকৃতিক পৌরুষ সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্য নষ্ট না করার উদ্দেশ্যেই দাড়ি রাখার প্রসঙ্গ। দীন প্রতিষ্ঠা করে ইবলিশের চ্যালেঞ্জে আল্লাহকে জয়ী করার উদ্দেশ্যে নয়।
দাড়ি, টুপি, পাগড়ি, জোব্বা ইত্যাদিকে আমরা অপ্রয়োজনীয় বিষয় বলছি না বা কোনো রকম অসম্মানও করছি না। আমরা শুধু বলছি এই দীনের প্রকৃত উদ্দেশ্য আজ যেমন উল্টো হয়ে গিয়েছে তেমনি এর বাহ্যিক দিকটিও বিকৃত দীনের আলেমরা অপরিসীম অজ্ঞতায় উল্টে ফেলেছেন। দাড়ি রাখা, বাহ্যিক পোষাক-পরিচ্ছদ ইত্যাদি এই দীনের বুনিয়াদী কোনো ব্যাপার নয় অর্থাৎ ফরদ নয়, সুন্নত। তাও রসুলের একেবারে ব্যক্তিগত সুন্নত যে ব্যাপারে রসুলাল্লাহ তাঁর একটি অন্তিম অসিয়তে বলেছেন, “হে মানবজাতি! আগুনকে প্রজ্বলিত করা হয়েছে এবং অশান্তি অন্ধকার রাত্রির মতো ধেয়ে আসছে। আল্লাহর শপথ, আমি আমার থেকে কোনো কাজ তোমাদের উপর অর্পণ করি নি, আমি শুধু সেটাই বৈধ করেছি যেটা কোরা’আন বৈধ করেছে, আর শুধু সেটাই নিষেধ করেছি যেটা কোর’আন নিষেধ করেছে।” (রসুলাল্লাহর প্রথম জীবনীগ্রন্থ সিরাত ইবনে ইসহাক ও সিরাত ইবনে হিশাম।)
রসুল যতই বলুন আমার ব্যক্তিগত কিছুই তোমাদেরকে মেনে চলতে হচ্ছে না, আমাদের আলেম-ওলামারা রসুলের সুন্নাহ অনুসরণের নামে সেই ব্যক্তিগত দাড়ি-মেসওয়াক, আরবীয় লেবাসকেই মুসলিম জাতির উপর চাপিয়ে দিতে শত শত বছর ধরে চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছেন। এর কারণ এগুলো অনুকরণ করতে কোনো ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজন হয় না। দাড়ি-টুপি (লেবাস) যদি এই দীনের কোনো ফরদ বা বুনিয়াদী বিষয় হতো, তবে কোর’আনে একবার হলেও এ বিষয়ে নির্দেশ দেওয়া হতো। আল্লাহর রসুল এটা সুস্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন যে- আল্লাহ তোমাদের বাহ্যিক অবস্থা, পোশাক, চেহারা বা সম্পদ কোনো কিছুর দিকেই দৃষ্টিপাত করেন না, তিনি দেখেন তোমাদের হৃদয় এবং তোমাদের কাজ। (হাদিস: আবু হুরায়রা (রা.) থেকে মুসলিম)
তাই ‘দাড়ি ইসলামের চিহ্ন’, ‘দাড়ি না রাখলে ইসলামের কথা বলা যাবে না’ এ ধারণা সঠিক নয়। তবে কেউ যদি দাড়ি রাখতে আগ্রহী হয় তাকে এটা বলা যেতে পারে যে, যদি দাড়ি রাখতেই চান তবে, রসুল যেভাবে দাড়ি রাখতে বলেছেন সেভাবে রাখুন যেন সুন্দর, পরিপাটি (Smart) দেখায়। রসুলাল্লাহর যে কোনো সুন্নাহই কল্যাণকর, তাই ব্যক্তিগত জীবনেও রসুলাল্লাহর যা কিছু অনুসরণ করা হবে তাতে মানুষ কল্যাণ পাবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আগে কোনটা? আজ সারা পৃথিবীতে কোথাও আল্লাহকে বিধানদাতা (ইলাহ) হিসাবে মানা হচ্ছে না। মুসলিম নামের এই জনসংখ্যাও পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী