হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

ধর্মব্যবসায়ীদের মূল অপরাধ কী?

ডা. মাকসুদে মওলা

পবিত্র কোর’আনে মহান আল্লাহ স্পষ্টভাষায় স্বার্থের বিনিময়ে ধর্মের কাজ করাকে হারাম ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন, “তোমরা কেতাবের প্রাথমিক অস্বীকারকারী হয়ো না আর তুচ্ছ মূল্যে আমার আয়াতগুলো বিক্রি কোরো না এবং আমার থেকে বাঁচ। তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে দিও না এবং জেনে শুনে সত্য গোপন কোরো না (সুরা বাকারা ৪১, ৪২)।” তিনি নিষেধ করেই ক্ষান্ত হননি, যারা এই কাজ করবে তাদের পরিণামও উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, “যারা আল্লাহ কিতাবে যা অবতীর্ণ করেছেন তা গোপন করে এবং তার বিনিময়ে পার্থিব তুচ্ছমূল্য গ্রহণ করে তারা নিজেদের পেটে আগুন ছাড়া আর কিছুই ঢুকায় না এবং হাশরের দিন আল্লাহ তাদের সাথে কথা বলবেন না, তাদেরকে পবিত্রও করবেন না। এদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আজাব (সুরা বাকারা ১৭৪)।”

এছাড়াও তিনি তাঁর প্রেরিত নবী রসুলদের উদ্দেশেও একই নির্দেশ প্রদান করেছেন, “তুমি তাদের নিকট কোনো মজুরি দাবি কোরো না। এই বাণী তো বিশ্বজগতের জন্য উপদেশ মাত্র (সুরা ইউসুফ ১০৪)।” “বল! আমি এর জন্য তোমাদের নিকট কোনো পারিশ্রমিক চাই না এবং যারা মিথ্যা দাবি করে আমি তাদের দলভুক্ত নই (সুরা সা’দ ৮৬)।” কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও প্রতিটি যুগে যুগে ধর্মজীবি, ধর্মব্যবসায়ীদের আবির্ভাব ঘটেছে। তারা আল্লাহপ্রদত্ত সহজ সরল দীনকে নিজেদের ইচ্ছে মতো কুক্ষিগত করে, বিকৃত করে তাদের স্বার্থ হাসিল করে গিয়েছে।

আমাদের বর্তমান সমাজেও এক শ্রেণীর আলেম রয়েছেন যারা ধর্মকেই উপার্জনের মাধ্যম বানিয়ে নিয়েছেন। এরা ক্রেতার চাহিদা মোতাবেক ওয়াজ করে থাকেন, নামাজ পড়িয়ে, মুর্দা দাফন করে, মিলাদ পড়িয়ে ইত্যাদি ধর্মীয় নানাবিধ আনুষ্ঠানিক কাজের বিনিময়ে স্বার্থ-অর্থ গ্রহণ করেন। তারা হারাম উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করেন কিন্তু অন্যকে হালাল উপার্জনের জন্য নসিহত করেন। এখন ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে কেউ অবস্থান নিলে তারা ধর্মান্ধ জনগণকে ভুল বুঝিয়ে ধর্মব্যবসাকে জায়েজ করতে চান এবং প্রতিবাদকারীর বিরুদ্ধে জনগণকে উসকে দিয়ে তার কণ্ঠরোধ করতে চান। ধর্মব্যবসা হারাম জেনেও অনেকে এই কথিত আলেমদের প্রতি সহানুভূতিপ্রবণ হয়ে বলেন, তাহলে তারা খাবে কী, সংসার চলবে কীভাবে? আর একজন আলেম কত টাকাই বা বেতন পান যে তাদের এই জীবিকার বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে? দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তারা তো কতটাকাই অবৈধ রোজগার করে যাচ্ছেন ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিন্তু ধর্মব্যবসা নিছক দুর্নীতি বা চুরি-ডাকাতি, হত্যাকাণ্ডের মতো ফৌজদারি অপরাধ নয়। মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ ও সততা বিনষ্ট করে দেওয়া কোনো ফৌজদারি অপরাধ না হলেও তা একজন মানুষকে হত্যা করার চেয়ে বড় অপরাধ নয় কি? তেমনি ধর্মব্যবসা কোনো নির্দিষ্ট জাতির জন্য নয় বরং, সমগ্র মানবজাতির জন্য অভিশাপ। এর ফলে মানবজাতি স্রষ্টা প্রদত্ত সবচেয়ে বড় নেয়ামত সত্যদীন যা শান্তি আসার একমাত্র পথ তা থেকে বঞ্চিত হয়। বর্তমানেও তাই হচ্ছে। যারা ধর্মব্যবসায়ীদের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন তারা ধর্মব্যবসার কুফল অনুধাবন করতে পারছেন না বলেই এটা করছেন।

