মসীহ উর রহমান
ধর্ম নিয়ে যারা ব্যবসা করে, পার্থিব স্বার্থে ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ও সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে সমাজে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করে তারাই হলো ধর্মব্যবসায়ী। রসুলাল্লাহ অক্লান্ত চেষ্টা করে যে উম্মতে মোহাম্মদী জাতি গঠন করেছিলেন সেই জাতির মধ্যে আজকের মতো আলেম-মাওলানা, পীর-দরবেশ, মোহাদ্দেস, ফকীহ, মুফতি, মোফাসসের ইত্যাদি টাইটেলধারী কেউ ছিল না। জাতির প্রতিটি সদস্যই ছিল আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার জন্য নিবেদিতপ্রাণ মোজাহেদ বা যোদ্ধা। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে কিছুদিন পরেই জাতি তার মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ভুলে গিয়ে দীন প্রতিষ্ঠার জেহাদ ত্যাগ করে। এই সময় জাতির মধ্যে জন্ম নেয় দীনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণকারী তথাকথিত আলেম শ্রেণি। তারা দীনের বিধানাবলী নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ, মতভেদ ও অবিশ্রান্ত কূটতর্কে লিপ্ত হয়ে জাতিকে শত শত ফেরকায় মাজহাবে বিভক্ত করে ফেলে। এদেরই উত্তরসূরি হচ্ছেন আজকের ধর্মব্যবসায়ী আলেম-মোল্লারা। খ্রিস্টানদের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় খ্রিস্টানদের শেখানো ইসলাম শিখে সেটাকে ব্যবহার করে পার্থিব স্বার্থ হাসিল করাই এই শ্রেণির জীবনের উদ্দেশ্য। এরা সমাজের একটি পরাশ্রয়ী, পরজীবী ও পরভোজী শ্রেণি। সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে ধোঁকা দিয়ে তাদের কষ্টার্জিত ধন-সম্পদ, টাকা-পয়সা কুক্ষিগত করাই তাদের পেশা। সুরা তওবার ৩৪ নং আয়াতে আল্লাহ এই কথাটি বলেছেন যে, হে মো’মেনগণ! পণ্ডিত এবং সুফীবাদীদের মধ্যে অনেকেই মানুষের ধন অন্যায়ভাবে ভোগ করে থাকে এবং মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে নিবৃত্ত করে।’ আল্লাহর এই বাণীকে উপেক্ষা করে আমরাও প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বিশ্বাস করে আসছি যে এই আলেম শ্রেণি আল্লাহর খুব প্রিয়পাত্র। তাদেরকে খুশি রাখতে পারলে, তারা দোয়া করলে ওপারে নাজাত নিশ্চিত। তাই ধর্মপ্রাণ মানুষ এদের পেছনে অকাতরে ধন-সম্পদ ব্যয় করছে, এদের হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে ভাবছে আল্লাহর রাস্তায় দান করলাম, হাজার হাজার টাকায় তাদেরকে ভাড়া করে আনছে ওয়াজ করার জন্য, বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তুলে, মুষ্টির চাল সংগ্রহ করে মসজিদের এমাম সাহেবের বাসায় পৌঁছে দিচ্ছে। হাঁস-মুরগীর প্রথম ডিমটা, গাছের প্রথম কাঁঠালটা ‘হুজুর’-এর জন্য বরাদ্দ, কারণ তিনি যে আল্লাহর ‘খাস বান্দা’। কিন্তু আসলেই কি এই অর্থদান আখেরাতে তাদের কোনো কাজে আসবে? আসুন দেখা যাক:
