মাহবুব আলী :
মানুষসৃষ্টি থেকে আজ পর্যন্ত মানব জাতির সর্বপ্রধান সমস্যা হয়ে আছে একটি- সেটা হচ্ছে যুদ্ধ-বিগ্রহ, রক্তপাত, অবিচার, সামাজিক অবিচার, অর্থনৈতিক অবিচার, রাজনৈতিক অবিচার, সর্বরকম অবিচার, এক কথায় ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমা। মানুষ সৃষ্টির পর মালায়েকরা (ফেরেশতারা) এই অশান্তি ও রক্তপাতের কথাই আল্লাহকে বলেছিলেন আর ইবলিস আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল যে সে মানুষকে দিয়ে ঐ অশান্তি সৃষ্টি করাবে। আল্লাহ সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ইবলিসকে বলেছিলেন- আমি আমার নবী রসুলদের (আ.) পাঠিয়ে মানুষকে এমন রাস্তা দেখাব, এমন জীবনব্যবস্থা দেব যে জীবনব্যবস্থা সার্বিক জীবনে প্রতিষ্ঠা করলে, যে রাস্তায় চললে তারা ঐ অশান্তি থেকে মুক্তি পাবে, শান্তিতে থাকতে পারবে। কাজেই যে জীবন-বিধান তিনি মানুষের জন্য পাঠালেন তার নামই দিলেন ইসলাম, আক্ষরিক অর্থেই শান্তি। আদম (আ.) থেকে মোহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত ঐ একই নাম- ইসলাম।
যখন যে নবী আল্লাহ পাঠিয়েছেন তাকে আল্লাহ প্রেরিত বলে বিশ্বাস ও স্বীকার করে নিয়ে যারা ঐ বিধান মতে চলেছে তাদের মধ্য থেকে সব রকম অন্যায়, অবিচার, অশান্তি দূর হয়ে গেছে, তারা সেই চির আকাক্সিক্ষত শান্তি পেয়েছে। তারপর যখন ঐ জীবনব্যবস্থাকে ইবলিসের প্ররোচণায় বিকৃত করে ফেলেছে তখন মানুষ আবার সেই অশান্তির মধ্যে পতিত হয়েছে। এই হচ্ছে সমস্ত ধর্ম, দীন, জীবন-বিধানের আসল কথা, গোড়ার কথা। বাকি যা আছে, উপাসনা, ইবাদত সবই আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া। ঐ আসল, গোড়ার কথা বাদ দিয়ে অর্থাৎ সামগ্রিক জীবনে আল্লাহর দেয়া জীবন-বিধানকে অস্বীকার করে, মানুষের তৈরি বিধান মেনে নিয়ে যতো উপাসনা, ইবাদতই করা হোক- তাতে মানুষের সমষ্টিগত ও ব্যক্তিগত কোনো জীবনেই শান্তি আসবে না। সেটা ইসলাম হবে না, সেটা হবে খাঁটি শিরক, বহুত্ববাদ। এবং আল্লাহ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ যে, আর যতো রকম গোনাহ, পাপ, অন্যায় তিনি ইচ্ছা করলে মাফ করবেন, কিন্তু শিরক ও কুফর তিনি কখনও মাফ করবেন না (সুরা আন নিসা ৪৮, সুরা আরাফ ৩৬)।
