‘তওহীদ জান্নাতের চাবি’ বইটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হবার পর পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। অনেকেই বইটির ভূয়ষী প্রশংসা করেছেন এবং বিশ্বময় মুসলিম জাতির দুর্দশা ঘোচাতে তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হবার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছেন। কিন্তু বইটির নামকরণ নিয়ে একটি প্রশ্নের উদ্ভব হয় যে, এতদিন জেনে এসেছি ‘নামাজ জান্নাতের চাবি’ তাহলে এখন তওহীদকে জান্নাতের চাবি বলা হচ্ছে কেন? প্রশ্নটি যে প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপুর্ণ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কাজেই এ বিষয়টি নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
আমরা প্রথমেই পাঠকদেরকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চাই ‘নামাজ জান্নাতের চাবি’ বলে যে হাদিসটি বর্তমানে প্রচলিত আছে তা নিঃসন্দেহে একটি জাল হাদিস। হাদিসটি এই যে, জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রা) বলেন, রসুলাল্লাহ (সা.) বলেছেন, “জান্নাতের চাবি হল নামাজ। আর নামাজের চাবি হল পবিত্রতা।” (মুসনাদে আহমাদ হা/১৪৭০৩, তিরমিজি হা/৪, মিশকাত হা/২৪৯, ফাজায়েলে আমাল ৮৮ পৃ.)।
এই হাদিসের দ্বিতীয় অংশ পৃথক সনদে সহিহ সূত্রে বর্ণিত আছে, কাজেই নামাজের চাবি হলো পবিত্রতা তাতে সন্দেহ নেই (আবু দাউদ হা/৬১, তিরমিজি হা/৩), কিন্তু প্রথম অংশ অর্থাৎ ‘নামাজ জান্নাতের চাবি’ কথাটিকে আলেমগণ জঈফ সাব্যস্ত করেছেন (জঈফুল জামে হা/৫২৬৫, সিলসিলা ই জঈফা হা/৩৬০৯)। এর কারণ উক্ত সনদে দুইজন দুর্বল রাবি আছে (ক) সুলাইমান বিন করম ও (খ) আবু ইয়াহিয়া আল-কাত্তাত (আলবানি, মিশকাত হা/২৯৪ এর টিকা দ্রষ্টব্য)। অথচ এই দুর্বল রাবির জঈফ হাদিসটিই আজ ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়ে পড়েছে।
তবে এই হাদিসকে রিজাল শাস্ত্রীয় ভাষায় জইফ বা দুর্বল যাই বলা হোক, আমরা সাধারণ জ্ঞান খাটিয়েই বুঝে নিতে পারি এটা জাল ও বানোয়াট হাদিস কারণ আল্লাহর রসুল বহুবার তওহীদ বা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’- এই কলেমাকে জান্নাতের চাবি বলে উল্লেখ করেছেন যেই বর্ণনাগুলো বোখারিসহ বিভিন্ন হাদিসগ্রন্থ ও প্রসিদ্ধ সিরাত গ্রন্থগুলোতে সন্নিবেশিত হয়েছে। যেমন, রসুলাল্লাহ (স.) যখন মুয়াজকে (রা.) প্রশাসক হিসেবে ইয়েমেনে পাঠান তখন কতিপয় উপদেশ দেন ও তাঁর অঙ্গীকার গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, “সহজভাবে ইসলামের দাওয়াত পেশ করবে, কঠিনভাবে নয়। তাদের মনে আশার আলো জাগাবে, বীতশ্রদ্ধ করে দেবে না। আহলে কিতাবের একটি গোষ্ঠির সাক্ষাৎ পাবে। ওরা জিজ্ঞেস করবে যে জান্নাতের চাবি কী? তুমি তাদের বলবে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ- এ সাক্ষ্য প্রদানই জান্নাতের চাবি। এই ঘটনাটি মুয়াজ বিন জাবালের (রা.) বরাত দিয়ে মুসনাদে আহমদ ও মেশকাত শরীফে বর্ণিত হয়েছে। তওহীদ জান্নাতের চাবি এ কথাটি এতই প্রামাণ্য যে, আল্লাহর রসুলের সবচাইতে প্রসিদ্ধ জীবনীগ্রন্থ সিরাত ইবনে ইসহাক ও সিরাত ইবনে হিশাম এই দুটো গ্রন্থেই এই বিবরণটি উল্লেখ করা হয়েছে (সিরাতে ইবনে হিশাম, পৃষ্ঠা ৩৩০)।”
