মসীহ উর রহমান:
মহান স্রষ্টা প্রাকৃতিক নিয়ম নীতির উপরে শাশ্বত জীবনব্যবস্থা, দীনুল হক ইসলাম তৈরি কোরেছেন। এই জন্য এই দীনের অপর নাম দীনুল ফেতরাহ (প্রাকৃতিক ধর্ম)। পৃথিবীর সর্বত্র সকল মানবজাতির জন্য এই জীবনব্যবস্থা সমভাবে প্রযোজ্য হবে, প্রয়োগযোগ্য হবে। এই জীবনব্যবস্থাটি সারা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব আল্লাহ প্রদান কোরলেন আখেরী নবীকে। এ কথা কোর’আনে নির্দিষ্ট কোরেই তিনি বোলে দিলেন যে, ‘আমি আমার রসুলকে সঠিক পথ প্রর্দশন (হেদায়াহ) এবং সত্যদীন দিয়ে প্রেরণ কোরলাম এই জন্যে যে তিনি যেন একে (এই হেদায়াহ ও জীবন ব্যবস্থাকে) পৃথিবীর অন্যান্য সমস্ত জীবন ব্যবস্থার উপর বিজয়ী করেন (কোর’আন-সুরা আল্ ফাতাহ- ২৮, সুরা আত তওবা- ৩৩ ও সুরা আস সফ- ৯)। অর্থাৎ পৃথিবীতে, মানব জাতির মধ্যে আল্লাহর শেষ রসুলকে প্রেরণের উদ্দেশ্য হোচ্ছে তাঁর মাধ্যমে হেদায়াহ, পথ প্রদর্শনসহ দীন পাঠানো এবং সেই হেদায়াহ ও দীনকে সমগ্র মানব জীবনে প্রতিষ্ঠা করা। কারণ সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায় যে দীন (জীবন ব্যবস্থা) যদি মানুষের জীবনে কার্যকরই না হয় তবে তা রসুলের মাধ্যমে পৃথিবীতে পাঠানো অর্থহীন। তাই আল্লাহ তাঁর রসুলকে যেমন হেদায়াহ- দিক নির্দেশনা ও সত্যদীন সহ প্রেরণ কোরলেন, তেমনি তাকে এই কাজ করার নীতি ও কর্মসূচিও দান কোরলেন। সেই নীতি হোচ্ছে জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম, জেহাদ। এই নীতির উপর ভিত্তি করা একটি ৫ দফা কর্মসূচি আল্লাহ তাঁর রসুলকে দান কোরলেন, যেন তিনি কর্মসূচি মোতাবেক তাঁর সংগ্রাম পরিচালনা করেন। এই ৫ দফা কর্মসূচি তিনি তাঁর উম্মাহর উপর অর্পণ করার সময় বোলছেন এই কর্মসূচি আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন, (আমি সারাজীবন এই কর্মসূচি অনুযায়ী সংগ্রাম কোরেছি) এখন এটা তোমাদের হাতে অর্পণ কোরে আমি চোলে যাচ্ছি। সেগুলো হোল :
(১) ঐক্যবদ্ধ হও।
(২) (নেতার আদেশ) শোন।
(৩) (নেতার ঐ আদেশ) পালন করো।
(৪) হেজরত করো।
(৫) (এই দীনুল হক কে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার জন্য) আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ (সর্বাত্মক প্রচেষ্টা) করো।
যে ব্যক্তি (কর্মসূচির) এই ঐক্যবন্ধনী থেকে এক বিঘত পরিমাণও বহির্গত হোল, সে নিশ্চয় তার গলা থেকে ইসলামের রজ্জু (বন্ধন) খুলে ফেললো- যদি না সে আবার ফিরে আসে (তওবা করে) এবং যে ব্যক্তি অজ্ঞানতার যুগের (কোনও কিছুর) দিকে আহ্বান কোরল, সে নিজেকে মোসলেম বোলে বিশ্বাস কোরলেও, নামাজ পোড়লেও এবং রোজা রাখলেও নিশ্চয়ই সে জাহান্নামের জ্বালানি পাথর হবে [আল হারিস আল আশয়ারী (রাঃ) থেকে আহমদ, তিরমিযি, বাব উল এমারাত, মেশকাত]।