এবার আমাদের বর্তমানের দিকে তাকানো যাক। সমস্ত পৃথিবীর কোথাও মানুষ স্রষ্টার দেয়া জীবনব্যবস্থা মেনে চলছে না। ঐ জীবন-ব্যবস্থাকে সমষ্টিগত জীবন থেকে বাদ দিয়ে সর্ব প্রথম পাশ্চাত্য খ্রিষ্টান জগত নিজেদের জন্য নিজেরা জীবন-বিধান তৈরি করে নিয়েছিল। তারাই যখন বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি, সামরিক শক্তির জোরে প্রাচ্যের মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি সব রকম জাতিকে পরাজিত করে তাদের উপর রাজত্ব করল, তখন তারা তাদের উপর নিজেদের তৈরি স্রষ্টা বিবর্জিত ঐ বিধান চাপিয়ে দিল। তাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ফলে এই জাতিগুলির এমন সুন্দর মগজ ধোলাই হলো যে, পাশ্চাত্য প্রভুরা পরে এদের ‘স্বাধীনতা’ দিয়ে চলে গেলেও তারা সবাই পূর্ব প্রভুদের ঐ শিরক, বহুশ্বর ব্যবস্থা নিজেদের সমষ্টিগত জীবনে চালু রাখল। মগজ ধোলাইর ফলে তারা এটা বুঝতে ব্যর্থ হলো যে, ঐ ব্যবস্থা মানুষে মানুষে সংঘর্ষ, যুদ্ধ, রক্তপাতের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। এর বাস্তব এবং নিশ্চিত প্রমাণ এই যে, ঐ প্রভুরা মাত্র ২৭ বছরের মধ্যে নিজেদের মধ্যে দুইটি মহাযুদ্ধ করেছে, ঐ যুদ্ধ দু’টিতে বাকি বিশ্বকেও জড়িয়ে ফেলেছে, প্রায় পনেরো কোটি মানুষকে হতাহত করেছে। অন্যান্য ধ্বংসের কথা বাদই দিলাম এবং বিজ্ঞানের ও প্রযুক্তির জ্ঞানকে তারা হত্যার কাজে ব্যবহার করে আজ এমন পর্যায়ে নিয়ে এসেছে যে, শুধু তারাই নয়, তাদের ঐ আত্মাহীন, বিবেকহীন নাস্তিক জীবন-ব্যবস্থার অনুসারী বাকি মানবজাতিকেও তাদের পেছনে পেছনে সার্বিক ধ্বংসের দোরগোড়ায় এনে দাঁড় করিয়েছে। পার্থিব জীবনে, জাতীয় জীবনে খ্রিষ্ট ধর্মের বিফলতার ফলে ধর্মকে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে সীমাবদ্ধ করে দেয়ার শিক্ষা অর্থাৎ এই শেখানো যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আইন-কানুন, দণ্ডবিধি ইত্যাদি জটিল ব্যাপার আল্লাহর বুঝার এবং বুদ্ধির বাইরে।
এই মগজ ধোলাই হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি ধর্মের অনুসারীদের উপর সাফল্যপূর্ণ হওয়াটা অতখানি আশ্চর্যজনক নয় যতোখানি এই মুসলিম জাতির উপর হওয়াটা। কারণ ঐ ধর্মগুলির মধ্যে হিন্দু ধর্মের (যদিও হিন্দু বলে কোন ধর্ম নেই, আসলে বৈদিক, সনাতন ধর্ম) মধ্যে জাতীয় ব্যবস্থা থাকলেও তা ছিল সীমিত, সমস্ত মানব জাতির জন্য প্রযোজ্য নয় আর বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি ধর্মের মধ্যে জাতীয় অর্থাৎ আইন-কানুন, রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক কোন ব্যবস্থা ছিল না। আর এই শেষ ইসলামে সমগ্র মানব জাতির জন্য জাতীয়, সমষ্টিগত ব্যবস্থা, আইন, দণ্ডবিধি, আদেশ নিষেধ এত প্রকট ও দীপ্ত যে, এই জাতি কী করে খ্রিষ্টানদের ঐ শিক্ষা ও মগজ ধোলাই মেনে নিতে পারলো তা সত্যি আশ্চর্যজনক। আকিদার কতখানি বিকৃতি