হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

দাজ্জালীয় সভ্যতা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে বিশ্বকে? (র্পব ২)

মোখলেছুর রহমান সুমন:
গতকালের আলোচনায় উঠে এসেছিল দাজ্জালের পরিচিতির দিকটি, অর্থাৎ ‘পাশ্চাত্যের স্রষ্টাহীন বস্তুবাদী যান্ত্রিক সভ্যতা’ই যে আল্লাহর রসুল বর্ণিত দানব দাজ্জাল তা পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা হয়েছিল সেখানে। আজ আমরা তুলে ধরব দাজ্জালের ভয়াবহতা ও সঙ্কটের চিত্র।
ধর্মহীন, স্রষ্টাহীন ও বস্তুবাদী যান্ত্রিক সভ্যতা অর্থাৎ দাজ্জালের সৃষ্ট ফেতনার ভয়াবহতা কতখানি তা বুঝতে এটুকু জানাই যথেষ্ট যে, নুহ (আ.) থেকে শেষ নবী পর্যন্ত কোনো নবীই বাদ যাননি যাঁরা তাঁদের নিজ নিজ উম্মাহকে দাজ্জাল সম্পর্কে সতর্ক করেন নি। উপরন্তু যে মহামানব মাত্র ২৩ বছরের নবুয়্যতি জিন্দেগীতে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচাইতে বড় বিপ্লবটি ঘটালেন সেই বিশ্বনবী মোহাম্মদ (সা.) যখন নিজে আল্লাহর কাছে দাজ্জালের ফেতনা থেকে পানাহ চাইলেন (বোখারী) তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না- এই দাজ্জালের সঙ্কট কত তীব্র সঙ্কট, এই দাজ্জালের ভয়াবহতা কত অকল্পনীয় ভয়াবহতা!
আল্লাহর রসুল আদম (আ.) থেকে কেয়ামত পর্যন্ত মানুষের ইতিহাসের সবচাইতে বড় ঘটনা বলেছেন দাজ্জালের জন্মকে। কেন বলেছেন তা এখন বোঝা যাচ্ছে। অন্য কিছু বাদ দিলেও গত শতাব্দীতে এই সভ্যতা মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে যে দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধ ঘটিয়ে ১৩ কোটি বনি আদমের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে এবং বর্তমানে সারা পৃথিবীকে ভয়াবহ পরমাণু যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছে- সেটাই কি মানব ইতিহাসে অতীতে কখনও ঘটেছে? তবে শুধু যুদ্ধের মধ্যেই দাজ্জালের সঙ্কট সীমাবদ্ধ নয়, মানবজীবনের প্রতিটি অঙ্গনে, প্রতিটি অধ্যায়ে এই দাজ্জালীয় অপশক্তিটি ‘মারণঘাতি’ ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে।
দাজ্জাল তথা পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী স্রষ্টাহীন সভ্যতা কী চায়? সে চায় মানুষ তার ব্যক্তিগত জীবনে যার ইচ্ছা উপাসনা করুক, যে দেবতার ইচ্ছা পূজা করুক, যত খুশি নামাজ-রোজা করুক, অর্থাৎ ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মচর্চা করে আসমান-জমিন ভরিয়ে ফেলুক তাতে দাজ্জালের আপত্তি নেই। কিন্তু ভুলেও যেন মানুষ জাতীয় জীবনে ধর্মকে টেনে