দুর্ভাগ্যবশতঃ বিশ্বনবীর ওফাতের ৬০/৭০ বৎসর পর এবলিস এই উম্মাহর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের মধ্যে বিকৃতি ঢুকিয়ে দিতে সমর্থ হোল। যার ফলে এই জাতি আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ ও ঐ ৫ দফা কর্মসূচি দু’টোই ত্যাগ কোরে ইসলাম ও উম্মতে মোহাম্মদী দু’টো থেকেই বহি®কৃত হোয়ে গেলো। সেই থেকে এই কর্মসূচি যে পরিত্যক্ত হোয়েছিল এই তেরশ’ বছর ওটা পরিত্যক্ত হোয়েই ছিলো, শুধু তাই নয়, এই দীর্ঘ ১৩শ’ বছরে ক্রমে ক্রমে আল্লাহর দেওয়া সত্যদীনের রূপ, আকিদা বিকৃত হোতে হোতে একেবারে বিপরীতমুখী হোয়ে গেছে। আজ দুনিয়াময় যে ইসলামটি আমরা দেখছি সেটি আল্লাহর রসুলের প্রকৃত ইসলাম নয়, সেটি ইসলামের একটি বিকৃত খোলসমাত্র যার আত্মা নেই, রক্ত সঞ্চালন নেই। গত কয়েক শতাব্দীতে এই দীনকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টায় বিভিন্ন মোসলেম দেশগুলিতে শত শত দল, আন্দোলন, সংগঠন করা হোয়েছে, কিন্তু আকিদার বিকৃতির কারণে আল্লাহ তাদেরকে ঐ কর্মসূচি বুঝতে দেন নি। ফলে ঐ সব সংগঠনগুলি বিভিন্ন রকমের ও বিভিন্ন দফার কর্মসূচি নিজেরা তৈরি কোরে নিয়েছে। কোথাও কেউ সাফল্য লাভ করে নি, পৃথিবীর এক ইঞ্চি জমিতেও তারা ইসলামকে প্রতিষ্ঠা কোরতে পারেন নি, এবং ভবিষ্যতেও পারবে না। কারণ সবগুলোরই কর্মসূচি মানুষের মস্তিস্ক প্রসূত, আল্লাহর দেয়া নয়। ফলে তাদের ঐ প্রচেষ্টায় আল্লাহর কোন সাহায্য আসে নি, এবং ভবিষ্যতেও আসবে না। সারা পৃথিবীর মানবজাতিকে একটি মহাজাতিতে পরিণত করার জন্য যে কর্মসূচি আল্লাহ দিয়েছেন তার উপযোগিতা, সৌন্দর্য ও মাহাত্ম্য যথাসম্ভব সংক্ষেপে আলোচনা করার চেষ্টা কোরছি।
এই কর্মসূচিটির মধ্যে প্রথম তিনটি দফা অর্থাৎ ঐক্য, শৃঙ্খলা ও আনুগত্য হোচ্ছে জাতির বৈশিষ্ট্য, হেজরত হোচ্ছে পৃথক জাতিসত্তা সৃষ্টি ও জেহাদ হোচ্ছে ঐ জাতির গঠন, চরিত্র অর্জন ইত্যাদি সবকিছুর উদ্দেশ্য। সুতরাং প্রথম কাজ হোচ্ছে ঐক্য, শৃঙ্খলা ও আনুগত্য এই তিনটি চরিত্র অর্জন করা। এই চরিত্র সৃষ্টি হোলেই জাতির মধ্যে এমন এক শক্তির সঞ্চার হবে যার সামনে পৃথিবীর কোন কিছুই আর অসম্ভব বোলে থাকবে না। তখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরাশক্তিও তার সামনে মাথা নত কোরতে বাধ্য।
প্রথম দফা: ঐক্য
