দোয়ার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে প্রার্থনা (Prayer)। কোনো কর্তৃপক্ষের নিকট কোনো কিছু চেয়ে আবেদন করার নামই হলো প্রার্থনা। ইসলাম ধর্মে দোয়ার মানে হল আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে কোনো কিছুর জন্য আবেদন করা। কিন্তু বর্তমানের মুসলিম সমাজের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় যে, তারা দোয়ার প্রকৃত অর্থই ভুলে গেছে। প্রচেষ্টা না করে দোয়াকেই সফলতার একমাত্র অবলম্বন করে নিয়েছে। আজকে মুসলিমপ্রধান দেশগুলো যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত; ফিলিস্তিন, সিরিয়া প্রভৃতি দেশগুলোতে যখন আজকে মুসলমানদের উপর ইহুদী-খ্রিষ্টানদের কী নির্মম অত্যাচার চলছে, সেদিকে তাদের দৃষ্টি গিয়েছে বৈকি কিন্তু তাদের এ থেকে উদ্ধারের পথ হিসেবে ধার্মিক সমাজ দোয়াকেই বেছে নিয়েছে। তারা ধরেই নিয়েছেন যে এই সংকট মোকাবেলার যোগ্য নয়, বরং আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানাই। তিনি সর্বশক্তিমান। তিনি যদি মুখ তুলে তাকান মুসলিমরা বাঁচবে। আর যদি না তাকান তো কী আর করা, দোয়া করতে থাকি, আমার সওয়াব হবে। তাদের এ বোধটুকু পর্যন্ত লোপ পেয়েছে যে, তাদের দোয়া আদৌ কবুল হচ্ছে না।
তাদেরকে যদি প্রশ্ন করা হয় তবে নির্বোধের মতন উত্তর পাওয়া যায়, আমাদের দোয়া কবুল হয়েছে কিনা সেটা আমরা কি করে জানব? সেটা তো আল্লাহই জানবেন। তোমাদের প্রার্থনার ফল তো তোমাদের সামনেই বর্তমান। তোমরা শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রার্থনা কর, সেটা কি পেয়েছ? দোয়া কবুল হয় মো’মেনের। কয়েক শ বছর আগে যখন ভারতবর্ষ মুসলিম শাসনাধীন ছিল তখন তারা ইউরোপীয় জাতিগুলোর দাসে পরিণত হয়। তখন তাদের সার্বভৌমত্ব চলে যায় খ্রিষ্টানদের হাতে। তখনই তো জাতিগতভাবে তাদের নাম মুসলিমের খাতা থেকে কাটা গেছে। এই গোলামি ছিল তাদের উপর আল্লাহর গজবস্বরূপ। দীর্ঘ ২০০ বছর ব্রিটিশদের গোলামির পরেও এদের হুঁশ হলো না। দেশ দুই ভাগ হলো। ব্রিটিশদের শোষণের পর তারা মনে করেছিল পাকিস্তানকে আশ্রয় করে ভারতবর্ষের মুসলমানরা একে অপরের ভাই হয়ে বসবাস করবে। কিন্তু হিতে বিপরীত হলো। তারাও সেই ঔপনিবেশিক যুগের মতোই নব্য উপনিবেশ হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানকে গ্রহণ করল। ফলে আবারো রক্তের বন্যা বয়ে গেল। এবার আর অন্য জাতির দ্বারা নয়, মুসলমান ভাইয়েরাই ভাইদেরকে হত্যা করল। এদেশ স্বাধীন হলো।
কিন্তু স্বাধীন হয়েও আমরা আল্লাহর হুকুম না গ্রহণ করে সেই ব্রিটিশদের হুকুমই জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা করে শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করে যেতে থাকলাম। ফলশ্রুতিতে জাতি রাজনৈতিক বহু দলে বিভক্ত হল, শুরু হল রাজনৈতিক অরাজকতা। এর নিষ্পেষণ থেকে যারা কোনো পক্ষালম্বন করেনি তারাও বাঁচতে পারে নি। এরা দুর্নীতি, সন্ত্রাস থেকে বাঁচতে যা করেছে, তা হলো পাঁচ বছর পরপর শুধু সরকার পরিবর্তন কিন্তু সবার চেহারা একই, এই চুলো থেকে কড়াই, কড়াই থেকে চুলোতে যাওয়ার একই নাটক বার বার মঞ্চায়িত হচ্ছে।
এ তো গেল দোয়া করে বাঙালি মুসলিমদের বর্তমান অবস্থা। বিশ্বপরিস্থিতি তো আরও করুণ। আফ্রিকায় লক্ষ লক্ষ মুসলমান না খেয়ে মারা যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে সমুদ্রে ডুবে মারা যাচ্ছে। প্রতিটি পদে এখন মুসলমানরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদীদের মাস্টারপ্ল্যানের অংশ হিসেবে এখন ‘জঙ্গি’ ট্যাগ তাদের গায়ে এঁটে দেয়া হয়েছে। যেখানেই যাক সে জঙ্গি, এখন না হলেও ভবিষ্যতে হবে। মুসলমানের বাচ্চা তো? আর রোহিঙ্গা-ফিলিস্তিনের কথা তো বলাই বাহুল্য। কারণ একটাই- তারা আল্লাহর তওহীদের সঙ্গে আপস করেছে, তারা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব বাদ দিয়েছে। জাতীয় রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে আল্লাহর হুকুমগুলোকে বাদ দিয়ে কেবল নামাজ রোজা করেই নিজেদেরকে