রাকীব আল হাসান
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সরকারগুলোর মানসিকতা পশ্চিমা ধর্মহীন সমাজের সরকারগুলোর মতো হলে চলবে না। মনে রাখতে হবে- তারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন এমন একটি জনগোষ্ঠীকে, হাজার হাজার বছর ধরে যারা ধর্ম দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে, যাদের একটি অপরিবর্তিত ধর্মগ্রন্থ আছে, গৌরবগাঁথা ধর্মীয় ইতিহাস আছে, মহাবিপ্লব সৃষ্টিকারী একজন মহামানবের প্রচণ্ড গতিশীল জীবনের দৃষ্টান্ত আছে। তাদেরকে একটি মৌলিক ও গুরুতর প্রশ্নের সুস্পষ্ট মীমাংসা করতে হবে যে, ধর্মকে, কোর’আনকে কী করা হবে? ধর্মকে কি মুছে ফেলা হবে? তা সম্ভব নয়। গত কয়েক শতাব্দী ধরে ইউরোপীয় ধর্মহীন বস্তুবাদী সভ্যতার শিক্ষাব্যবস্থা, গণমাধ্যম, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, প্রচার মাধ্যমে বহু চেষ্টা হয়েছে ধর্মকে নির্মূল করে ফেলার। কিন্তু সফল না হবার কারণ:
১. স্রষ্টার রূহ: মানুষের ভেতরে স্রষ্টার রূহ অর্থাৎ পরমাত্মার অংশ রয়েছে। সে অবচেতন মনেই আপন স্রষ্টাকে অনুভব করে, যে কোনো কষ্টে, সংকটে তাঁর কাছে আশ্রয় চায়।
২. ধর্মগ্রন্থে সত্যের পরিচয়লাভ: আল্লাহর নাজেলকৃত ধর্মগ্রন্থগুলো এখনও মানুষের কাছে আছে যেগুলো স্রষ্টার অস্তিত্বের স্বাক্ষর বহন করছে। মানুষ সেগুলো ভক্তির সঙ্গে পড়ছে, জানছে, বিচার বিশ্লেষণ করছে। সেগুলোর মধ্যে সত্য খুঁজে পাচ্ছে, যা তাদের হৃদয়কে প্রশান্তিতে ভরে তুলছে, তাদের আত্মার গভীরে প্রভাব ফেলছে। সুতরাং ধর্মগ্রন্থগুলোই ধর্মের রক্ষাকবচ, এমতাবস্থায় মানবজাতিকে ধর্মহীন করে ফেলার চেষ্টা হবে অপ্রাকৃতিক, বাস্তবতা-বিবর্জিত, অমূলক চিন্তা।
৩. শান্তিময় অতীত ও ভবিষ্যদ্বাণী: অতীতে হাজার হাজার বছর মানুষকে শান্তি দিয়েছে ধর্ম। সেই অনুপম শান্তির স্মৃতি কিংবদন্তির ন্যায় বংশ পরম্পরায় প্রতিটি সমাজে সভ্যতায় বিরাজিত আছে, ইতিহাসের পাতা থেকে বাদ দিলেও লাভ নেই। সময়ের সেই বিশাল ব্যাপ্তির তুলনায় গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ, পুঁজিবাদ ইত্যাদি ব্যবস্থাগুলো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র এবং এগুলোর অভিজ্ঞতাও শান্তিময় নয়। অধিকাংশ মানুষ এখনও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে একমাত্র স্রষ্টার বিধানেই শান্তি আসা সম্ভব। কাজেই যুগের হাওয়া তাদেরকে যতই অন্য দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুক, প্রচলিত ব্যবস্থাগুলোতে শান্তি না পেয়ে তারা ধর্মের দিকেই মুখ ফেরায়। উপরন্তু প্রতিটি ধর্মগ্রন্থেই ভবিষ্যদ্বাণী আছে যে, আবার ন্যায়ের শাসনে শান্তি ফিরে আসবে। এই বিশ্বাস থেকে অধিকাংশ মানুষ সত্য ধর্মের উত্থানই কামনা করে।
৪. ইসলামে জাতীয় জীবনবিধান রয়েছে: ইসলামের সঙ্গে খ্রিষ্টধর্মের বড় একটি তফাৎ হলো ইসলামের জাতীয় জীবন পরিচালনার ব্যবস্থা রয়েছে। তাই মুসলিমদের মধ্যে জাতীয় জীবনে ইসলামের বিধান প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা সব সময়ই হয়ে আসছে, এটা খুবই স্বাভাবিক। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে তাই ধর্মকে বাদ দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা সর্বতোভাবে স্বীকৃত হবে না যেটা ইউরোপ আমেরিকায় সম্ভব হয়েছে।