(১) আমাদের কারও অজানা নেই যে, সমাজের আলেম-মাওলানা হিসেবে পরিচিত পুরোহিত শ্রেণিটি যাবতীয় ধর্মকর্ম করে থাকে অর্থের বিনিময়ে। ওয়াজ ও মিলাদ-মাহফিল, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, জুমার নামাজ, তারাবীর নামাজ, ঈদের নামাজ, জানাজার নামাজ, জিকির-আসগার, কুলখানি, বিয়ে, কোর’আন খতম ইত্যাদি ধর্মীয় কাজ বলতে আজ যা বোঝানো হয় তার কোনোটাই অর্থব্যয় ছাড়া হয় না। কিন্তু দীনের বিনিময়ে অর্থ-সম্পদ গ্রহণ আল্লাহ হারাম করেছেন। আল্লাহ বলেছেন, “আল্লাহ যে কেতাব অবতীর্ণ করেছেন যারা তা গোপন করে এবং বিনিময়ে তুচ্ছমূল্য গ্রহণ করে তারা
– নিজেদের পেটে আগুন ছাড়া কিছুই পুরে না,
– কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের সঙ্গে কথা বলবেন না,
– আল্লাহ তাদের পবিত্রও করবেন না,
– তারা ক্ষমার পরিবর্তে শাস্তি ক্রয় করেছে,
– তারা হেদায়াতের পরিবর্তে পথভ্রষ্টতা বা গোমরাহী ক্রয় করেছে,
– তারা দীন সম্পর্কে ঘোরতর মতভেদে লিপ্ত আছে
– আগুন সহ্য করতে তারা কতই না ধৈর্যশীল”। (সুরা বাকারা ১৭৪-১৭৫)
অর্থাৎ যাদেরকে সাধারণ মানুষ ধর্মের কাণ্ডারি বলে বিশ্বাস করে, ‘হুজুর’, ‘মওলানা সাহেব’ বলে তাজীম করে তারা পার্থিব জীবনেই জাহান্নামের আগুন ভক্ষণ করছে, সুতরাং তাদেরকে পোষণ ও তোষণ করলে যে জাহান্নামেই যেতে হবে সেটা বোধ করি বলার প্রয়োজন পড়ে না। তথাপি আল্লাহ বলছেন- অনুসরণ করো তাদের, যারা বিনিময় নেয় না এবং হেদায়াহপ্রাপ্ত (সুরা আল ইয়াসীন- ২১)। তাহলে যাদেরকে অনুসরণ করা অবৈধ তাদেরকে অর্থ-কড়ি প্রদান করা কীভাবে বৈধ বা পূণ্যের কাজ হতে পারে? সুতরাং নিশ্চয়ই এই ধর্মজীবী আলেম-মাওলানাদের আর্থিক সাহায্য দেওয়া মানেই হলো- আল্লাহর হুকুম অমান্য করা। যদি কেউ মানবতার খাতিরে দান করতে চান তবে এমন কাউকে দান করুন যে অন্তত ধর্মকে বিক্রি করে না। মনে রাখবেন, ধর্মব্যবসায়ীরা মানবতার শত্রু, ইসলামের শত্রু।
(২) ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করলে বা ধর্মকে পণ্যের মতো বেচা-কেনা করলে সেটা বিকৃত হবেই। পণ্যকে যেমন ক্রেতার চোখে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য আকর্ষণীয় মোড়ক ব্যবহার করা হয়, রং দেওয়া হয়, প্রয়োজনে ফর্মালিন-কার্বাইড জাতীয় বিষাক্ত কেমিক্যাল প্রয়োগ করা হয় তেমনভাবে ধর্মকে নিয়ে যখন ব্যবসা করা হয় তখন ধর্মকেও অতিরঞ্জিত করা হয়। ধর্মকেও একেকজন ক্রেতার কাছে একেকরূপে ক্রেতার রুচিমাফিক রঙ-রস দিয়ে উপস্থাপন করা হয়। ঠিক এই প্রক্রিয়াতেই ধর্মজীবীরা যুগে যুগে স্থান-কাল-পাত্রভেদে দীনের যোগ-বিয়োগ করেছেন, গুরুত্বের ওলট-পালট করেছেন। আর সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ এই ধর্ম বিকৃত-কারীদেরকেই নবী-রসুলের উত্তরসূরি জ্ঞান করে সম্মানের স্থানে বসিয়েছে। নিজেরা না খেয়ে থেকে তাদেরকে অর্থ-সম্পদের পাহাড় গড়ে দিয়েছে। এভাবে সাধারণ মানুষ যুগে যুগে ধর্মজীবীদের দ্বারা প্রতারিত হয়েছে।