স্রষ্টা প্রাকৃতিক নিয়মে ঠিক কোরেছেন যে, ঐক্য অনৈক্যের উপরে জয়ী হবে। দশজন ঐক্যবদ্ধ লোক একশত জন ঐক্যহীন লোকের তুলনায় শক্তিশালী হবে, তাদের উপরে বিজয়ী হবে। এই উম্মাহকেও বিজয়ী হওয়ার লক্ষ্যে এই প্রাকৃতিক নিয়মটি আল্লাহ ব্যবহার কোরতে বোলছেন, তোমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে ধারণ করো, পরস্পর বিচ্ছিন্ন হোয়ো না (সুরা এমরান ১০৩)। যে সব কাজে ও কথায় উম্মাহর ঐক্য নষ্ট হবার সম্ভাবনা আছে যেমন শরিয়াহ নিয়ে অতি বিশ্লেষণ, তর্ক, মতভেদ, গীবত ইত্যাদি সে সব কাজকে আল্লাহর রসুল সরাসরি কুফর বোলে আখ্যায়িত কোরেছেন (হাদিস-আব্দাল্লাহ বিন আমর (রা:) থেকে- মুসলিম, মেশকাত)। লক্ষ্য করার বিষয়, মহানবী ঐক্যভঙ্গ করাকে কুফর বোলেছেন অর্থাৎ যারা ঐক্যভঙ্গ কোরবে তারা কাফের। দুর্ভাগ্যজনকভাবে রসুল চোলে যাওয়ার ৬০/৭০ বছর পর থেকেই এই জাতির ঐক্য বিনষ্ট হোয়ে যায় এবং জাতি শিয়া, সুন্নীসহ বিভিন্ন দলে, উপদলে, মাজহাবে, ফেরকায়, দলে উপদলে বিভক্ত হোয়ে পড়ে। গত কয়েক শতাব্দী ধোরে এই জাতি কেবলমাত্র বিভক্তই নয়, নিজেরা নিজেরা দাঙ্গা হাঙ্গামায় লিপ্ত রোয়েছে। এই কুফরী কাজ কোরে তারা দীন থেকে বহি®কৃত তো হোয়েছেই, পুরো জাতিটিকে অন্য জাতির গোলামে পরিণত কোরেছে। কারণ ঐ প্রাকৃতিক নিয়ম-টহরঃবফ বি ংঃধহফ, ফরারফব বি ভধষষ. সেই গোলামি আজও চোলছে। আজ এই জাতির যাবতীয় অনগ্রসরতার, পশ্চাদপদতার, হীনম্মন্যতার, দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ এই অনৈক্য। এককালে যারা সমগ্র পৃথিবীতে একক সামরিক পরাশক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হোয়েছিল, মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বের আসন, শিক্ষকের আসন অধিকার কোরেছিল সেই মোসলেম জাতিটি আজ দুনিয়ার অন্যান্য পরাশক্তিগুলির করুণার পাত্র।
এই জাতির আলেম, ফকীহ, আল্লামা, মুফতি, মোহাদ্দেস সকলের প্রতি একটি সরল প্রশ্ন, রসুলাল্লাহ প্রদত্ত এই কর্মসূচির মধ্যে আমরা আছি কি না। যদি না থাকি তবে কি লাভ হবে এই মোসলমান দাবি কোরে, নামাজ পড়ে, রোজা রেখে? মহানবীর কথা মোতাবেক তো আমাদের জাহান্নামের জ্বালানি পাথর হওয়া ছাড়া পথ নেই।
আমাদের আজকের অবস্থানের সঙ্গে তৎকালীন আরবের অবস্থার বিষ্ময়কর মিল রোয়েছে। তখনকার আরবজাতি ছিলো হানাহানি, দাঙ্গা-ফাসাদ, দারিদ্র্য, কুসংস্কার সব মিলিয়ে তদানিন্তন পৃথিবীর সবচেয়ে পশ্চাদপদ এবং চরম ঐক্যহীন একটি জনগোষ্ঠী। বাকি দুনিয়ার সকল পরাশক্তি আরবদেরকে অবজ্ঞার চোখে দেখতো। আরবরাও ঐ সব পরাশক্তির দিকে চোখ তুলে তাকানোর কথাও ভাবতে পারতো না, একজন রোমান সৈন্যকে ১৫ জন আরবের সমতুল্য গণ্য করা হোত। এই রকম একটি অনগ্রসর জাতিকে মহানবী এমন এক দুর্ভেদ্য, সীসা গলানো প্রাচীরের মতো ঐক্যবদ্ধ জাতিতে রূপান্তরিত কোরলেন যে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে ঐ আরবরাই হোয়ে গেলো বিশ্বের বুকে শ্রেষ্ঠতম জাতি। এই মহাবিজয় কোন মন্ত্রবলে হয় নি, প্রাকৃতিক নিয়মেই হোয়েছে। সেই প্রাকৃতিক নিয়মটি হোচ্ছে আল্লাহর দেওয়া উপরোক্ত কর্মসূচিটির