ফয়সল আহমেদ:
আমরা বর্তমানের বিকৃত ইসলামের আলেম সাহেবদের কাছে শুনি যে দুনিয়া খুবই খারাপ জায়গা। তাই দুনিয়ার দিকে দৃষ্টি না দিয়ে আখেরাতের অভিমুখী হতে হবে, চোখ কান বুজে এ দুনিয়ার জীবনকে কোনমতে পার করে দিতে পারলেই মুক্তি। দীন বলতে বোঝানো হচ্ছে ইসলামের ব্যক্তিগত কিছু উপাসনাকে যেমন সালাহ (নামাজ), সওম (রোজা), হজ্জ, যিকির-আজগার ইত্যাদিকে আর দুনিয়া বলতে বোঝানো হচ্ছে এই উপাসনাগুলির বাইরে যাবতীয় কাজকে যেমন ব্যবসা, চাষাবাদ, চাকরি, পড়াশুনা, সামাজিক ও দেশের উন্নয়নমূলক কাজ ইত্যাদি। ইসলামের অন্যান্য বিষয়গুলির মতোই ‘দুনিয়া’ শব্দটিও আজ বিপরীত অর্থে ব্যবহার করা হয়। ইসলাম এসেছে সমস্ত দুনিয়াময় শান্তি (ইসলাম শব্দের অর্থই শান্তি) প্রতিষ্ঠা করতে এবং তাও সংগ্রামের মাধ্যমে। যেখানে দুনিয়াতেই একটি জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, সেখানে সেই দুনিয়াকেই ত্যাগ বা তার গুরুত্ব কমিয়ে দেয়া কী করে অর্থবহ? আল্লাহ কোর’আনে মুমিনদের প্রতিশ্র“তি দিচ্ছেন যে, নিশ্চয়ই তিনি তাদের পৃথিবীর জমিন ও ক্ষমতা দান করবেন, যেমন তিনি পূর্ববর্তী মুমিনদেরও দান করেছিলেন (কোর’আন- সুরা আন-নূর-৫৫)। প্রকৃতপক্ষে দুনিয়া বলতে বোঝানো হচ্ছে- আল্লাহ ও তাঁর রসুল এই জাতির, উম্মাহর জন্য যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্থির করে দিয়েছেন সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের পথে এই পৃথিবীতে যা কিছু বাধা হয়ে দাঁড়াবে তাই দুনিয়া। আল্লাহ দুনিয়াকে প্রত্যাখ্যান করতে বলেন নি, তা বললে তিনি কখনই আমাদের বলতেন না এই দোয়া করতে যে- হে আমাদের পালনকারী! আমাদের এই দুনিয়াকে সুন্দর করে দাও এবং আখেরাতকেও সুন্দর করে দাও (সুরা আল-বাকারা-২০১)।
প্রকৃত মুমিনের কাছে দুনিয়া শব্দের অর্থ ও আকিদা হলো এই যে, সে এই পার্থিব জীবনকে যতটুকু সম্ভব সুন্দর করতে চেষ্টা করবে। এই পৃথিবীতে সে যত কাজ করবে তা যত সম্ভব সুন্দর করে, নিখুঁত করে করতে চেষ্টা করবে। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি, যার যে পেশা, বৃত্তি, দায়িত্ব সেগুলোতে সে তার পক্ষে যতদূর সম্ভব সুষ্ঠুভাবে সুন্দরভাবে করতে চেষ্টা করবে। এটা দুনিয়া নয় দীনদারী। বরং কেউ যদি তার পেশায়, দায়িত্বে গাফেলতি করে, তার কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন না করে তবে সেটাই হবে দুনিয়াদারী, গোনাহ। রসুলাল্লাহ বলেছেন- যখন এই দুনিয়ার কাজ করবে তখন এমনভাবে করবে যেন তুমি অমর, চিরঞ্জীব, আর যখন দীনের কাজ করবে তখন এমনভাবে করবে যেন তুমি পরের দিন মারা যাবে। যতক্ষণ একটি মানুষ অন্যকে না ঠকিয়ে, মিথ্যা না বলে সততার সাথে তার পেশা করে যাবে, উপার্জন করবে ততক্ষণ সে ইবাদত করছে, দীনের কাজ করছে। আর যে মুহূর্তে সে কোনো কাজে মিথ্যা বা প্রতারণার আশ্রয় নেবে সেই মুহূর্তে সে দুনিয়ায় পতিত হবে। হালাল উপার্জন দিয়ে ভালোভাবে থাকায়, ভালোভাবে খাওয়া-পরায় ইসলামে বাধা নেই, কোনো নিষেধ নেই। কিন্তু ঐ উপার্জন ঐ সম্পদ যদি তাকে আল্লাহর রাস্তায় কোনো কাজ থেকে বিরত করে, দীনের কাজে ব্যয় করা থেকে বিরত করে তখন তা দুনিয়া। শুধু সম্পদ নয়, এই পৃথিবীর যা কিছু আল্লাহর রাস্তায় বাধা হবে তাই দুনিয়া। সেটা সম্পদ হোক, স্ত্রী-পুত্র-পরিজন হোক, যাই হোক। ঐ দুনিয়াকে আল্লাহ- রসুল ত্যাগ করতে বলেছেন। শুধু যে ভালোভাবে থাকা, ভালো খাওয়া-পরা তাই নয়, সাজ-সজ্জা, আড়ম্বর, জাঁক-জমক পর্যন্ত আল্লাহ মুসলিমদের নিষিদ্ধ করেন নাই। এই হলো ইসলামে দুনিয়ার সঠিক অর্থ।