মাননীয় এমামুযযামানের লেখা থেকে সম্পাদিত:
মহানবীর (দ:) ৬০/৭০ বছর পর থেকে প্রধানতঃ কী কী বিকৃতি প্রবেশ কোরে এই সর্বশ্রেষ্ঠ জাতিকে নিকৃষ্টতম জাতিতে পরিণত কোরল তা একটা একটা কোরে উপস্থিত কোরছি। কিন্তু সর্বক্ষণ মনে রাখতে হবে যে, সমস্ত বিকৃতির মূল হোল উদ্দেশ্যচ্যুতি, লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়া, আকিদা বদলে যাওয়া। যতদিন এই উম্মাহর সামনের উদ্দেশ্য-লক্ষ্য ঠিক ছিলো ততদিন তারা একাগ্র লক্ষ্যে (হানিফ) সামনে এগিয়ে গেছে। ছোটখাটো কোনো কিছুই তাদের দৃষ্টি ঘোরাতে পারে নি। কিন্তু যখন লক্ষ্য হারিয়ে গেলো তখন চলাও থেমে গেলো, চারদিকের নানা কিছু তখন চোখে পড়লো এবং তাই নিয়ে তারা মশগুল হোয়ে গেলেন, মহাকর্তব্য ভুলে গেলেন এবং ফলে বিভিন্ন বিকৃতি ঢুকে তাদের ধ্বংস কোরে দিলো।
প্রথম বিকৃতিঃ অতি বিশ্লেষণ, দীন নিয়ে বাড়াবাড়ি। পূর্ববর্তী প্রত্যেক নবী দুনিয়া থেকে বিদায় নেবার পর তাদের জাতির যার যার দীনকে নিয়ে সেটার ব্যাখ্যা, অতি ব্যাখ্যা, আরও অতি ব্যাখ্যা কোরতে শুরু কোরেছে। যার ফলে ঐ বিভিন্ন ব্যাখ্যার উপর ভিত্তি কোরে বিভিন্ন মতামত গড়ে উঠেছে। দীনের আসল উদ্দেশ্য, তার মর্মবাণী ভুলে যেয়ে ছোটখাটো বিভিন্ন ব্যবস্থা, ফতোয়া নিয়ে মতান্তর শুরু হোয়ে গেছে এবং কালে বহুভাগে ভাগ হোয়ে জাতিগুলির ঐক্য নষ্ট হোয়ে জাতি ধ্বংস হোয়ে গেছে। এর যেন পুনঃসংঘটন এই শেষ দীনেরও না হয় সেজন্য আল্লাহ সাবধান কোরে দিলেন এই বোলে যে, দীন নিয়ে বাড়াবাড়ি কোরো না (কোর’আন-সুরা আন নিসা ১৭১, সুরা আল মায়েদা ৭৭)। দীন নিয়ে বাড়াবাড়ি করার এই নিষেধের অর্থ কী? এর মানে কি এই যে, খুব ধার্মিক হোয়োনা বা দীনকে ভালোভাবে অনুসরণ কোরোনা, বা বেশি ভালো মোসলেম হবার চেষ্টা কোরো না? অবশ্যই তা হোতে পারে না। এই বাড়াবাড়ির অর্থ, ঐ অতি বিশ্লেষণ, জীবন-বিধানের আদেশ নিষেধগুলিকে নিয়ে সেগুলোর সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর বিশ্লেষণ। যদি জাতির সম্মুখ থেকে তাদের লক্ষ্যস্থল, গন্তব্যস্থল, উদ্দেশ্য-অদৃশ্য না হোয়ে যেতো তবে তারা আগের মতোই এক দেহ এক প্রাণ হোয়ে তাদের লক্ষ্য অর্জন করার জন্য আপ্রাণ সংগ্রাম চালিয়ে যেতেন। দুর্ভাগ্যক্রমে তা হয় নি। লক্ষ্য তারা ভুলে গেলেন এবং লক্ষ্য ভুলে যাওয়ার ফলেই ঐ সংগ্রামের কর্মশক্তি মোড় ঘুরে অন্য কাজে ব্যাপৃত হোয়ে পড়লো। যে জীবন-বিধানকে সমস্ত পৃথিবীময় প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দিয়ে আল্লাহ তাঁর শেষ নবীকে (দ:) পাঠিয়েছিলেন এবং যে দায়িত্ব তিনি তাঁর উম্মাহর উপর অর্পণ কোরে চোলে গিয়েছিলেন, উম্মাহও তা উপলব্ধি কোরে জীবনপণ কোরে সেই সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো, এক মহাশক্তিশালী বোমের মত ফেটে আটলান্টিকের তীর থেকে ৬০/৭০ বছরের মধ্যে চীনের সীমান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিলো, সেই জীবন বিধানকে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ছেড়ে দিয়ে ঐ জাতি ঐ বিধানগুলির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ আরম্ভ কোরে দিলো।