হলে মানুষের সাধারণ জ্ঞানও লোপ পায় তার প্রমাণ এই ব্যাপারটা। এই শেষ ইসলামের একটি প্রধান অংশই হচ্ছে বিচার বিভাগীয় ও দণ্ডবিধি অর্থাৎ শরিয়াহ। এটা যার সামান্য পরিমাণ জ্ঞানও আছে তিনিও জানেন এবং রাষ্ট্রশক্তি ছাড়া যে ওগুলো প্রয়োগ করা সম্ভব নয়, তা বুঝতে যে সাধারণ জ্ঞান সেটুকুও কেমন করে এই জাতির লোপ পেলো তা আশ্চর্যজনক। খ্রিষ্ট ধর্ম ও রাজনীতির যে সুস্পষ্ট বিভাজন আছে হিন্দু ধর্মে তেমন বিভাজন সুস্পষ্ট আকারে নেই। আর ইসলামে আদৌ কোন বিভাজন নেই। কিন্তু যতোই আশ্চর্যজনক হোক সত্য এই যে, দু’চারটি দেশ ছাড়া (যেগুলো ভাগ্যক্রমে পাশ্চাত্যের সরাসরি দাস হওয়া থেকে বেঁচে গিয়েছিল) অন্যান্যের সঙ্গে সমস্ত মুসলিম দুনিয়া খ্রিষ্টানদের ঐ আকিদাকে তসলিম করে নিয়েছে যে, তাদের ব্যক্তি জীবনের বিধাতা, অর্থাৎ বিধানদাতা, ইলাহ হচ্ছেন আল্লাহ এবং জাতীয় জীবনের অর্থাৎ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শাসন, বিচার, দণ্ডবিধি ইত্যাদির বিধাতা, ইলাহ হচ্ছে পাশ্চাত্যের খ্রিষ্টান প্রভুরা, জুডিও খ্রিষ্টান সভ্যতা। এ যদি শিরক ও কুফর না হয় তবে শিরক বলে কোন শব্দ নেই।
আজকের ‘মুসলিম’ জগতের দিকে তাকালে যা দেখা যায় তা হচ্ছে বহু ভাগে বিভক্ত একটি জনসংখ্যা, একটা জাতি নয় একটি উম্মাহ নয়। আল্লাহ ও রসুলের (সা.) দেয়া জাতির সংজ্ঞা অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোন প্রভু, বিধানদাতা নেই এবং মোহাম্মদের (সা.) মাধ্যমে শেষ বিধান এসেছে, এই সত্যের বিশ্বাসীরা এক জাতি এক উম্মাহ, প্রত্যাখ্যান করে পাশ্চাত্য খ্রিষ্টানদের ভৌগোলিক অবস্থান, চামড়ার রং, ভাষা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে বিভক্ত হয়ে এবং তাদের দেওয়া জাতির সংজ্ঞাকে গ্রহণ করে পৃথিবীর সমস্ত মুসলিম নামের জনসংখ্যাটি কার্যতঃ মুশরিক ও কাফের হয়ে আছে। এর পরিণতি অবশ্য তারা এড়াতে পারছে না। এক সময়ের অর্ধ পৃথিবীর শাসনকর্তা এই জাতিটি আজ সমস্ত পৃথিবীজুড়ে আল্লাহর লা’নতের পাত্রতে পরিণত হয়েছে। এরা আর আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে গিয়ে শহীদ হয় না, এরা এখন ঘৃণিতভাবে জীবন হারাচ্ছে নিজেরা নিজেরা হানাহানি-মারামারি, বোমাবাজি করে; পাশ্চাত্য প্রভুদের অমানবিক নির্যাতনে। কাজেই এই জাতি আর প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদী যে এক জাতি নয় তা বুঝতে আত্মার চোখ ব্যবহার করতে হয় না, চর্মচক্ষুই যথেষ্ট। এমতাবস্থায় এই জাতির উচিত হবে নিজেরা নিজেরা শতমুখী সংঘাতে ডুবে না থেকে এই কুফর ও শিরক থেকে নিজেদের মুক্ত করা।