বর্তমান বৈশ্বিক প্রেড়্গাপটে ধর্মকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই কেননা বিশ্বরাজনীতিতে ধর্ম এখন প্রধান নিয়ামক, এক নম্বর বিচার্য বিষয়। ধর্ম থেকেই সৃষ্ট জঙ্গিবাদ যা বর্তমানের মানবজাতির ক্যান্সার হিসাবে বিবেচিত, ভোটের রাজনীতিতে ডানপন্থী ও রড়্গণশীল দলগুলোর প্রধান হাতিয়ারও সেই ধর্ম। পৃথিবীর বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পালে দমকা হাওয়া লেগেছে যা সেক্যুলার দলগুলোর জন্য প্রধান সংকট বলে মনে করা হচ্ছে। এমনকি বামপন্থীরা ইদানীং ধর্মব্যবসায়ীদেরকে সমীহ করতে ও নিজেদেরকে ধার্মিক প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগেছেন। পড়্গাšত্মরে পশ্চিমা বস্তুবাদী ধ্যানধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ধর্মকে একেবারে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রীয় জীবন পরিচালনা করার যে চিšত্মা ও চেষ্টা করা হয়ে থাকে সেটা বা¯ত্মবমুখী নয়, কারণ পৃথিবীতে গুটিকয় না¯িত্মক ছাড়া আর সকলেই স্রষ্টার অ¯িত্মত্বে, কোনো না কোনো ধর্মে এবং পরকালীন জীবনে বিশ্বাস রাখে। তাদের এ বিশ্বাস হৃদয়ের গহীনে গ্রথিত হয়ে আছে, অস্থি-মজ্জায় মিশে আছে যা প্রতিনিয়ত তাদের চিšত্মা-চেতনা ও কার্যকলাপে প্রভাব বি¯ত্মার করে। সুতরাং ধর্মকে জাতীয় জীবন থেকে বাদ দিয়ে ব্যক্তিজীবনে নির্বাসিত করে রাখার চিšত্মা করা ভুল। রাষ্ট্রের প্রথম উপাদান হচ্ছে মানুষ, সেই মানুষের চিšত্মা চেতনা ও বিশ্বাসকে গুরম্নত্বহীন মনে করা বা একেবারে বাদ দিয়ে রাষ্ট্র চালানোর পথ হঠকারিতা ছাড়া আর কিছু নয়।
আবার যাদের হাতে ধর্মের কর্তৃত্ব অর্থাৎ ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণি তাদের হাতে রাষ্ট্রশক্তি তুলে দেওয়ারও কোনো সঙ্গত কারণ নেই কেননা তাদের হাতে রাষ্ট্রশক্তি গেলে সেখানে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ভয়াবহ রূপ নেবে, বিকৃত ধর্মের কারণে মানুষ অন্ধত্ব, পশ্চাৎপদতার গহীনে নিমজ্জিত হবে। এক কথায় আরেকটি মোলস্নাতান্ত্রিক তালেবানি রাষ্ট্র কায়েম হবে যা সাধারণ মানুষের কাম্য নয়। ডানপন্থী রাজনীতি, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির যে জোয়ার বিশ্বময় দেখা যাচ্ছে তাতে এমন ঘটার আশঙ্কা আমাদের দেশেও আছে। এখন সিদ্ধাšত্ম নিতে হবে যে, ধর্ম বিষয়ে রাষ্ট্রের নীতি কী হবে? এক কথায় এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে: যুগে যুগে ধর্ম এসেছে মানবতার কল্যাণে, তাই ধর্মকে মানুষের কল্যাণেই কাজে লাগাতে হবে। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য মানুষের কল্যাণ, ধর্মকেও যদি আমরা একই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করি তাহলে ধর্ম ও রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব ঘুঁচে যাবে, ধর্ম ও রাষ্ট্র হাত ধরে পথ চলবে এবং স্বভাবতই মানবজাতির সকল অন্যায় অশাšিত্মর সমাধান হয়ে যাবে। সর্বপ্রথম পাঠককে মনে করিয়ে দিচ্ছি যে, প্রচলিত ধর্মগুলোই মানুষের জীবনে অনেকাংশে অশাšিত্মর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এর কারণ এগুলো শত-সহস্র বছর ধরে বিকৃত হতে হতে বর্তমানের রূপ ধারণ করেছে এবং সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় সেগুলোকে পুঁজি করে বিভিন্ন শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ীরা বিভিন্ন প্রকার ফায়দা হাসিল করছে। ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণির স্বার্থের হাতিয়ারে পরিণত না হলে ধর্ম থেকে মানুষ আজও প্রভূত কল্যাণ লাভ করত। বর্তমান বা¯ত্মবতা হচ্ছে এক শ্রেণির ধর্মাশ্রয়ীর দ্বারা ধর্ম এখন মানুষের সামষ্টিক জীবনে কল্যাণের চেয়ে ধ্বংসই সাধন করছে বেশি। তাছাড়া বর্তমান জীবনব্যবস্থায় ধর্মকে যেভাবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তথাকথিত ভাব-গাম্ভীর্য আরোপ করে উপাসনা, পরলোকগত নেতাদের কবর জেয়ারত ও কোর’আন খানি, ঈদ, পূজা-পার্বনে বাণী দেওয়া, উপাসনালয় পরিদর্শন করা, হজ্ব-তাওয়াফ, চেহলাম, অনুষ্ঠানের শুরম্নতে তেলাওয়াত ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে সেখান থেকে উঠে এসে মানবসমাজে কল্যাণকর ভূমিকা রাখার কোনো সুযোগ ধর্মের নেই। আর ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মের সঙ্গে কেবল আখেরাতের যোগাযোগ, পার্থিব জীবনের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই, এভাবে ধর্মকে গুরম্নত্বহীন করে রাখা হলেও ইতিহাসের পাতায় দৃষ্টি দিলে আমরা দেখতে পাই ধর্মব্যবসায়ী ও ধর্মকে অপব্যবহারকারী রাজনীতিকরা মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে যুগে যুগে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে এসেছে। ধর্মের দোহাই দিয়ে কোটি কোটি মানুষ হত্যাকেও বৈধ করে ফেলা হয়েছে। এক সম্প্রদায়কে আরেক সম্প্রদায়ের বিরম্নদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে, ধর্মের নামে গণহত্যা, গণধর্ষণ, সর্বস্বপহরণ করা হয়েছে।
এখন এ থেকে বাঁচার উপায় হচ্ছে ধর্মকে বাদ দেওয়া যাবে না, অবজ্ঞাও করা যাবে না বরং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাসকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে হবে। ধর্মীয় উন্মাদনা থেকেই জঙ্গিবাদের সূচনা হয়। জঙ্গিবাদ ও অপরাজনীতির ভয়াবহ পরিণাম আমরা দীর্ঘদিন যাবৎ দেখে আসছি, নিকট অতীতেও (২০১৩) দেখেছি। ভবিষ্যতে যেন আমাদের দেশে আবারও কোনো প্রকার ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণি ধর্মের নামে উন্মাদনা সৃষ্টি করে জননিরাপত্তা ও দেশকে হুমকির মুখে ফেলতে না পারে, তাই যত দ্রম্নত সম্ভব ধর্মের এই অপব্যবহারের দ্বার রম্নদ্ধ করা উচিত। অতীতে দেখা গেছে- সরকার বা সংশিস্নষ্ট কর্তৃপড়্গ বিষয়টির যথাযথ গুরম্নত্ব অনুধাবন করেন নি, তারা ব্যাটন ও বুলেটের দ্বারা সব সমস্যার সমাধান করে ফেলবেন এমন মনোভাবই প্রদর্শন করেছেন। তারা ধর্মব্যবসায়ীদের দ্বারা প্ররোচিত বৃহত্তর জনসংখ্যার ঈমানকে খাটো করে দেখেছেন, অবজ্ঞা করেছেন।
ফল হয়েছে এই যে, ধর্মব্যবসায়ীরা দেশজুড়ে এমন অরাজক পরিস্থিতি, অচলাবস্থা ও গৃহযুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি করতে সড়্গম হয়েছে যা বিশ্বময় সমালোচনার ঝড় তুলে দিয়েছে এবং এদেশের মানুষকে মৌলবাদী, উগ্রবাদী হিসাবে চিত্রিত করেছে, পাশাপাশি জনজীবনকে অসহনীয় দুর্ভোগের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। তাই এ ধারণা করা বিরাট বড় ভুল যে, সাধারণ মানুষ অশিড়্গতি, কূপম-ূক, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, মান্ধাতার আমলের বাসিন্দা। তাদের সেন্টিমেন্টকে খাটো করে দেখলে বিপর্যয় সৃষ্টির সম্ভাবনা থেকেই যাবে। ধর্মীয় অনুভূতির চাবি আর কোনোভাবেই স্বার্থান্বেষী ধর্মব্যবসায়ীদের হাতে রাখা যাবে না। রাখলে সিরিয়া, মিশর, ফিলি¯িত্মন, আলজেরিয়া, তিউনেশিয়া, আফগানি¯ত্মান, পাকি¯ত্মান ইত্যাদি দেশগুলোতে যা হচ্ছে সেটা এখানেও হবে, আজ নয়তো কাল এবং এই আশঙ্কা থেকেই যাবে।