সভ্যতাকে বিধাতার আসনে বসিয়ে রেখেছে। এ কারণে আল্লাহর দৃষ্টিতে তারা মো’মেন নেই, রসুলের কথা মতে উম্মতে মোহাম্মদীও নেই। কাজেই তারা আগে ফরজ- যা সরাসরি আল্লাহর হুকুম তা পালন করুক। তারা আগে কলেমার দাবি মোতাবেক এক আল্লাহর হুকুম ছাড়া আর কারো হুকুম-বিধান, দীন মানবো না, এই অঙ্গীকারে নিজেদের আবদ্ধ করুক, আগে মো’মেন হোক; তারপরে সামর্থ্য মোতাবেক সুন্নত, নফল, মুস্তাহাব পালন করুক কোনো আপত্তি নেই। আল্লাহর রসুল বলেছেন, এমন সময় আসবে যখন মানুষ তাহাজ্জুদ পড়বে কিন্তু ঘুম কামাই করা হবে, সওম রাখবে কিন্তু না খেয়ে থাকা হবে (হাদিস)। রসুলাল্লাহ বর্ণিত সেই সময়টি এখন। যেখানে তাহাজ্জুদ, সওমের মতো একনিষ্ঠ আমলও বৃথা যাবে, সেখানে দাড়ি, টুপি, পাগড়ি, জোব্বার মতো আমল গৃহীত হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না।
ইসলামের বিশেষজ্ঞরা কোর’আন হাদিস নিয়ে গবেষণা করে বের করেছেন যে সালাতের বাইরে শর্তমূলক ৭ ফরদ, ভিতরে ৭ ফরদ (রোকন), ২১ টি ওয়াজিব, ২১ টি সুন্নাত, ৭ টি মুস্তাহাব। এর মধ্যে দাড়ি, টুপি, জোব্বা, পাগড়ি ইত্যাদি কোনো একটি বিষয়ের কোনো উল্লেখ নেই। যে বিষয় নামাজের সময় প্রয়োজন হয় না, সে বিষয় কী করে ইসলামের মৌলিক বিষয় হতে পারে বা তাকওয়ার নির্দেশক হতে পারে? মাহবুবুর রহমান তার নামাজ প্রশিক্ষণ বইতে নামাজ ভঙ্গ হওয়ার মোট ১২৭টি ছোট বড় কারণ উল্লেখ করেছেন। নিশ্চয়ই তিনি কোর’আন হাদিস, ইজমা, কিয়াস, ফেকাহ, মাসলা মাসায়েলের অগণিত বই ঘেঁটে এই কারণগুলো বের করেছেন। (নামাজ প্রশিক্ষণ – মাহবুবুর রহমান) সেই ১২৭টি কারণের মধ্যে এই বিষয়টি তিনি উল্লেখ করেন নি যে আল্লাহ বলেছেন, তোমরা তাদের অনুসরণ (ইত্তেবা) করো যারা কোনো বিনিময় নেয় না এবং সঠিকপথে আছে। (আল কোর’আন: সুরা ইয়াসীন ২১)। যে কথাটি আল্লাহ স্বয়ং কোর’আনে বলে দিলেন যে বেতনভুক্ত বা পার্থিব বিনিময় গ্রহণকারী ব্যক্তির পেছনে ইত্তেবা করবে না, তার আনুগত্য করবে না সেটা মান্য করা কি ফরদ নয়? সেই ফরদ লঙ্ঘন করে ধর্মজীবী ইমামের পেছনে নামাজ পড়লে সেই নামাজ কি আল্লাহ গ্রহণ করবেন? নামাজ যেন আল্লাহর কাছে কবুল হয় সেজন্য আমাদের অতি পরহেজগার মুসুল্লিগণ শরীর পাক, জায়গা পাক, কেবলামুখী হওয়া ইত্যাদি ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, মুস্তাহাব নিখুঁতভাবে অনুসরণ করেন, ওজু এমন নিখুঁতভাবে করেন যে, নাকের পশম ভিজল কিনা সেটাও খেয়াল করা হয়। ঘড়ি ধরে বসে থাকে ওয়াক্ত হওয়ার জন্য। কিন্তু নামাজ কবুল হওয়ার আল্লাহ প্রদত্ত শর্ত যে বিনিময় গ্রহণকারীর পেছনে না দাঁড়ানো, সেটার কথা তারা সবাই বেমালুম ভুলে গেলেন? একেই কি বলে বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো?
