পশ্চিমা জড়বাদী সভ্যতার ডান চোখ অন্ধ বলে এই সভ্যতা জীবনের আত্মা ও পরকালের দিকটি একেবারেই দেখতে পায় না। কেবল বাম চোখ দিয়ে জীবনের একটি দিক অর্থাৎ দেহের দিক, বস্তুর দিক দেখতে পায়। তাই বস্তু ও দেহ নিয়েই এই সভ্যতার যত মাথা ব্যথা, আত্মার ও নৈতিকতার অধঃপতন চোখে দেখে না।
আজ এই সভ্যতা মানুষের দৈহিক চাহিদা পূরণের জন্য কত কিছুই না করছে। খাবার- সে কত প্রকারের হতে পারে, যৌনতা- কত ধাঁচের হতে পারে, দৈহিক সুস্থতা- কত বিচিত্র পন্থায় নিশ্চিত করা যেতে পারে, আরাম আয়েশ- কত হাজার উপায়ে ভোগ করা যেতে পারে- তা এই সভ্যতার অন্যতম গবেষণার বিষয়। অতীতে কোনো সভ্যতা মানুষের কেবল ‘দৈহিক চাহিদা’ পূরণের জন্য এতটা ব্যতিব্যস্ত হয়েছে কিনা সন্দেহ। অথচ কিনা একই সময়ে মানুষের আত্মিক জগতে চলছে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। মানুষের আত্মা মরে যাচ্ছে। সমাজে এক ফোঁটা দয়া নেই, মায়া নেই, ভালোবাসা নেই। একের দুঃখে দশের সাড়া নেই। ত্যাগ নেই, উৎসর্গ নেই। অন্যায়ের প্রতি ঘৃণা নেই। ন্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধা নেই। সত্যের কদর নেই। সততার মূল্য নেই। কিন্তু আফসোস! দেহ নিয়ে যে সভ্যতার এত টেনশন, আত্মার এই ত্রাহী অবস্থার দিকে একপলক চেয়ে দেখার ফুসরতও তার নেই।
এই সভ্যতার বিশেষজ্ঞরা স্বপ্ন দেখছে এমন যান্ত্রিক মানুষ তৈরি করতে যারা অবিকল আমাদের মতই হবে। আমাদের মতই হাঁটবে, বেড়াবে। দুঃখে কাতর হবে, আনন্দে বিভোর হবে। কিন্তু তাদেরকে বলুন, ‘ভাই, মানুষ তো এমনিতেই কম নেই। নতুন করে মানুষ বানানোর দরকার কী? আপনারা কেবল একটি কাজ করে দিন, পৃথিবীর মানুষগুলোর মধ্যে কীভাবে সততা, পরোপকারিতা ও ন্যায়নিষ্ঠতা জাগিয়ে তোলা যায় সে উপায়টা বাতলে দিন।’ দেখবেন তারা ‘হা’ করে চেয়ে থাকবে। কারণ তাদের গবেষণা, তাদের চিন্তা-ভাবনার ধারাটাই বস্তুকেন্দ্রিক। আত্মার সমাধান তাদের অজানা।
আত্মার সাথে ছিল ধর্মের সম্পর্ক। একমাত্র ধর্মই যুগে যুগে মানুষের দেহ ও আত্মার সুন্দর ভারসাম্যপূর্ণ সমাধান দিয়ে এসেছে। কিন্তু ‘মানুষ স্রষ্টার দাসত্ব করবে’- এটা এই যান্ত্রিক সভ্যতার দৃষ্টিতে বড়ই সেকেলে ঠেকল। এই সভ্যতা তার বস্তুকেন্দ্রিক প্রযুক্তিগত উন্নতির অংহকারে স্ফিত হয়ে স্রষ্টার অস্তিত্বই অস্বীকার করে বসল। বলল- ‘স্রষ্টা কে? যাকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, দেখা যায় না, সে আবার ‘থাকে’ কি করে? কাজেই স্রষ্টা নেই। আর থাকলেও তার দাসত্ব করার দরকার নেই। কারণ মানুষ এখন অত্যন্ত সবল! তারা পাহাড় কেটে রাস্তা বানাচ্ছে, গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সমুদ্রের তলদেশ থেকে স¤পদ তুলে আনছে। মেঘ থেকে বৃষ্টি ঝরাচ্ছে। কাজেই মানুষ এখন অনেক শক্তিশালী। দাসত্ব তার মানায় না!’