আদম (আ:) থেকে শুরু কোরে শেষনবী (দ:) পর্যন্ত আল্লাহ যে জীবন-বিধান মানুষের জন্য পাঠিয়েছেন, স্থান, কাল ভেদে সেগুলোর নিয়ম-কানুনের মধ্যে প্রভেদ থাকলেও সর্বক্ষণ ভিত্তি থেকেছে একটি মাত্র। সেটা হোচ্ছে একেশ্বরবাদ, তওহীদ, একমাত্র প্রভু, একমাত্র বিধাতা (বিধানদাতা) আল্লাহ। যার আদেশ নির্দেশ, আইন-কানুন ছাড়া অন্য কারো আদেশ, নির্দেশ, আইন-কানুন কিছুই না মানা। একেই আল্লাহ কোর’আনে বোলছেন দীনুল কাইয়্যেমা। আল্লাহ মানুষের কাছে এইটুকুই মাত্র চান। কারণ তিনি জানেন যে, মানুষ যদি সমষ্টিগতভাবে তিনি ছাড়া অন্য কারো তৈরি আইন-কানুন না মানে, শুধু তারই আইন-কানুন মানে তবে শয়তান তার ঘোষিত উদ্দেশ্য অর্থাৎ মানুষকে দিয়ে অশান্তি, অন্যায় আর রক্তপাত অর্জনে ব্যর্থ হবে এবং মানুষ সুবিচারে, শান্তিতে (ইসলামে) পৃথিবীতে বসবাস কোরতে পারবে- অর্থাৎ আল্লাহ যা চান। কত সহজ! কাইয়্যেমা শব্দটা এসেছে কায়েম থেকে যার অর্থ চিরন্তন, শাশ্বত, সনাতন। আল্লাহ এই দীনুল কাইয়্যেমার কথা বোলে বোলছেন- এর বেশি তো আমি আদেশ কোরিনি (কোর’আন- সুরা আল-বাইয়েনাহ্ ৫)। ‘এর বেশি তো আমি আদেশ করিনি’ তিনি বোলছেন এই জন্য যে, তিনি জানেন যে, ঐটুকু কোরলেই অর্থাৎ তাঁর বিধান ছাড়া অন্য কোনো বিধান মানুষ না মানলেই মানবজাতির মধ্যে পূর্ণ শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। এই সামান্য দাবিটুকুই তিনি মানুষের কাছে আদম থেকে আজ পর্যন্ত কোরে আসছেন। পূর্ববর্ত্তী বিকৃত জীবন-ব্যবস্থাগুলিতেও আল্লাহর দাবি ছিলো ঐ সহজ সরল দাবী- দীনুল কাইয়্যেমা, তওহীদ। ভারতীয় ধর্মের অনুসারীদের তারা কোন ধর্মে বিশ্বাসী জিজ্ঞাসা কোরলে তার জবাব দেবেন সনাতন ধর্ম। সনাতন এবং কাইয়্যেমা একার্থবোধক- যা চিরদিন প্রবাহমান, চিরন্তন ও শাশ্বত, এবং তা ঐ তওহীদ। এর গুরুত্ব এত বেশি যে একে আল্লাহ আমাদের জন্য শুধু প্রতি সালাতে নয় প্রতি রাকাতে অবশ্য কোরে দিয়েছেন সুরা ফাতেহার মধ্যে। “আমাদের সেরাতাল মুস্তাকীমে চালাও” মোস্তাকীম অর্থ সহজ, সরল ও শাশ্বত।
এইখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা এসে যায়, তাহোল আল্লাহ কোর’আনে আমাদের বোলে দিলেন যে, আমি তোমাদের একটি ভারসাম্যযুক্ত জাতি বানালাম। এই ভারসাম্যের সাথে সেরাতাল মোস্তাকীম ও দীনুল কাইয়্যেমা সংশ্লিষ্ট ও সম্বন্ধযুক্ত। সহজ, সরল চিরন্তন ছাড়াও সেরাতাল মোস্তাকীম শব্দের এক অর্থ হোল, মধ্যবর্তী, মাঝামাঝি- ঐ ভারসাম্যেরই অন্য অর্থ। আল্লামা ইউসুফ আলী এর অনুবাদ কোরেছেন ১) Straight (সরল) ২) Standard (মাঝামাঝি, মধ্যপন্থী) ৩) Definite (স্থির, নিশ্চিত) Permanent (চিরস্থায়ী শাশ্বত) (আল্লামা ইউসুফ আলীর কোর’আনের ইংরেজি অনুবাদ, নোট নং ৬২২৬)।