জান্নাতের চাবি সম্পর্কে ইমাম বুখারী (র.) একটি অনুচ্ছেদের বিষয়বস্তু আলোচনা করতে গিয়ে ওহাব ইবনু মুনাব্বিহ (র.) থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন যে, তাঁকে (অর্থাৎ ওহাব ইবনু মুনাব্বিহকে) একদিন জিজ্ঞেস করা হল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কি জান্নাতের চাবি নয়? তখন তিনি বললেন, হ্যাঁ। তবে প্রত্যেক চাবির দাঁত রয়েছে। তুমি যদি এমন চাবি নিয়ে আস যার দাঁত রয়েছে, তাহলে তোমার জন্য জান্নাত খোলা হবে। অন্যথায় খোলা হবে না।’ (সহিহ বোখারি ১/১৬৫ পৃ., হা: ১২৩৭-এর পূর্বের আলোচনা দ্র., (ইফাবা হা: ১১৬৫-এর পূর্বের আলোচনা, ২/৩৫৫ পৃ.), জানাযা অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১)। এই ভাষ্যটি থেকেও প্রমাণিত হচ্ছে জান্নাতের চাবি হচ্ছে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।
এছাড়াও আরও অন্যান্য হাদিস দ্বারা এই সত্যটি প্রমাণিত হয়, যেমন সহিহ বোখারি হা: ৫৮২৭, ২/৮৬৭ পৃ., ‘পোষাক’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২৩; সহীহ মুসলিম হা: ২৮৩, ১/৬৬ পৃ., ‘ঈমান’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪২; মিশকাত হা: ২৬; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা: ২৪, ১ম খন্ড, পৃ. ২৯; সহিহ মুসলিম হা: ১৫৬, ১/৪৫ পৃঃ, ‘ঈমান’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১২; মিশকাত হা: ৩৯; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা: ৩৫।
আল্লাহর রসুল মক্কায় তওহীদের বালাগ শুরু করলে যে মুষ্টিমেয় মানুষ তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন তারা প্রাথমিক অবস্থায় নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত, ঈদ, কোরবানি ইত্যাদি কিছুই পাননি। ইসলাম বলতে তারা পেয়েছিলেন কেবল তওহীদ এবং অনেকে ওই তওহীদের স্বীকৃতি দিয়েই ইন্তেকাল করেছিলেন, আমাদের মত করে এক ওয়াক্ত নামাজও পড়ার সুযোগ পাননি। নামাজ জান্নাতের চাবি হলে মক্কায় মৃত্যুবরণকারী ওই সাহাবীদের জান্নাতি হবার কথা নয়, কিন্তু আমরা সবাই জানি তাঁরা তওহীদের স্বীকৃতি দেওয়ার কারণে কেবল জান্নাতিই হয়েছেন তাই নয়, তাঁরা সমগ্র মানবজাতির জন্য অনুসরণীয় আদর্শ হয়ে থাকবেন কেয়ামত পর্যন্ত। পক্ষান্তরে বহু হাদিস রয়েছে যেগুলোর মূলকথা হচ্ছে, এক শ্রেণির মানুষ নামাজ পড়েও জান্নাতে যেতে পারবে না। যেমন, উম্মাহর ঐক্যবন্ধনী (তওহীদের ভিত্তিতে) থেকে এক বিঘত সরে গেলে সেই ব্যক্তি জাহান্নামের জ্বালানি পাথর হবে যদিও সে নামাজ পড়ে, রোজা রাখে এমনকি নিজেকে মুসলিম বলে বিশ্বাসও করে। (আল হারিস আল আশয়ারী রা: থেকে আহমদ, তিরমিযি, বাব উল এমারাত, মেশকাত)। নামাজই যদি জান্নাতের চাবি হত তাহলে এমন কথা আল্লাহর রসুল বলতেন কি? আসলে বিশ্বনবী নিজে থেকে কিছুই বলতেন না, আল্লাহ তাঁকে যে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করেছিলেন তিনি সেই ভিত্তিতেই কথা বলতেন। কাজেই কখনও তিনি তওহীদকে জান্নাতের চাবি বলবেন, আবার কখনও নামাজকে জান্নাতের চাবি বলবেন এমনটা হবার সুযোগ নেই। নিশ্চয়ই নামাজকে জান্নাতের চাবি বলা হাদিসগুলো তাঁর নিজের কথা নয়, এগুলো পরবর্তীতে তাঁর নামে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন?