বাস্তবায়ন। সেই শ্রেষ্ঠ জাতিটি আজ আবার তার আগের পর্যায়ে ফিরে গেছে এবং শত্র“দের গোলামে পরিণত হোয়েছে, মোসলেম নামধারী ১৬০ কোটির সুবিশাল জনসংখ্যাটি বহু ভৌগোলিক রাষ্ট্রে, রাজনৈতিকভাবে বহু মতাদর্শে বিভক্ত। ধর্মীয়ভাবে বহু ফেরকা, মাজহাব, আধ্যাত্মিকভাবে শত শত তরীকায় ছিন্নভিন্ন এবং এই সমস্ত দল উপদল নিয়ে নিজেদের মধ্যে হানাহানিতে লিপ্ত। তারা তাদের পাশ্চাত্য প্রভুদের সামরিক, অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত শক্তি-সামর্থ্য, আবিষ্কার ইত্যাদির দিকে অবাক বিষ্ময়ে মাছের মতো হা কোরে তাকিয়ে থাকে। প্রভুরাও চায় মোসলেমদেরকে এইভাবে পায়ের নিচে দাবিয়ে রাখতে, তারা যেন আবার নতুন কোরে ঐক্যবদ্ধ হোতে না পারে সেজন্য প্রভূরা জাতির সকল বিভক্তিকে আরও উষ্কে দিয়ে, নিজেদের তৈরি বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র ইত্যাদি প্রবেশ কোরিয়ে তাদের মধ্যে দাঙ্গা হাঙ্গামা এবং অশান্তি কায়েম কোরে রেখেছে।
কিন্তু যেহেতু আল্লাহর দেওয়া দীন প্রাকৃতিক, একে প্রতিষ্ঠার পথও প্রাকৃতিক। প্রাকৃতিক নিয়মগুলির কোন পরিবর্তন হয় না। তাই আজও যদি এই জাতিকে হৃত গৌরব ফিরে পেতে হয়, তাদেরকে সেই প্রাকৃতিক নিয়মটিই কাজে লাগাতে হবে। তাদের প্রথম কাজ হোচ্ছে, ‘আল্লাহর হুকুম ছাড়া আর কারও হুকুম মানবো না’ এই কথার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। দীন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটি আল্লাহর চিরন্তন নির্দেশ, তিনি বোলছেন- তিনি তোমাদের ক্ষেত্রে সেই পথই নির্দ্ধারণ কোরেছেন যার আদেশ তিনি দিয়েছিলেন, নূহকে (আ:), যা তিনি প্রত্যাদেশ কোরেছেন আপনার [মোহাম্মদ (দ:)] প্রতি, এবং যার আদেশ দিয়েছিলাম এব্রাহীম, মূসা ও ঈসাকে (আ:) এই মর্মে যে ‘তোমরা দীনকে প্রতিষ্ঠা করো, এবং তাতে অনৈক্য সৃষ্টি কোর না’ (সুরা শূরা ১৩)। সুতরাং জাতিকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা বর্তমানের এই অপমান লাঞ্ছনা ও গোলামির জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে চায় কি না। যদি চায় তবে প্রথম শর্ত, তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হোতে হবে। সেই ঐক্য যেন তেন ঐক্য নয়, আপৎকালীন ঐক্য নয়, সেই ঐক্য সীসা গলানো প্রাচীরের মতো ঐক্য (সুরা সফ- ৪)। মনে রাখতে হবে, ঐক্যই শক্তি, ঐক্যই মুক্তি, ঐক্যই প্রগতি আর বিভেদ, বিভাজন, মতভেদ, অনৈক্য হোচ্ছে দুর্বলতা যার ফল হোচ্ছে গোলামি, পরমুখাপেক্ষিতা, হীনতা ইত্যাদি।
২য় দফা: শৃঙ্খলা