ধর্মব্যবসায়ীরা মূলত যে ক্ষতিটি করছে সেটি হচ্ছে এরা মানুষকে আল্লাহর হকুম থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। আল্লাহর হুকুমের মধ্যেই রয়েছে শান্তি কিন্তু এর ফলে মানুষ শান্তির পথ থেকে দূরে সরে গিয়ে বর্তমানের অশান্তিতেপূর্ণ সমাজব্যবস্থায় পতিত হয়েছে। মানুষ তাদের কথা অনুযায়ী নামাজ পড়ছে, সওম পালন করছে, হজ করছে, যাকাত দিচ্ছে আর আত্মপ্রসাদ লাভ করছে যে তারা মো’মেন মুসলিম। তাদের আমলনামা ভারী হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি মোটেও তা নয়। এই ধর্মব্যবসায়ীরা গুরুত্বপূর্ণ একটি সত্য গোপন করেই চলেছে। পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ বলেছেন, “যারা আল্লাহর হুকুম দিয়ে বিচার, ফয়সালা করে না তারা কাফের, জালেম, ফাসেক (সুরা মায়েদা ৪৪, ৪৫, ৪৭)।” ধর্মব্যবসায়ীরা সাধারণ জনগণের কাছে এই বিয়টিই গোপন করেছে যে বর্তমানে যখন গোটা দুনিয়ায় আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠিত নেই। দুনিয়াটা চলছে দাজ্জাল তথা ইহুদি খ্রিষ্টান বস্তুবাদী যান্ত্রিক সভ্যতার তৈরি হুকুম দিয়ে। ফলে আল্লাহর আয়াত মোতাবেক এই জাতিসহ সমগ্র মানবজাতি কার্যত কাফের, জালেম ও ফাসেক হয়ে আছে। এই সত্যকে গোপন করার দরুন তারা নিজেরা কুফর করছে, নিজেরা জাহান্নামের আগুন ভক্ষণ করছে এবং মানুষকেও জাহান্নামের দিকে ধাবিত করছে।

মুসলিম জাতি আমল করে করে আমলের পাহাড় গড়ে তুলেছে কিন্তু তারা আদৌ মো’মেন না। আল্লাহ প্রতিটি আমলের নির্দেশ দিয়েছেন মো’মেনদের জন্য। ধর্মব্যবসায়ীরা মানুষকে এই মো’মেন হওয়ার পথ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। এমনকি তারা সাধারণ মানুষের সামনে এই সত্য তুলেও ধরে না। এর কারণ পাছে তাদের জীবিকা বন্ধ হয়ে যায়, তাদের স্বার্থদ্ধোরের পথ বন্ধ হয়ে যায়। তারা মানুষকে জান্নাতে যাওয়ার পথ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। মো’মেনের সংজ্ঞা আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে বলেছেন, “তারাই মো’মেন যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের উপর ঈমান আনে এবং কোনো রূপ সন্দেহ পোষণ না করে নিজেদের জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ (সর্বাত্মক সংগ্রাম) করে (সুরা হুজরাত ১৫)।”

বর্তমানের এই ধর্মব্যবসায়ী আলেম সমাজ আল্লাহর হুকুম না মেনেই নিজেদের ধর্মের ঠিকাদার হিসেবে পরিচয় দেয় এবং নিজেরাই ধর্মের প্রতিটি বিষয়ে মনগড়া ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ প্রদান করে। এরাই সমাজে ফেতনা সৃষ্টি করে যে ফেতনাকে আল্লাহ হত্যা থেকেও জঘন্য বলে উল্লেখ করেছেন (সুরা বাকারা ১৯১)। আল্লাহ এ সকল ধর্মব্যবসায়ী আলেমদের চিহ্নিত করে দিয়েছেন কিন্তু তারা এই সকল আয়াত গোপন করে নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য। পবিত্র কোর’আনে রয়েছে, “তাদের মধ্যে একদল রয়েছে, যারা বিকৃত উচ্চারণে মুখ বাঁকিয়ে কিতাব পাঠ করে, যাতে তোমরা মনে কর যে, তারা কেতাব থেকেই পাঠ করছে। অথচ তারা যা তেলাওয়াত করছে তা আদৌ কেতাব নয়। এবং তারা বলে যে, এসব কথা আল্লাহর তরফ থেকে আগত। অথচ এসব আল্লাহর তরফ থেকে প্রেরিত নয়। তারা বলে যে, এটি আল্লাহর কথা অথচ এসব আল­াহর কথা নয়। আর তারা জেনে শুনে আল্লাহরই প্রতি মিথ্যারোপ করে (সুরা ইমরান ৭৮)।” আল্লাহ এত স্পষ্ট করে ধর্মজীবি ওয়াজেনদের মুখোশ খুলে দেবার পর আর কিছুই বলার থাকে না।