Standard অর্থটির দিকে লক্ষ্য কোরুন। এই অর্থ হোল মধ্যবর্তী, মাঝামাঝি, মানে সর্বোৎকৃষ্টও নয়, সর্বনিুও নয়, সেই মধ্যপন্থী, ভারসাম্যযুক্ত। অর্থাৎ দীনুল কাইয়্যেমা, সেরাতাল মোস্তাকীম আল্লাহ আমাদের দিয়ে আসছেন মানুষ সৃষ্টির প্রথম থেকে যা হোচ্ছে- ১) অত্যন্ত সহজ ও সরল, ২) মধ্যপন্থী ৩) চিরস্থায়ী শাশ্বত। এবং যে জাতি একে গ্রহণ কোরবে সে জাতি হবে ভারসাম্যযুক্ত (উম্মাতাও ওয়াসাতা) (কোর’আন- সুরা আল বাকারা ১৪৩)। একটা জাতির মধ্যে জ্ঞানী, চালাক, বোকা, সর্ব রকম মানুষই থাকবে, সব নিয়েই একটি জাতি। সুতরাং লক্ষ্য যদি জটিল হয় তবে সবার তা বোধগম্য হবে না। জাতির যে অংশটুকু শিক্ষিত ও মেধাবী, শুধু তাদেরই বোধগম্য হবে- সমগ্র জাতি একতাবদ্ধ হোয়ে ঐ লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রাম কোরতে পারবে না। তাই আল্লাহ ও তাঁর রসুল (দ:) যে জাতি সৃষ্টি কোরলেন তার ভিত্তি কোরলেন অতি সহজ ও সরল-তওহীদ, একমাত্র প্রভু হিসাবে তাকেই স্বীকার কোরে নেওয়া। এর নাম দিলেন দীনুল কাইয়্যেমা ও সেরাতাল মোস্তাকীম, চিরন্তন, সহজ-সরল পথ। এটাই যে সব কিছু তা বোঝাবার জন্য অবশ্য কর্তব্য (ফরজ) কোরে দিলেন প্রতি রাকাতে ঐ সেরাতাল মুস্তাকীমে চালাবার প্রার্থণা করা, যাতে প্রতিটি মোসলেমের সর্বক্ষণ এ সহজ-সরল পথের কথা মনে থাকে এবং ঐ সহজ সরলতার ভিত্তি ছেড়ে জটিলতার দিকে সরে না যায়। এবং জাতির লক্ষ্যও স্থির কোরে দিলেন অতি সহজ ও সরল-ঐ দীনুল কাইয়্যেমাকে, সেরাতাল মোস্তাকীমকে সংগ্রামের মাধ্যমে সমস্ত পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা কোরে পৃথিবীতে শান্তি (ইসলাম) প্রতিষ্ঠা করা। দুটোই বুঝতে সহজ। সহজ বোলেই বিশ্বনবীর (দ:) সৃষ্ট অত্যন্ত অশিক্ষিত জাতিটি, যার মধ্যে লেখাপড়া জানা লোকের সংখ্যা হাতে গোনা-যেতো তারাও ভিত্তি ও লক্ষ্য পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছিলেন এবং তা থেকে চ্যুত হোন নি এবং তারা সফলভাবে আল্লাহ রসুলের (দ:) উদ্দেশ্য সিদ্ধির পথে বহু দূর অগ্রসর হোয়েছিলেন। কিন্তু অতি বিশ্লেষণের বিষময় ফলে ঐ দীনুল কাইয়্যেমা, সেরাতাল মোস্তাকীম হোয়ে গেলো অত্যন্ত জটিল, দুর্বোধ্য এক জীবন-বিধান, যেটা সম্পূর্ণ শিক্ষা করাই মানুষের এক জীবনের মধ্যে সম্ভব নয়- সেটাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম তো বহু দূরের কথা। জাতি লক্ষ্যচ্যুত তো আগেই হোয়ে গিয়েছিলো, তারপর ফকিহ ও মুফাস্সিরদের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণের ফলে জাতির মধ্যে ভয়াবহ বিভেদ সৃষ্টি হোয়ে, বিভিন্ন মাযহাব ও ফেরকা সৃষ্টি হোয়ে যে অনৈক্য সৃষ্টি হোল তার ফলে পুনরায় একতাবদ্ধ হোয়ে সংগ্রাম করার সম্ভাবনাও শেষ হোয়ে গেলো। এই জন্য রসুলাল্লাহ (দ:) বোলেছিলেন আমার উম্মাহর আয়ু ৬০/৭০ বছর।