আমাদের ইসলামের বিশেষজ্ঞরা মুস্তাহাব আর মাকরুহ নিয়ে গবেষণা করে নিজ নিজ পাণ্ডিত্য প্রকাশে এতই মহাব্যস্ত হয়ে পড়েছেন যে, আল্লাহর নিষেধাজ্ঞাটি তাদের দৃষ্টির অগোচরে চলে গেছে। একটি অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে যখন হিমালয় দেখা হয় তখন আকাশছোঁয়া দিগন্তবিস্তারী পর্বতমালা আর দৃষ্টিগোচর হয় না, পথের একটি ধূলিকণা নিরীক্ষণ করতে করতেই বেলা পার হয়ে যায়।
কার্লমার্কস কমিউনিজম বলে একটি জীবনব্যবস্থা সৃষ্টি করেছেন। এটাও একটা দীন এবং অবশ্যই এই আশা নিয়ে যে তার অনুসারীরা একে সমস্ত পৃথিবীময় প্রতিষ্ঠা করবে এবং তা করতে সর্বরকম সংগ্রাম করবে। তার অনুসারীরা তা করেছেও। অর্থনৈতিক অবিচার, অন্যায়কে শেষ করে সুবিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তারা অতুলনীয় ত্যাগ, সাধনা, সংগ্রাম, সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পৃথিবীর এক বিরাট অংশে তাদের আদর্শ (সমাজতন্ত্র) প্রতিষ্ঠা করেছে। আজ বা ভবিষ্যতে যদি কমিউনিস্টরা তাদের উদ্দেশ্য ভুলে যেয়ে কার্ল মার্কসের ব্যক্তিগত অভ্যাসগুলোকে অনুকরণ করতে থাকে তবে মার্কস কি তাদের অনুসারী কমিউনিস্ট স্বীকার করবেন? তিনি যদি কোনোভাবে কবর থেকে উঠে এসে দেখেন, যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ধ্বংস করার জন্য তিনি সংগ্রাম শুরু করেছিলেন সেই পুঁজিবাদকে তার অনুসারীরা গ্রহণ করে নিয়েছে, কম্যুনিস্ট সংবিধান বাদ দিয়ে জাতীয় জীবনে পাশ্চাত্যের ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে, কিন্তু ব্যক্তি জীবনে তারা আগের মতই কমিউনিজম বিশ্বাসী, তারা মার্কসের মতো চুল দাড়ি রাখে, তার মতো হ্যাট পরে, তার মতো কাপড় পরে, মার্কস যে কাতে ঘুমাতেন অনুসারীরাও সেই কাতে শোয়, যেভাবে দাঁত মাজতেন সেইভাবে মাজে, হাতে কাস্তে হাতুড়ী মার্কা ব্যাজ পরে, সুর করে দ্যাস ক্যাপিটাল পড়ে এবং কে কত সুন্দর সুর করে তা পড়তে পারে তার প্রতিযোগিতা করে পুরস্কার বিতরণ করে এবং এসব করে সত্যি বিশ্বাস করে যে তারা অতি উৎকৃষ্ট কমিউনিস্ট এবং মার্কসের বিশ্বস্ত অনুসারী- তবে মার্কস কী করবেন? নিঃসন্দেহে বলা যায় যে তিনি তার অনুসারী দাবিদারদেরকে ‘কমিউনিস্ট’ বলেই স্বীকার করবেন না, বরং তাদের গায়ে থুথু দেবেন। কম্যুনিস্টরা যদি পুঁজিবাদী গণতন্ত্রই গ্রহণ করে তবে তারা আর কম্যুনিস্ট রইল কী করে?
অনুরূপ অবস্থায় মহানবী (সা.) কী করবেন তা আমাদের কষ্ট করে অনুমান করতে হবে না। কারণ সে কথা তিনি আমাদের আগেই বলে দিয়েছেন। সহিহ হাদিসে উল্লিখিত বিবরণের শাব্দিক অনুবাদকে সহজ ভাষায় বললে ঘটনাটি এমন দাঁড়ায় যে, হাশরের দিন আল্লাহর রসুল (সা.) সবার আগে হাউসে কাওসারে পৌঁছে যাবেন, তারপর তাঁর উম্মতের মানুষ তাঁর সামনে দিয়ে যেতে থাকবে আর তিনি তাদের কাওসারের পানি পান করাতে থাকবেন, যে পানি পান করলে মানুষ আর কখনও তৃষ্ণার্ত হয় না। এর মধ্যে এমন একদল মানুষ আসবে যারা কাওসারের পানি পান করতে অগ্রসর হলেও রসুলাল্লাহ (সা.) ও তাদের মধ্যে এক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হবে। তখন তিনি বলবেন, এরাতো আমার লোক অর্থাৎ আমার উম্মত। তখন বলা হবে অর্থাৎ আল্লাহ বলবেন, আপনি জানেন না আপনার পর আপনার উম্মাহর ঐসব লোক আপনি যে দীন রেখে এসেছিলেন তার মধ্যে কী কী বেদাত করেছে। এই কথা শুনে ব্যাপারটা বুঝে বিশ্বনবী (সা.) ঐ সমস্ত লোকদের বলবেন, দূর হয়ে যাও! দূর হয়ে যাও! যারা আমার পর দীনে বেদাত করেছো (হাদিস: আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বোখারি ও মুসলিম।) অর্থাৎ মহানবী (সা.) তার উম্মাহর ঐ লোকদের ভাগিয়ে দেবেন, তাদের কাওসারের পানি পান করতে দিবেন না। আল্লাহ রসুলের (সা.) মাধ্যমে যে দীন, জীবনব্যবস্থা মানবজাতিকে দিয়েছেন তা পরিপূর্ণ, তাতে কোনো কিছু নতুন সংযোজন হলো বেদাত। এই বেদাতকে, সংযোজনকে মহানবী (সা.) শেরক বলেছেন, কারণ এটা করা মানে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করা, এবং প্রকারান্তরে বলা যে আল্লাহর দীন পূর্ণ নয়। শুধু নতুন সংযোজনই যদি শেরক হয়, যে শেরক আল্লাহ প্রতিজ্ঞা করেছেন মাফ করবেন না বলে, তবে শুধু সংযোজন নয়, দীনের সর্বপ্রধান অর্থাৎ জাতীয় ভাগটিকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আইন-কানুন, দণ্ডবিধি ইত্যাদি বর্জন করে সেখানে ইউরোপের ইসলামবিদ্বেষীদের তৈরি ব্যবস্থা জীবনে প্রয়োগ করে রসুলের (সা.) ব্যক্তিগত সুন্নাহগুলো পালন করে যারা নিজেদের উম্মতে মোহাম্মদী বলে মনে করে আত্মপ্রবঞ্চনায় ডুবে আছেন তাদের কী অবস্থা হবে?