বস্তুত এটা এক সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত ও আকিদা বিকৃতির ফসল। তওহীদ হচ্ছে আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম না মানা, এটা বান্দার সাথে আল্লাহর চুক্তি। এই চুক্তি মোতাবেক উম্মতে মোহাম্মদী যতদিন তওহীদকে জান্নাতের চাবি বলে বিশ্বাস করেছে, ততদিন তারা তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ থেকেছে, দীনের সমস্তকিছুর প্রাণশক্তি হয়ে থেকেছে তওহীদ এবং উম্মতে মোহাম্মদীর যাবতীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল তওহীদ। একটি সুতার মাধ্যমে যেমন একশ’টি তসবিহর দানা একত্রিত থাকে, তেমনি এই জাতি তওহীদ নামক সূত্রে একজাতি একপ্রাণ হয়ে গ্রন্থিত ছিল। কিন্তু যখনই তওহীদের বদলে নামাজকে ‘জান্নাতের চাবি’ বলে প্রচার করা হলো, তখন তওহীদকেন্দ্রিক দীন পাল্টে গিয়ে নামাজকেন্দ্রিক দীনে পর্যবসিত হলো। গুরুত্বের অগ্রাধিকার ওলট-পালট হয়ে গেল। ঈমানের ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া হলো আমলকে। যেহেতু নামাজ পড়েই জান্নাতে চলে যাওয়া যাচ্ছে, কাজেই আল্লাহর হুকুম কায়েমের বাধ্যবাধকতা আর রইল না। কার হুকুমে সমাজ চলছে, রাষ্ট্র চলছে, আইন-কানুন দণ্ডবিধি চলছে, অর্থনীতি চলছে- অর্থাৎ জাতি তওহীদে আছে কিনা তার দিকে না তাকিয়ে সবাই ব্যক্তিগত জীবনে নামাজ পড়েই জান্নাতের টিকিট হাসিল করতে লাগল। আর এরই সুযোগে পশ্চিমা বস্তুবাদী দাজ্জালীয় সভ্যতা এই জাতির সর্বস্ব অধিকার করে এদেরকে তার গোলামে পরিণত করল। আজ এই জাতি ইসলাম বলতেই বোঝে নামাজ, তওহীদ কী বস্তু অনেকে জানেই না। নামাজ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, প্রত্যেক মো’মেনের জন্য নামাজ ফরদ, পবিত্র কোর’আনের অন্তত বিরাশি বার আল্লাহ নামাজের কথা বলেছেন, কিন্তু কলেমা তওহীদ ছাড়া শুধু নামাজ কেন, কোনোকিছুরই কোনো মূল্য নেই এই সত্যটি জাতিকে উপলব্ধি করতে হবে। আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস সেই উপলব্ধিকে জাগ্রত করার জন্যই।