না আনে! জাতীয় জীবনে আল্লাহর কোনো স্থান নেই, সে স্থান দাজ্জাল তার নিজের জন্য পাকাপোক্ত করে নিয়েছে। মানুষ সব বলতে পারবে শুধু আল্লাহর সার্বভৌমত্বের কথা বলতে পারবে না, কারণ সার্বভৌমত্ব কেবল দাজ্জালের। মানুষ যার ইচ্ছা হুকুক মানতে পারে- সে রাজার হুকুম মানতে চাইলে মানুক (রাজতন্ত্র), একনায়কের হুকুম মানতে চাইলে মানুক (স্বৈরতন্ত্র), সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের হুকুম মানতে চাইলে মানুক (গণতন্ত্র), সমাজের বিশেষ কোনো শ্রেণির হুকুম মানতে চাইলে মানুক (সমাজতন্ত্র), দাজ্জালের তাতে আপত্তি নেই, শুধু আপত্তি আল্লাহর হুকুম মানতে চাইলে। অথচ পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষ বরাবরই আল্লাহর হুকুম মেনেই জীবনযাপন করে এসেছে। ধর্মের হাত ধরেই রচিত হয়েছে মানুষের ইতিহাসের সোনালী অধ্যায়গুলো। দাজ্জাল সেই ধর্মকেই সেকেলে ও কুসংস্কার আখ্যা দিয়ে জাতীয় জীবন থেকে নির্বাসন দেওয়ার ফল হলো এই যে, পৃথিবীতে সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, বৈধ-অবৈধ’র কোনো পার্থক্য আর রইল না। আজ পৃথিবীতে ন্যায়-অন্যায়ের স্বীকৃত কোনো মানদণ্ড নেই। কোনটা ন্যায় তা ঠিক করে দিচ্ছে কোথাও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ, কোথাও সমাজের বিশেষ একটি শ্রেণি, কোথাওবা কেবলই শাসকের পেশীশক্তি। ফলাফল? অন্যায়, অবিচার, অশান্তি ও অনিরাপত্তা।
হাদিসে এসেছে, দাজ্জাল যেটাকে জান্নাত বলবে সেটা হবে জাহান্নাম, আর যেটাকে জাহান্নাম বলবে সেটা হবে জান্নাত- যেন বর্তমান পরিস্থিতি স্বচক্ষে দেখে দেখে রসুল কথাগুলো বলেছেন। দাজ্জালের জাহান্নামে যাওয়ার সাহস কার আছে? সমস্ত পৃথিবীর মানুষ এখন তাই দাজ্জালের জান্নাতে যেতে উদগ্রীব। কিন্তু বাস্তবে যে সেটা জাহান্নাম তা পৃথিবীর দিকে এক নজর তাকালেই বোঝা যায়। এই মুহূর্তে পৃথিবীর ছয় কোটি মানুষ উদ্বাস্তু। খাবারের অভাবে প্রাণের ঝুঁকিতে ধুকছে কোটি কোটি বনি আদম। অথচ পৃথিবীতে সম্পদের অভাব নেই। এই গ্রহেরই এমন রাষ্ট্র আছে যার রাষ্ট্রপ্রধানরা টাকা খরচ করবেন কোথায় তা ভেবে পাচ্ছেন না। শুধু ২০১৬ সালে বিশ্বে সামরিক খাতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে, হিসাব করে দেখা যাচ্ছে এই টাকায় ৩৮৩ বার আফ্রিকার দুর্ভিক্ষ দূর করা সম্ভব হত। একদিকে মানুষ না খেতে পেয়ে প্রাণ হারাচ্ছে, অন্যদিকে মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে হাজার হাজার কোটি ডলার দিয়ে মানুষকেই মারার অস্ত্রপাতি তৈরি করা হচ্ছে, এই হচ্ছে দাজ্জালের জান্নাত!