(৩) রসুলাল্লাহ কঠিন সংগ্রাম করে একটি জাতি গঠন করেছিলেন। সেই জাতির নেতা ছিল একজন, লক্ষ্যও ছিল মাত্র একটি। ইতিহাস সাক্ষী যতদিন সেই জাতি তাদের ঐক্যকে ধরে রেখেছিল ততদিন তাদের সামনে কোনো শক্তি দাঁড়াতে পারে নি। তারা সরল-সঠিক পথের অনুসারী ছিলেন। কিন্তু যখনই জাতির মধ্যে ধর্মজীবীদের আবির্ভাব ঘোটল, ধর্ম নিয়ে অতি বিশ্লেষণ শুরু হলো তখনই মতভেদ হয়ে জাতি বিভক্ত হয়ে গেল। জন্ম হলো শিয়া-সুন্নী, হাম্বলী, মালেকী, আহলে হাদিস, ওয়াহাবী, হানাফী, শাফেয়ী, পীর-ফকীর, দরবেশ ইত্যাদির। এদের এক এক ফেরকার আকিদা এক এক রকম। এই ফেরকাগুলোতে অনুসারীরও কোনো অভাব নেই। যেটা তর্ক-বিতর্কের কোনো বিষয়ই নয়, দেখা যাচ্ছে সেটাকে বিশ্লেষণ-অতি বিশ্লেষণ করে জাতি শুধু যে বিভক্তই হয়েছে তাই নয়, নিজেরা নিজেরা মারামারি, হানাহানি, রক্তপাত ঘটাচ্ছে। এই ফেরকা মাজহাব কি সাধারণ মানুষেরা সৃষ্টি করেছে নাকি ধর্মের লেবাসধারী আলেম-ওলামারা সৃষ্টি করেছেন? এর উত্তর সবাই জানেন। যখন থেকে ধর্মজীবীদের আবির্ভাব ঘটেছে তখন থেকেই মুসলিম জাতির মধ্যে বিভক্তি ও পরিণামে অধঃপতন শুরু হয়েছে। আর এই পতনের ধারবাহিকতায় তারা আজ অন্য জাতির দাসত্ব করে যাচ্ছে। এতকিছুর পরও এই ১৬০ কোটির মুসলিম জনসংখ্যার ঘুম ভাঙে নি। তারা এখনও টাকা-পয়সা খরচ করে ওয়াজকারী ভাড়া করে আনছে, পীরের দরবারে সোনা-দানা দিয়ে আসছে। তারা বুঝতে পারছে না যে, এই অর্থ সম্পদ তাদেরই জাহান্নামের ইন্ধন হবে।
(৪) ধর্মজীবীরা তাদের স্বার্থের পথে বিঘ্ন সৃষ্টিকারীকে নাজেহাল করার জন্য ধর্মকে অপব্যবহার করে। যখনই কেউ তাদের মিথ্যার মুখোস খুলে দিতে চায়, এদের অবৈধ কর্মকাণ্ডগুলির প্রতিবাদ করে তখনই তারা ঐ লোকের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিতে শুরু করে। পরিবেশ বুঝে যখন যাকে ইচ্ছা নাস্তিক, কাফের, মুরতাদ ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে মানুষকে সহিংসতা দাঙ্গা-ফাসাদে লিপ্ত করে।
আমরা চাই, ধর্মের নামে এই অরাজকতা ও যথেচ্ছাচার বন্ধ হোক, ধর্মকে ব্যক্তি বা গোষ্ঠির স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার না করে একে মানবতার কল্যাণে ব্যবহার করা হোক। এজন্য সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। সমাজের যারা সওয়াবের আশায় ধর্মব্যবসায়ীদেরকে পৃষ্ঠপোষণ করছেন তারা নিজেরা অন্যায়ের প্রশ্রয়দাতা। অন্যায়ের প্রশ্রয় দিলে তার পরিণতিও ভোগ করতে হয়। চোর, ডাকাত, সুদখোর, ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজকে প্রশ্রয় দেওয়া যদি অন্যায় হয় তবে ধর্মব্যবসাকে প্রশ্রয় দেওয়া তার চেয়ে বড় অন্যায়।