যখন কিছু মানুষ কোন বিশেষ লক্ষ্য অর্জনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হবে তখন সর্বপ্রথম যেটা প্রয়োজন- তাদের মধ্য থেকে একজন ব্যক্তিকে নেতা হিসাবে গ্রহণ কোরতে হবে। যিনি হবেন যে কোন বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তদাতা এবং যিনি অবিসংবাদিত এবং যিনি আল্লাহ কর্তৃক পরিচালিত (এঁরফবফ), যিনি আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এমন একজন নেতা না থাকলে ঐক্য এক মুহূর্তও টিকবে না। এটা হোচ্ছে প্রথম শৃঙ্খলা। জাতির লোকজন তাদের রুজি রোজগার, জীবিকা (চৎড়ভবংংরড়হ) নিয়ে যতই ব্যস্ত থাকুন, অতন্দ্র প্রহরীর মতো তাদের কান পেতে রাখতে হবে তাদের নেতা কখন কি আদেশ, কি নির্দেশ দেন। আরবিতে এই দ্বিতীয় দফাটি হোচ্ছে ‘সামেয়ু’ বা শোনা। এটি একটি আরবি বাগধারা বা প্রকাশভঙ্গি। সতর্কতার সাথে কোন বিষয়ে সদা, সর্বদা সচেতন হোয়ে থাকা বোঝায়। এখানে এই সচেতনতা হোচ্ছে দু’টি বিষয়ে। একটি নেতার আদেশ শোনার প্রতি সদা সর্বদা কান খাঁড়া কোরে রাখা, নেতার কখন কি আদেশ হয় তা তৎক্ষণাৎ পালনের জন্য প্রস্তুত থাকা এবং অপরটি নিজেদের শৃঙ্খলা অটুট রাখা। এমন একটি জাতি তৈরি করা যারা তাদের জন্য পালনীয় আদেশ নির্দেশগুলির শেকলে নিজেদেরকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে এবং যে কোন পরিস্থিতিতে সেগুলি মেনে চলে। তাদের যতবড় ক্ষতিই হোক তবুও তারা কোথাও শৃঙ্খলাভঙ্গ করে না। সৃষ্টিজগতে যেমন বিধাতা একজন হওয়ায় কোথাও কোন বিশৃঙ্খলা নেই, তেমনি সমগ্র মানবজাতিতে যখন একজন মাত্র নেতা থাকবেন এবং সেই নেতা স্রষ্টার বিধান মোতাবেক হুকুম কোরবেন, তখন মানবসমাজেও প্রতিষ্ঠিত হবে বিশ্বপ্রকৃতির ন্যায় অতুলনীয় শৃঙ্খলা, সঙ্গতি ও সমন্বয় (উরংপরঢ়ষরহব, ড়ৎফবৎ ্ যধৎসড়হু)। রসুলাল্লাহ মোমেনের শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনের উদাহরণ দিতে গিয়ে বোলেছেন, ‘মো’মেন ব্যক্তি হোচ্ছে নাকে রশি লাগানো উট সদৃশ, যে দিকে রশি যায় সে দিকে সে যায়।’
৩য় দফা: নেতার আনুগত্য
কর্মসূচির অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হোচ্ছে আনুগত্য। এই দীনে আনুগত্য হোল, আদেশ শোনামাত্র বিন্দুমাত্র ইতঃস্তত না কোরে সঙ্গে সঙ্গে সে আদেশ পালন করা। আনুগত্য হোচ্ছে একটি পরিবার, গোষ্ঠী বা জাতির মেরুদণ্ড, এটা যেখানে দুর্বল সেখানেই অক্ষমতা এবং ব্যর্থতা। এ নির্দেশ শুধু রসুলেরই নয়, এ নির্দেশ স্বয়ং আল্লাহর। তিনি তাঁর কোর’আনে মো’মেনদের, উম্মতে মোহাম্মদীকে আদেশ কোরেছেনÑ আল্লাহর আনুগত্য করো, তাঁর রসুলের আনুগত্য করো এবং তোমাদের মধ্য থেকে আদেশকারীর (নেতার) আনুগত্য করো (সুরা নেসা ৫৯)। আদেশকারীর অর্থ, সংগঠন বা জাতীর মধ্যে থেকে যিনি নেতা নিযুক্ত হবেন এবং আনুগত্য (এতায়াত) অর্থ দ্বিধাহীনভাবে, আদেশের সঙ্গে সঙ্গে তা পূর্ণভাবে পালন করা, ঠিক যেভাবে সালাতের সময় এমামের (নেতার) তকবির অর্থাৎ আদেশের সঙ্গে সঙ্গে তা পালন কোরতে হয়। এই আয়াতে আল্লাহ তাঁর নিজের প্রতি আনুগত্য, তাঁর রসুলের প্রতি আনুগত্য ও নেতার প্রতি আনুগত্যের মধ্যে কোন শর্ত বা তফাৎ রাখেন নি; একই লাইনে, একই বাক্যে (ঝবহঃবহপব) এবং একই ধারাবাহিকতায় (ঈড়হঃরহঁরঃু) বোলে দিয়েছেন। আল্লাহর ঐ আদেশের প্রতিধ্বনি কোরে তাঁর রসুল বোলেছেন- যে আমার আনুগত্য ও অদেশ পালন কোরল সে আল্লাহর আনুগত্য ও আদেশ পালন কোরল, যে আমার আনুগত্য ও আদেশ পালন কোরল না, সে আল্লাহর আনুগত্য ও আদেশ পালন কোরল না এবং যে আদেশকারীর (আমীর, নেতার) আনুগত্য ও আদেশ পালন কোরল, সে আমারই আনুগত্য ও আদেশ পালন কোরল, যে আদেশকারীর (আমীর, নেতার) আনুগত্য ও আদেশ পালন কোরল না, সে আমারই আনুগত্যও আদেশ পালন কোরল না [আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বোখারী]। নির্দেশ পালন না করা হোলে ঐক্য ও শৃঙ্খলা যতোই নিখুঁত হোক সেটা অর্থহীন। আজকের পৃথিবীতে প্রায়শই দেখা যায়, কোন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান যখনই তার জাতিকে কোন আদেশ বা বিধান দেন, সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় এর বিরুদ্ধাচারণ ও সমালোচনা। কথিত আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এই বিরোধিতা অপ্রত্যাশিত বা অবৈধ কিছু নয় বরং এটা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বৈধ। এই ব্যবস্থায় ২টি ভাগ রাখা হোয়েছে। একটা সামরিক, একটা বেসামরিক। সামরিক বাহিনীতে ঈড়সসধহফবৎ (আরবিতে আমীর) আদেশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা পালন করা হয়, আর বেসামরিক নেতৃত্ব একটা হুকুম দিলে সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, ভাঙচুর শুরু হোয়ে যায়। সামরিক ও বেসামরিক জনগোষ্ঠীর কর্মকাণ্ড একেবারে বিপরীত অবস্থা কেন? ওখানে বিনা শর্তে আদেশ মানা হয় অর্থাৎ নেতার আনুগত্য করা হয় বিধায় এত শৃঙ্খলা, এত সৌন্দর্য। আর নেতার আদেশ না মানার কারণেই যাবতীয় বিশৃঙ্খলা, অনৈক্য এবং পরিশেষে পতনের মূল কারণ। কিন্তু যেহেতু ইসলামের ভিত্তিই হোল আল্লাহ ছাড়া কোন হুকুমদাতা বা এলাহ নেই, আর আল্লাহ যেহেতু সকল পক্ষপাতিত্বের ঊর্দ্ধে, সবকিছুর ঊর্দ্ধে এবং ন্যায় বিচারক। তাই তাঁর আদেশ সকলের জন্য কল্যাণকর এবং ভারসাম্যপূর্ণ। আল্লাহর কোন আদেশের ব্যাপারে মতান্তর বা বিরোধিতার প্রশ্ন অবান্তর। আর নেতার আনুগত্যের ব্যাপারে রসুলাল্লাহ বলেন, ‘কোন ক্ষুদ্রবুদ্ধি, কান কাটা, নিগ্রো, ক্রীতদাসও যদি তোমাদের নেতা নিয়োজিত হয়, তবে তার কথা বিনা প্রশ্নে, বিনা দ্বিধায় শুনতে ও মানতে হবে।’ কারণ ঐ ব্যক্তি আল্লাহ এবং রসুলের প্রতিনিধি। তার আদেশ প্রকারান্তরে আল্লাহরই আদেশ।