কাজেই ধর্মকে জাতীয় জীবন থেকে বাদ দেওয়ার চিন্তা পরিহার করে কীভাবে তা ইতিবাচক পথে ব্যবহার করা যায়, দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজে লাগানো যায় অর্থাৎ রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের সমন্বয় কিভাবে করা যায় সেটা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। আর যদি ধর্মকে অবজ্ঞা করে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়, তাহলে মানুষের ধর্মবিশ্বাস বার বার স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী দ্বারা ভুল খাতে প্রবাহিত হয়ে জঙ্গিবাদ, ধর্মভিত্তিক অপরাজনীতি, ধর্মব্যবসা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, উন্মাদনা ইত্যাদি সৃষ্টি হয়ে জাতিবিনাশী কাজে ব্যবহৃত হতেই থাকবে। সবখানে বলি হবে সাধারণ নিরীহ নির্দোষ মানুষ।
এখানে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক- ইসলামের নামে বর্তমানে যে অন্ধত্ব ও কূপমণ্ডূকতা এই জাতির উপর চেপে বসেছে, ধর্মের নামে সেই অন্ধত্ব ও কূপমণ্ডূকতাকেই কি রাষ্ট্র গ্রহণ করে নিবে? না, আমাদের কথা সেটা নয়। প্রকৃত ইসলামে পশ্চাপদতার স্থান নেই, অন্ধত্বের স্থান নেই। যে কোর’আন একদিন জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-দীক্ষা, সামরিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতায় এই জাতিকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়েছিল সেই কোর’আন কখনও পশ্চাদপদতা, কূপমণ্ডূকতা, কুসংস্কার ও অন্ধত্ব শিক্ষা দিতে পারে না।
আবার ইসলামের যত রূপ দাঁড়িয়ে গেছে রাষ্ট্র এর মধ্যে কোনটা গ্রহণ করবে তাও বিরাট প্রশ্ন। আমাদের কথা হচ্ছে, ইসলামের প্রকৃত আদর্শকে গ্রহণ করতে হবে। আর সেই আদর্শটি দিতে প্রস্তুত হেযবুত তওহীদ। সরকার যখন আহ্বান করছে দলমত নির্বিশেষে সবাই মিলে এগিয়ে আসার জন্য, তখন আমরা জাতির কল্যাণে এগিয়ে এসেছি, কাজ করে যাচ্ছি। আমরা গত একুশ বছর ধর্মের নামে চলা যাবতীয় অধর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার রয়েছি। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মাঠ পর্যায়ে আদর্শিক লড়াই করার অভিজ্ঞতাও আমাদের রয়েছে।
জঙ্গিবাদে আক্রান্ত হয়েছিল আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাক ইত্যাদি দেশ। সে দেশগুলো এখন ধ্বংসস্ত‚পে পরিণত হয়েছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গেছে, কোটি কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বাংলাদেশেও জঙ্গিবাদ হানা দিয়েছে, এই জঙ্গিবাদকে মোকাবেলা করার জন্য বাংলাদেশকে কথিত ‘সহযোগিতা’ প্রদান করতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক ও পাশ্চাত্যের পরাশক্তিধর সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো। আমরা বলতে চাই, বাংলাদেশের সঙ্গে ঐ ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেশগুলোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হচ্ছে, এখানে মহান আল্লাহ এই জঙ্গিবাদের সঠিক সমাধান ও কার্যকরী আদর্শ প্রদান করেছেন যা দিয়ে আমরা এই অপশক্তিকে রুখে দিতে পারি। সেই আদর্শের বলে বলীয়ান হয়ে ইনশা’আল্লাহ ১৬ কোটি মানুষ যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, অসত্যের বিরুদ্ধে ইস্পাতকঠিন ঐক্যপ্রাচীর গড়ে তুলে জাতিকে অশুভশক্তির কবল থেকে রক্ষা করবে।
লেখক: সহকারী সাহিত্য সম্পাদক, হেযবুত তওহীদ