অথচ চেয়ে দেখুন- এই সভ্যতা আজ মানুষের ‘দেহ’কেই বানিয়েছে ‘দেবতা’। সেই দেবতাকে তুষ্ট করার জন্য মানুষ উদয়াস্ত ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে। কোথাও থামবার জো নেই, ঠান্ডা মাথায় বসে একটু ভাববার জো নেই যে, কোথায় ছুটেছি আমরা? কেন ছুটে চলেছি আমরা? কে আমাদেরকে এই ছোটাছুটিতে লিপ্ত করল? ‘জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন’ নামক মরীচিকার পেছনে ছুটতে ছুটতে মানুষ আজ পুরোদস্তুর দাসত্বের জীবনকে বরণ করে নিয়েছে। সে এখন দেহের দাস, ভোগের দাস, প্রবৃত্তির দাস, অর্থের দাস। অর্থ ও ভোগের পেছনে নিরন্তর ছুটে চলাই যেন তার ‘ধর্ম’। আবার স্রষ্টাকে যেহেতু ভুলে যাওয়া হয়েছে, পরকালের জবাবদিহিতার ভয় গেছে কেটে, সুতরাং এই ছোটাছুটিতে ন্যায়-অন্যায় বা নৈতিকতা-অনৈতিকতার বালাইও আর থাকল না।
আজ দার্শনিকরা বলছেন- অর্থনৈতিক সমস্যাই মানুষের মূল সমস্যা। শিশুকে শেখানো হচ্ছে, লেখাপড়া করে যে/গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে। তরুণ-তরুণীদেরকে শেখানো হচ্ছে- পরিশ্রম কর, ক্যারিয়ার গড়। যুবক-যুবতীকে শেখানো হচ্ছে- যত পারো টাকা কামাও, সঞ্চয় করো, গাড়ি-বাড়ি কেন, জীবনকে উপভোগ করো। মানুষ সেটাই করছে। আর এই উপভোগের পথে যে-ই কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সেই তার শত্রু হয়ে উঠছে। হোক না সে তার জন্মদাতা পিতা, গর্ভধারীণী মাতা, কিংবা ঔরসজাত সন্তান। তাই শুনি- একটি মোটর সাইকেল কিনে না দেওয়ার অপরাধে বাবাকে হত্যা করল পুত্র! কেন করবে না? সম্পর্কটা তো আত্মার নয়, দেহের ও বস্তুর; ভালোবাসার নয়, লেনদেনের। উপার্জনে অক্ষম বুড়ো বাপ-মায়ের তাই শেষ ঠিকানা হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রম। ভাই-ভাইয়ের জন্য জীবন দেওয়ার দিন শেষ হয়েছে। এখন এক বিঘত জমির জন্য ভাই ভাইকে হত্যা করছে। শিক্ষকের সম্মান? সে আবার কী কথা? কাড়িকাড়ি টাকাও নিবে আবার সম্মানও? দুর্নীতিটাই ‘নীতি’ হয়ে দাঁড়াচ্ছে দিনদিন। ‘ঘুষ’কে আদর করে ডাকা হচ্ছে ‘¯িপড মানি’। খুন-খারাবি বন্ধ হচ্ছে না কোনো কিছুতেই। হাজার টাকার বিনিময়ে চলন্ত যাত্রীবোঝাই বাসে পেট্রল বোমা ছুঁড়ে দিয়ে নিজের ‘জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের’ দিকে মনোযোগ দিচ্ছে রাস্তার বখাটে, চোর-ছ্যাঁচড়রাও। পুলিশের বিরুদ্ধেই গাড়ি গাড়ি অভিযোগ! টাকার বিনিময়ে হচ্ছে প্রতিবাদ! টাকার বিনিময়েই মুখে কুলুপ! রাজনীতি যেন আরেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, যেখানে হাজার হাজার ছেলে-মেয়ে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়ে নিচ্ছে, গাড়ি-ঘোড়া কিনছে! পরকাল যেহেতু নেই, কাজেই জবাবদিহিতার ভয়ও নেই। পৃথিবীর আইন আছে বটে, তবে তার ফাঁকও আছে। তাছাড়া যারা নিজেরাই আইন প্রয়োগ করেন তাদের তো সেই ভয়ও থাকার কথা নয়। বলবেন বিবেকের দংশন বলে তো একটা কথা আছে? না, তাও নেই। আত্মা খাদ্যের অভাবে মরে গেছে, কাজেই বিবেকের দংশনও নেই। আছে কেবল ‘চাই চাই আরও চাই, আরও চাই, আরও চাই . . .।’
হায়রে মানুষ! একটি কুকুরও তো সমাজের কিছু না কিছু উপকারে লাগে। কিন্তু এই পৃথিবীতে লক্ষ-কোটি মানুষ জন্মাচ্ছে, খাচ্ছে-দাচ্ছে, বংশবিস্তার করছে, জৈবিক চাহিদা মিটিয়ে মরে যাচ্ছে- সমাজের কোনো উপকারে লাগছে না- এই কি তবে মানবজীবন? এই কি আশরাফুল মাখলুকাতের জীবন? প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা দিয়ে এই সভ্যতা মানুষকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে বটে, কিন্তু সেই সাথে এও কি নিরেট সত্য নয় যে- আত্মিকভাবে, চারিত্রিকভাবে, নৈতিকভাবে সমগ্র মানবজাতিক সে ধ্বংস করে ফেলেছে?