এতক্ষণ যে তিন দফার কথা বোললাম (১) ঐক্যবদ্ধ হওয়া (২) নেতার আদেশ শোনা (৩) নেতার ঐ আদেশ সঙ্গে সঙ্গে পালন করা, আল্লাহ প্রদত্ত এই তিন দফা যদি কোন একটি জাতি পূর্ণরূপে তাদের চরিত্রে ও বাস্তবে কায়েম করে, তাহোলে বলা যায়- সে জাতি তারা আর কোন সাধারণ জাতি থাকবে না, একটি অসাধারণ বজ্রশক্তি সম্পন্ন জাতিতে পরিণত হবে। এটুকু নিশ্চিত কোরে বলা যায়, যে মুহূর্ত থেকে একটি জাতি এই তিন দফাকে তাদের চরিত্রে কায়েম কোরতে পারবে, সেই মুহূর্ত থেকে তারা একটি পরাশক্তিতে পরিণত হওয়া শুরু কোরবে এবং যদি এই চরিত্র তারা ধোরে রাখে তবে তারা অতি অল্পদিনে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম জাতিতে পরিণত হবে। এটা প্রাকৃতিক নিয়ম। আল্লাহর রসুল আসার আগের জাহেলিয়াতে আচ্ছন্ন আরব জাতির উদাহরণ একটু আগেই দিলাম। ঐক্য, শৃঙ্খলা ও আনুগত্যের শিক্ষা তাদেরকে অতি অল্প সময়েই বিশ্বের সবার উপরে অধিষ্ঠিত কোরেছিল।
আজকের এই আদর্শহীন, লক্ষ্যবিচ্যুত সমাজ ও জাতি থেকে যতোই অন্যায় অবিচার বন্ধ করার চেষ্টা করা হোক, হানাহানি বন্ধ করার চেষ্টা করা হোক, চেঁচামেচি করা হোক, এ দিয়ে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক জীবনে শান্তি আসবে না, শৃঙ্খলা আসবে না; এগুলোর ব্যর্থতা প্রমাণিত হোয়ে গেছে। অত্যন্ত সরল সূত্র হোচ্ছে- ঐক্যবদ্ধ না হোয়ে, সুশৃঙ্খল না হোয়ে এবং একজন অবিসংবাদিত নেতার নেতৃত্ব ছাড়া পৃথিবীতে কোন জাতিই শ্রেষ্ঠত্ব লাভ কোরতে পারে নি। এটা চিরন্তন, শাশ্বত প্রাকৃতিক নিয়ম। আজকের বিশ্বের একক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র যা ৫২টি অঙ্গরাজ্য নিয়ে গঠিত। যদি ঐক্য ভেঙ্গে প্রতিটি রাজ্য স্বাধীনতা ঘোষণা করে তবে একদিনের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র নামক পরাশক্তির পতন হবে। এটা সরল কথা।
দীর্ঘ তেরশ’ বছর এই উম্মাহকে এই পবিত্র কর্মসূচি থেকে মাহরুম, বঞ্চিত রাখার পর রহমানুর রহিম আল্লাহ তাঁর অসীম করুণায় তাঁর দেয়া কর্মসূচির পরিচয় হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা এমাম, এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। এতবড় অনুগ্রহ থেকেই প্রমাণ হয় যে হেযবুত তওহীদ আল্লাহর নিজের আন্দোলন। তিনি চান এই আন্দোলনের নেতৃত্বেই পৃথিবীর মানুষ আবার এক জাতিতে পরিণত হোক। কাজেই আমাদের বক্তব্য হোল, এখনই সময় সকল পথ, তরিকা, মত, মতবাদ, রংস, পৎধপু ইত্যাদি পরিত্যাগ কোরে একমাত্র আল্লাহর তওহীদের ভিত্তিতে সকলে সম্মিলিতভাবে সীসা গলানো প্রাচীরের মতো ঐক্যবদ্ধ হোই। তবেই দুনিয়ার জীবনের এই লাঞ্ছনা, অবমাননা দূর হবে এবং আখেরাতেও মুক্তি মিলবে।
লেখক: আমীর, হেযবুত তওহীদ,