মাহবুব আলী:
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত,
অভ্যূত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম,
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চঃ দুষ্কৃতাম,
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে
শ্রীকৃষ্ণ সখা অর্জুনকে বলছেন: হে ভারত! যখনই ধর্মের অধঃপতন হয় এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখন আমি নিজে শরীর ধারণ করে অবতীর্ণ হই। আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হয়ে সাধুদিগের পরিত্রাণ, দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ এবং ধর্ম সংস্থাপন করি। শ্রীগীতা ৪:৭/৮
মানবজাতি যেন পৃথিবীতে শান্তিতে বসবাস করতে পারে, মানবে মানবে হানাহানি, রক্তারক্তি, অন্যায়-অবিচার, যুলুম-অত্যাচার না করে সেজন্য সর্বযুগে, সর্বজাতিতে স্রষ্টা আল্লাহ ধারাবাহিকভাবে নবী রসুল (অবতার, মহামানব) প্রেরণ করেছেন। হাদিস পাঠে আমরা এক লক্ষ চব্বিশ হাজার বা মতান্তরে দু-লক্ষ চব্বিশ হাজার নবী রসুলগণের পৃথিবীতে আগমনের কথা জানতে পারি। এই সকল নবীদের মধ্যে আমরা কেবল ভারতীয়, চৈনিক ও সেমেটিক সভ্যতার আওতাধীন ভূখণ্ডে আগত নবীদের কথাই জানতে পারি, বাকি দুনিয়ার নবী-রসুলদের ইতিহাস হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। দ্বিতীয় আদম মনু অর্থাৎ নূহ (আ.) থেকেই মানবজাতি পৃথিবীতে বিস্তার লাভ করে। মানবজাতির আরেক মাইলফলক এব্রাহীম (আ.)। এই দুই মহামানবের বংশধারায় আল্লাহ বহু নবী রসুল পাঠিয়েছেন। তিনি পবিত্র কোর’আনে বলেছেন, আমি নূহ [মনু (আ.)] ও এব্রাহীমকে রসুলরূপে প্রেরণ করেছি এবং তাদের বংশধরের মধ্যে নবুয়ত ও কিতাব অব্যাহত রেখেছি (সুরা হাদীদ, ২৫-২৬)।
অতীতের প্রত্যেক নবী-রসুলগণ যে যে অঞ্চল ও জাতিতে আগমন করেছেন, সেই জাতি ও সেই জাতির ভাষাতেই তারা ওহী, এলহাম, দিব্যজ্ঞান, বোধি লাভ করে সেই অঞ্চলে একই ভাষা-ভাষীর মধ্যে প্রচারকার্য চালিয়েছেন। ঐসব ভাষা হিব্রু পার্শি, সংস্কৃত, পালি, চীনা বা অন্য যে কোন ভাষাই হোক না কেন। এ যামানার এমাম জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীকে মহান আল্লাহ এ সমস্ত গ্রন্থাদির মাধ্যমে বহু বিকৃত ইতিহাসের ভিড় থেকে বহু অমূল্য সত্যের সন্ধান দান করেছেন, যার প্রেক্ষিতে তিনি ভারতীয় বেশ কয়েকজন মহামানবকে যথা বুদ্ধ, শ্রীকৃষ্ণ, মহাবীর, যুধিষ্ঠির, মনু, চৈনিক মহামানব তাও, কনফুসিয়াস, গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস ভাববাদী মহামানবদেরকে নবী হিসাবে ঘোষণা দান করেছেন। কিন্তু এই মহামানবদের অনুসারীরা আজ পৃথক পৃথক জাতিসত্তার রূপ নিয়েছেন। আল্লাহর শেষ রসুল এসে এই সকল জাতিকে একজাতিতে পরিণত করার জন্য আহ্বান জানাতে আরম্ভ করলেন। তিনি বললেন, “গ্রন্থের অধিকারী সকল সম্প্রদায়, একটি বিষয়ের দিকে এসো যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সাধারণ, তা হলো- আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারও এবাদত করব না, তাঁর সাথে কোন অংশীদার সাব্যস্ত করব না, আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে প্রভু বলে মানবো না (সুরা এমরান ৬৪)”। এটাই হচ্ছে মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার মূল সূত্র।
বর্তমানে স্রষ্টাহীন বস্তুবাদী সভ্যতার ধারক-বাহকরা মনে করে তারা হাজার হাজার বছর থেকে মানবহৃদয়ে লালিত ধর্মবিশ্বাসকে দূর করে ধর্মহীনতার উপরে মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করবে। এটা কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। বর্তমানে যতই উন্নতি প্রগতির কথা বলা হোক না কেন, মানবতা, সাম্যের কথা বলা হোক না কেন, ধর্মকে এড়িয়ে সেই মানবতা, সাম্য কোনোদিনই প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। প্রচলিত বিকৃত ধর্মগুলিই এর পথে বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই বিকৃত ধর্মগুলি মানবজাতিকে হাজারো দলে উপদলে বিভক্ত করে রেখেছে এবং সেই ধর্মীয় বাধা অতিক্রম করা সহজ কথা নয়। মানবজাতির মধ্যে মানবতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে ধর্মীয় বিভেদগুলিকে চিহ্নিত করে সেগুলি মিটিয়ে দিতে হবে। সকল ধর্মের মূল ও সনাতন শিক্ষার মধ্যে বিন্দুমাত্রও প্রভেদ নেই। সেই শিক্ষার উপরেই মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। এটাই প্রাকৃতিক, বাস্তবসম্মত। অতীতে যতবার শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এই পথেই হয়েছে। কূপমণ্ডূক ধর্মব্যবসায়ীদের বিকৃত ধর্মের চর্চা দেখে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ধর্ম থেকেই মুখ ফিরিয়ে নেওয়া মূর্খতা। প্রতিটি ধর্মের অন্তর্নিহিত সত্যকে জেনে তার উপরে দাঁড় করাতে হবে নতুন শান্তিময় সত্যযুগের ইমারত।