অন্যদিকে দাজ্জাল অর্থাৎ পাশ্চাত্য বস্তুবাদী সভ্যতা দিবারাত্রি যেই ধর্মকে অশান্তি (জাহান্নাম) ও নিপীড়নের কল বলে অপপ্রচার চালায় সেই ধর্মের শাসন এমন সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিল যে মানুষ দরজা খুলে ঘুমাত, স্বর্ণের দোকান খোলা রেখে মসজিদে নামাজ পড়তে যেত, কেউ অপরাধ করলে নিজেই নিজের বিচার দাবি করত! ইসলামের স্বর্ণযুগে মানুষের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, মানুষ যাকাত দেবার জন্য রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত, কিন্তু গ্রহণ করার মতো লোক পাওয়া যেত না। শহরে-বন্দরে লোক না পেয়ে অনেকে উটের পিঠে মালামাল চাপিয়ে মরুভূমিতে ঘুরে বেড়াত যাকাত গ্রহণকারীর সন্ধানে। এগুলো ইতিহাস। অর্থাৎ দেখা গেল পাশ্চাত্য বস্তুবাদী সভ্যতা যেটাকে বলল স্বর্গ সেটা আসলে নরক, আর যেটাকে বলা হলো নরক, সেটাই যুগ যুগ ধরে মানুষকে স্বর্গসুখ দিয়ে এসেছে, আজও দিতে সক্ষম, যদিও দাজ্জাল তা হতে দেবে না।
দাজ্জালের ডান চোখ অন্ধ বলে এই সভ্যতা জীবনের আত্মা ও পরকালের দিকটি একেবারেই দেখতে পায় না। কেবল বাম চোখ দিয়ে সে জীবনের একটি দিক, দেহের দিক, বস্তুর দিক, ভোগের দিক দেখতে পায়। তাই বস্তু ও দেহ নিয়েই এই সভ্যতার যত মাথা ব্যথা, অথচ কিনা একই সময়ে মানুষের আত্মিক জগতে চলছে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। মানুষের আত্মা মরে যাচ্ছে। সমাজে এক ফোঁটা দয়া নেই, মায়া নেই, ভালোবাসা নেই। একের দুঃখে দশের সাড়া নেই। ত্যাগ নেই, উৎসর্গ নেই। অন্যায়ের প্রতি ঘৃণা নেই। ন্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধা নেই। সত্যের কদর নেই। সততার মূল্য নেই। কিন্তু আফসোস! দেহ নিয়ে যে সভ্যতার এত টেনশন, আত্মার এই ত্রাহী অবস্থার দিকে একপলক চেয়ে দেখার ফুসরতও তার নেই। মানুষ এখন দেহের দাস, ভোগের দাস, প্রবৃত্তির দাস, অর্থের দাস। অর্থ ও ভোগের পেছনে নিরন্তর ছুটে চলাই যেন তার ‘ধর্ম’। আবার ¯্রষ্টাকে যেহেতু ভুলে যাওয়া হয়েছে, পরকালের জবাবদিহিতার ভয় গেছে কেটে, সুতরাং এই ছোটাছুটিতে ন্যায়-অন্যায় বা নৈতিকতা-অনৈতিকতার বালাইও আর থাকছে না।
আজ দার্শনিকরা বলছেন ‘অর্থনৈতিক সমস্যাই মানুষের মূল সমস্যা’। শিশুকে শেখানো হচ্ছে, লেখাপড়া করে যে/গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে। তরুণ-তরুণীদেরকে শেখানো হচ্ছে, পরিশ্রম কর, ক্যারিয়ার গড়, যত পারো টাকা কামাও, সঞ্চয় করো, গাড়ি-বাড়ি কেন, জীবনকে উপভোগ করো। মানুষ এই পাশবিক জীবনযাপনকেই ‘মানবজীবন’ মনে করছে, যার মূলমন্ত্র হচ্ছে ‘স্বার্থ’। একটি কুকুরও সমাজের কিছু না কিছু উপকারে লাগে। কিন্তু এই পৃথিবীতে লক্ষ-কোটি মানুষ জন্মাচ্ছে, খাচ্ছে-দাচ্ছে, বংশবিস্তার করছে, জৈবিক চাহিদা মিটিয়ে মরে যাচ্ছে- সমাজের কোনো উপকারে লাগছে না। এভাবে দাজ্জাল