প্রত্যেক নবীর একটি করে হাউজ থাকবে এবং তারা প্রত্যেকে যার যার উম্মাহকে কেয়ামতের দিনে তা থেকে পানি পান করাবেন। আমাদের প্রিয় নবীও (সা.) তার হাউজে কাওসার থেকে তার উম্মাহকে পানি পান করাবেন। আল্লাহ যখন নবীকে (সা.) বেদাতকারীদের পানি পান করাতে বাধা দেবেন তখন বোঝা গেল তারা আর নবীর উম্মত নয়। যদিও আপাতদৃষ্টিতে তারা অবশ্যই তার উম্মত ছিল, নইলে মহানবী (সা.) প্রথমে একথা কেন বলবেন যে, ওরাতো আমার লোক, অর্থাৎ আমার উম্মত। ঐ লোকগুলো আজকের ‘উম্মতে মোহাম্মদী’। দৃশ্যতঃ এত উৎকৃষ্ট উম্মতে মোহাম্মদী যে আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ রসুল পর্যন্ত প্রায় ধোঁকায় পতিত হবেন। আল্লাহ বাধা না দিলে তো কাওসারের পানি পান করিয়েই দিতেন। বিশ্বনবী (সা.) যখন তাদের ‘দূর হয়ে যা, দূর হয়ে যা’ বলে ভাগিয়ে দিবেন তখন অবশ্যই একথা পর্রিষ্কার যে তার উম্মাহ থেকেই ভাগিয়ে দেবেন। কাপড়ে চোপড়ে, চলাফেরায়, কথাবার্তায়, খাওয়া দাওয়ায়, শোয়ায় তারা উৎকৃষ্ট সুন্নাহ পালনকারী কিন্তু আসলে বেদাত ও শেরকে নিমজ্জিত। এমন অন্তঃসারশূন্য ঠাঁটবাট বোঝাতে বাংলাদেশে প্রচলিত একটি প্রবচন হলো – উপরে ফিটফাট ভিতরে সদরঘাট। আমরা দেখি, যাত্রাপালায় অনেকেই রাজা-বাদশাহদের মতো চটকদার পোশাক পরে রাজকার্য পরিচালনা করেন, সেই রকমের সংলাপ বলেন কিন্তু বাস্তবে অভিনয় শেষে সেই পোশাক তাদের খুলে রাখতে হয়। বাস্তবজীবনে তাদের কোনো হুকুম চলে না, কোনো একটি সামাজিক সংকটের সমাধান করারও এখতিয়ার তাদের নেই। আমাদের ধর্মের ধ্বজাধারী শ্রেণিটির অবস্থা এমনটাই, যেন যাত্রাদলের রাজা-বাদশাহ। যাত্রাদলের কাঠের বন্দুকও দেখতে একদম বন্দুক, কিন্তু তা থেকে গুলি বের হয় না। মানব জাতির শ্রেষ্ঠ বিপ্লবী বিশ্বনবী মোহাম্মদকে (দ.) কাঠের বন্দুক তৈরি করার জন্য আল্লাহ পৃথিবীতে পাঠান নি। এরা নিজেদের ফাঁকি দিচ্ছেন, অন্যকে ফাঁকি দিচ্ছেন এবং কেয়ামতে আর একটু হলেই একেবারে স্বয়ং নবী করীম (সা.) কেই ফাঁকি দিয়ে ফেলেছিলেন আর কি!