কিছুদিন আগেও আমাদের দেশে জুমার দিনে মসজিদগুলোতে পাহারা দিতে গিয়ে গলদঘর্ম হতে হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রড়্গাকারী বাহিনীকে- এ পরিস্থিতি ভুল গেলে চলবে না। কিন্তু মানুষের ঈমানকে সঠিকপথে পরিচালিত করা হলে তখন আইন-শৃঙ্খলা রড়্গাকারী বাহিনীকে দিয়ে মসজিদের মুসুলিস্নদের পাহারা দিতে হবে না, বরং মুসুলিস্নরাই বিনে পয়সায় আত¥া থেকে দেশ ও দেশের সম্পদ পাহারা দেবে। যেমন কোনো একটি কাজ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় করা যদি অসম্ভবও হয়ে দাঁড়ায়, আপামর জনতা যদি তাদের ধর্মবিশ্বাস থেকে সেটা করতে উদ্যোগী হয় তাহলে রাষ্ট্রের বিনা খরচে খুব সহজেই করা সম্ভব। ধরম্নন, সরকার সিদ্ধাšত্ম নিল যে, প্রতিটি গ্রামে হতদরিদ্র, অড়্গম মানুষদের জন্য একটি করে পাকা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। ৮৫ হাজার আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করতে সরকারকে বিরাট বাজেট বরাদ্দ করতে হবে, অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে, বৈঠকের পর বৈঠক করতে হবে, বিদেশীদের কাছে সাহায্যের জন্য হাত পাততে হবে, ট্যাক্স বাড়াতে হবে, টেন্ডার দিতে হবে, সেখানে দুর্নীতি হবে, টেন্ডারবাজদের মধ্যে মারামারি হবে। এক কথায় সরকারের উপর বিরাট একটা চাপের সৃষ্টি হবে। ফলে এ উদ্যোগ হয়তো আদৌ বা¯ত্মবায়ন করা সম্ভব হবে না। আর যদিও বা হয়, সেই ব্যয়িত অর্থের অতি ড়্গুদ্র অংশই বাড়িটির নির্মাণ কাজে ব্যয় হবে এবং সে বাড়ি কতটা টেকসই হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কিন্তু এ কাজটিই অতি সহজে করে ফেলা সম্ভব হবে যদি মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়।
যদি প্রতিটি গ্রামের বাসিন্দাদেরকে এটা বুঝানো যায় যে, আমরা সবাই আমাদের গ্রামের দুস্থ আশ্রয়হীন মানুষের থাকার জন্য ঘর তৈরি করে দিলে আলস্নাহ এবং আলস্নাহর রসুল আমাদের উপর খুশি হবেন। এ ঘরের বিনিময়ে আলস্নাহ পরকালে আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দেবেন এবং তাঁর জান্নাতে আমাদের জন্য ঘর নির্মাণ করে দেবেন। নিরাশ্রয় মানুষগুলো আমাদের জন্য দোয়া করবে। মানুষের কল্যাণে কাজ করাই আমাদের প্রকৃত ইবাদত। মানুষকে অবশ্যই ধর্মের আলোকে এভাবেই ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব। এখন যদি মানুষগুলো যার যে সামর্থ আছে তা নিয়ে এগিয়ে আসে এবং আলস্নাহর সন্তুষ্টির লড়্গ্েয এ কাজে আত¥নিয়োগ করে তাহলে সরকারি আর্থিক সহায়তা ছাড়াই শুধুমাত্র সরকারি ব্যবস্থাপনাতেই দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে এবং বিনা দুর্নীতি, বিনা টেন্ডারবাজিতে ৮৫ হাজার গ্রামে পাকা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মিত হয়ে যাবে। শুধু কি তাই? এ কাজে মুসলিম-সনাতন-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবাই অংশ নেবে, তাদের মধ্যেও সৃষ্টি হবে ভ্রাতৃত্ব, সম্প্রীতি। সকল ধর্মেই পরহিতব্রতের কথা, ‘মানবতার কল্যাণই মুক্তির পথ’- এ কথা বলা আছে। তাই ধর্মকে উপাসনালয়ের অচলায়তন থেকে বের করে মানুষের কাজে লাগাতে হবে। এভাবেই ধর্মবিশ্বাস একদিকে যেমন পৃথিবীকে সুন্দর করে তুলবে, পরকালকেও সাফল্যম-িত করবে। আজ আমরা পদ্মাস