আত্মিকভাবে, চারিত্রিকভাবে, নৈতিকভাবে সমগ্র মানবজাতিকে ধ্বংস করে ফেলছে। কিন্তু তাতে কি, মানবতার শত্রু হলেও দাজ্জালকেই মানুষ প্রভু বলে মেনে নিয়েছে। তার অবাধ্য হবার সাধ্য কারো নেই। যদি পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্র বা কোনো গোষ্ঠী দাজ্জালের হুকুম মানতে অস্বীকার করে, যেমন ধরা যাক মুসলিম জনগোষ্ঠীর কথা, এদের মধ্যে কোনো রাষ্ট্র দাজ্জালের অবাধ্য হলে তার বিরুদ্ধে প্রথমত দাজ্জাল তার মিডিয়া ও অর্থবল প্রয়োগ করে, প্রয়োজনে ঐ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং তাতেও কাজ না হলে সামরিক হামলা করে ঐ রাষ্ট্রটিকে দখল করে তার পছন্দসই ও তল্পিবাহক সরকার ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়। এমনটা যে হবে তা আল্লাহর রসুল বলে গেছেন, শুধু আক্ষরিকভাবে ‘অবরোধ’ ও ‘নিষেধাজ্ঞা’ শব্দ দুইটি ব্যবহার না করে।
কিছু বিপথগামী মানুষের সন্ত্রাসী হামলার সূত্র ধরে দাজ্জাল তার মিডিয়ার মাধ্যমে পৃথিবীবাসীকে বোঝাচ্ছে, ‘দ্যাখো দ্যাখো, মুসলমানরা কত সন্ত্রাসী জাতি! এরা কত রক্তপিপাসু।’ মানুষ সেটাই বিশ্বাস করছে। কিন্তু অন্যদিকে দাজ্জালীয় তাণ্ডবে সিরিয়া ধ্বংস হলেও, ইরাক ধ্বংস হলেও, আফগানিস্তান ধ্বংস হলেও, লিবিয়া ধ্বংস হলেও, ইয়েমেন ধ্বংস হলেও, লক্ষ লক্ষ মুসলিমের রক্ত ঝরলেও, লক্ষ লক্ষ মুসলিম নারী সম্ভ্রম হারালেও, কোটি কোটি মুসলিম উদ্বাস্তু হলেও- কেউ সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিদেরকে সন্ত্রাসী বা জঙ্গি বলছে না। সবাই চেয়ে চেয়ে ধ্বংসযজ্ঞ দেখছে শুধু। কারণ আর কিছু নয়, ‘Might is Right’ শক্তিমানের কথাই ঠিক।
তবে এই দানব দাজ্জাল চিরস্থায়ী নয়, এরও ধ্বংস আছে, পরিণতি আছে। ক্রমশই দাজ্জাল তার সেই পরিণতির দিকে এগিয়ে চলছে। কিন্তু এগিয়ে চলছে পুরো মানবজাতিকে সঙ্গে নিয়ে। কারণ মানুষ তাকে তাদের রব বলে মেনে নিয়েছে, তার পদতলে সেজদায় প্রণত হয়ে আছে। এই মানুষকে এখন উপলব্ধি করতে হবে তারা কোথায় যাচ্ছে, দাজ্জাল তাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে।
এই সময়টি আসবে বলেই সেই নুহ (আ.) থেকে শেষ রসুল (সা.) পর্যন্ত প্রত্যেক নবী-রসুল দাজ্জালের ব্যাপারে মানুষকে সতর্ক করেছেন। আখেরী নবী তো রূপকভাবে দাজ্জালের খুঁটি-নাটি পর্যন্ত বর্ণনা করে গেছেন যাতে এই ক্রান্তিকালে তাঁর উম্মাহ কোনো ভুল সিদ্ধান্ত না নেয়, তারা যেন দাজ্জালকে চিনতে পারে ও তার অন্ধ অনুসরণ করা থেকে বিরত হতে পারে। তারপরও যদি আমরা দাজ্জালকে ‘দাজ্জাল’ হিসেবে চিনতে না পারি এবং মানবতার এই মহাশত্রুর অন্ধ অনুসরণ থেকে বিরত না হই তাহলে এ কথা বলাই যায় যে, দাজ্জালের সাথে সাথে ‘মৃত্যু’ হবে এই মুসলিম নামধারী জনগোষ্ঠীরও। তার পূর্বেই যেন আল্লাহ সবাইকে দাজ্জালকে চেনার ও প্রতিরোধ করার তওফিক দান করেন সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...