পাক্কা মুসলিম বলে বিশ্বাস করছে। অথচ আল্লাহ বলেছেন, “তবে কি তোমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছ যে, আল্লাহর হুকুমের কিছু অংশ মানবে কিছু অংশ মানবে না?” আল্লাহর হুকুম কিছু, মানুষের হুকুম কিছু; এভাবে আংশিক হুকুম মানা অংশীদার সাব্যস্ত করা বা শিরক। যারা শিরক করে তারা হয় মোশরেক, কাফির। আর আল্লাহ তো কাফের-মোশরেকের দোয়া কবুল করবেন না। আল্লাহ এও বলেছেন, ‘ওয়ামা দোয়াউল কাফিরিনা ইল্লাতি ফি দালাল’ কাফিরদের দোয়া ব্যর্থ। এ জাতির অবস্থা তাই হয়েছে। গত কয়েকশ’ বছর ধরে তারা শিয়া, সুন্নি, শাফেয়ী, হাম্বলী, গণতন্ত্রী, সাম্যবাদী হয়েছে কিন্তু একটা দিনের জন্যও মুসলিম হতে পারে নি। তাই তাদের দোয়া ব্যর্থ। যা দোয়া করেছে ফল হয়েছে তার উল্টো। দীর্ঘ ষাট বছর ধরে দোয়া করছে আল্লাহর কাছে ফিলিস্তিনকে মুক্ত করতে, ইসরাইলকে ধ্বংস করতে। কিন্তু ইসরাঈলের ম্যাপের ও বোমের সাইজ দুটোই বড় হয়েছে। দোয়ার ফল উল্টো হয়েছে কারণ এই দোয়াকারীরা মো’মেন নয়।
একের পিঠে শূন্য দিলে দশ হয়, আরো একটি শূন্য দিলে হয় একশ’। এভাবে যতই শূন্য দেয়া হোক কিন্তু মান উত্তোরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু যদি সামনে এক সংখ্যাটাই না দেয়া হয়, তবে বাকি শূন্যগুলোর কোনো দাম থাকে না। ঈমান ও আমলের সম্পর্ক ঠিক সেইরূপ। ঈমান থাকলে আমল বেশি না করলেও আল্লাহ ছাড় দিবেন।
এ সম্পর্কে একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা আছে। একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, “যে বললো, লা ইলাহা ইলাল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা নেই), সেই জান্নাতি।” আবু যর (রা.) জিজ্ঞাসা করলেন, চুরি করলেও, ব্যভিচার করলেও? রাসুলাল্লাহ বললেন, “হ্যা”। এরকম তিনবার পরপর জিজ্ঞাসা করলে রাসুলাল্লাহ বললেন, “হ্যা”। চতুর্থবারে বললেন, “এমনকি আবু যরের নাক মাটিতে ঘষে দিলেও সে জান্নাতি”। আবু যর খুশিতে মদীনার দিকে ছুটতে ছুটতে বলতে লাগলেন, “এই খবর আছে। আল্লাহর রাসুল বলেছেন, ‘যে বলবে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, সেই জান্নাতি।’ এটা শুনে উমর বললেন, “এই দাঁড়াও কি হচ্ছে?” আবু যর বললেন, “আল্লাহর রাসুল বলেছেন, যে বলবে, ‘লা ইলাহা ইলাল্লাহ; সেই জান্নাতি’। উমর বললেন, “এই দেখ, এই কথা বলবে না, বললে মানুষ আমল ছেড়ে দিবে”। আবু যর (রা.) বললেন, “একথা রাসুল বলেছেন”। উমর (রা.), আবু যরকে (রা.) চড় দিলেন। চড় দেয়ার সাথে সাথে তিনি আবু যর রাসুলের দরবারে আসলেন। রাসুল উমরকে (রা.) বললেন, “উমর, দীন সহজ-সরল, দীনকে তোমরা জটিল করো না”। এখানে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, প্রশ্ন এসেছে আমলের, আল্লাহর রাসুল বললেন, দীন সহজ সরল, একে জটিল করো না। কারণ তিনি জানতেন, ঈমান না থাকলে আমল কোনো কাজে আসবে না। আল্লাহর হুকুমকে আংশিকভাবে মেনে নিয়ে যারা নিজেদের মো’মেন দাবি করে মহা সমারোহে নামাজ, রোযা, হজ্ব করে যাচ্ছি তারা মহাভ্রান্তির মধ্যে আছি। আগে নিজের জাতিকে একজন নেতার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। তারপর আল্লাহর রসুল যেভাবে জাতি গঠন করেছেন সেভাবে একটি সুশৃঙ্খল, আনুগত্যশীল, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও শত্রুর মনে ত্রাস সৃষ্টিকারী শক্তিশালী জাতি গঠন করতে হবে। তাদের ঐক্যের ভিত্তি হবে একটি কথা- আল্লাহর হুকুম ছাড়া আর কারো হুকুম আমরা মানি না। তাহলেই তারা মোমেন হবে, আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করবেন। আমাদের দোয়াও তখন কবুল হবে।
আমরা যদি এই ষোল কোটি বাঙালিকে আল্লাহর হুকুম তথা তওহীদের মন্ত্রে ঐক্যবদ্ধ করতে পারি, তবে এ জাতি হবে পরাশক্তি (super power)। আর কারো সাধ্য থাকবে না, আমাদের দিকে চোখ তুলে কথা বলে। তখন আমাদের অভিভাবক হবেন আল্লাহ। আর যে জাতির অভিভাবক আল্লাহ সে জাতি অপরাজেয়। সুতরাং জাতির এই দুঃসময়ে এই জাতিকে আল্লাহর হুকুমের ছায়াতলে ঐক্যবদ্ধ করাই আমাদের একমাত্র পথ। এটাই সময়ের দাবি।