সাধারণ জনগণকে এখন বুঝতে হবে ধর্মব্যবসায়ী আলেমরা শুধু আমাদের সমাজ নয় গোটা মানবজাতির জন্য ভাইরাসতুল্য। তাদের প্রশ্ন তুলতে হবে, এই ধর্মব্যবসায়ীরা কীসের উপর ভিত্তি করে নিজেদেরকে ধর্মের কর্তৃপক্ষ হিসেবে দাবি করে? কীভাবে তারা ব্রিটিশদের প্রণিত হুকুমকে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে প্রতিষ্ঠিত রেখে নিজেদের মো’মেন মুসলিম দাবি করে? কীভাবে তারা সাধারণ জনগণকে জান্নাতের সার্টিফিকেট দেয়? কে তাদের সার্টিফিকেট দেয়ার অধিকার দিল যে বর্তমানে মুসলিম জাতি আল্লাহর হুকুম বাদ দেয়া সত্ত্বেও ঠিক পথে রয়েছে? বর্তমানের এই জাতি মুসলিম, জাতি মো’মেন, উম্মতে মোহাম্মদী? সাধারণ মানুষদের এই বিষয়গুলো চিন্তা করতে হবে।

আমরা এই প্রশ্নগুলি করতে পারি না। যখনই কেউ এই প্রশ্নগুলো তুলে তখনই তাকে ফেতনাবাজ, ইহুদি-খ্রিষ্টানের এজেন্ট, মুনাফেক, কাফের, বেদাতি, ভ্রান্ত আকিদায় বিশ্বাসী, ফেরকায়ে বাতেলা ইত্যাদি গতবাঁধা কিছু অপবাদ আরোপ করে দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তারা এই সকল প্রশ্ন উঠার সম্ভাবনা দেখলেই আগুনে ছাই ঢেলে দেয়। প্রকৃতপক্ষে এর কারণ হচ্ছে সম্পূর্ণ মিথ্যার উপর ভিত্তি করে তাদের ব্যবসা ও জীবনজীবিকা দাঁড়িয়ে আছে। মানুষ তাদের লেবাস দেখে আর আরবি বুলি শুনে ভক্তি করে, এটুকুই তাদের ভরসা। শত শত বছর ধরে তারা সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অন্নদাস হয়ে আছে। গোলামিতে তারা সিদ্ধিলাভ করেছে। তাই এখন আর গোলামি ছাড়া জীবিকার ভিন্নপথ নিয়ে ভাবতে তারা প্রস্তুত নয়। এখন ধর্মব্যবসা টিকিয়ে রাখতেই হবে, নয়তো অস্তিত্ব হারাতে হবে। আদতে ইসলামের কোথাও এমন একটি বিশেষ শ্রেণির কোনো ধারণা ছিল না যারা মূল জনগোষ্ঠীকে দীন শিক্ষা দিয়ে, ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করবে আর জনগণ ধর্ম সম্পর্কে থাকবে অজ্ঞ-মূর্খ পরনির্ভরশীল। ইসলামের দৃষ্টিতে প্রত্যেক মোমেনই জ্ঞানী তথা আলেম। কারণ তারা সত্য ও মিথ্যার প্রভেদ করতে পারবেন। ন্যায় ও অন্যায়ের প্রভেদ করা এবং গোটা মানবজাতির সামনে সেটা উপস্থাপন করাই মো’মেন, মুসলিম, উম্মতে মোহাম্মদীর কাজ। আলাদা করে নির্দিষ্ট লেবাসধারী ধর্মের ঠিকাদারের কোনো প্রয়োজন ইসলামে নেই। পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ বলেছেন, “তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, মানবজাতির মধ্যে থেকে তোমাদের উত্থান ঘটানো হয়েছে। তোমরা সৎ কাজে আদেশ দান করবে এবং অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখবে এবং আল্লাহ উপর সর্বদা ঈমান রাখবে (সুরা ইমরান ১১০)।”

অতএব এখন আমাদের প্রশ্ন করা শিখতে হবে, শিখতে হবে কোনটা ন্যায় ও কোনটা অন্যায়। শিখতে হবে, জানতে হবে। আমরা কার হুকুম মানছি সে ব্যাপারে সচেতন হওয়াটা অত্যন্ত জরুরি। আল্লাহকে বাদ দিয়ে আমরা যখন ইহুদি খ্রিষ্টান ‘সভ্যতা’ অর্থাৎ দাজ্জালের হুকুম মানছি তখন আমরা নিজেদের মুসলিম বলে দাবি করতে পারি না। কাজেই ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে সরব হন, ধর্মব্যবসা বন্ধ করাটা হবে দাজ্জালের এক বিরাট পরাজয়। ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ এখন অত্যাবশ্যক।

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...