প্রশ্ন: আমরা প্রায়ই দেখি দেশে ও দেশের বাইরে ইসলামবিদ্বেষী একটা শ্রেণি আল্লাহ-রসুলের বিরুদ্ধে কট‚ক্তি করে, কার্টুন আঁকে, চলচ্চিত্র নির্মাণ করে। যেমন আমাদের দেশে কিছুদিন আগে লতিফ সিদ্দীকী একটি মন্তব্য করেছিলেন, এর আগে দাউদ হায়দার, তসলিমা নাসরীনসহ অনেকে এধরনের বাজে মন্তব্য করেছে। আন্তর্জাতিকভাবে সালমান রুশদির কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। এ ধরনের ইসলামবিদ্বেষী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অধিকাংশ ইসলামি দল ও আলেম-ওলামা শ্রেণি প্রতিবাদ করেন, বিক্ষোভ করেন। এক্ষেত্রে আপনাদের নীতিমালা কী?
উত্তর:
মহান আল্লাহ ও তাঁর রসুলকে নিয়ে কট‚ক্তি করা হবে, গালাগালি করা হবে- এটা কোনো মো’মেন-মুসলিম কখনোই সহ্য করতে পারবে না, এটা স্বাভাবিক কথা। সাধারণত আমাদের পিতা-মাতাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করা হলেই আমরা সহ্য করতে পারি না আর যাঁর উপর আমরা ঈমান এনেছি, যাঁর জন্য আমাদের জীবন-সম্পদ কোরবান করে চলেছি, যাঁর সন্তুষ্টির উপর আমাদের অনন্তকালের জীবনের সুখ-শান্তি নির্ভর করছে, যাঁর প্রতি আমাদের অসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রয়েছে সেই মহান আল্লাহ ও তাঁর রসুলকে নিয়ে খারাপ মন্তব্য করা হলে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়, সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়, ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে যেতে বসে। আমরা এই কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানাই ও এটাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি। কিন্তু আমরা এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করি না। এক্ষেত্রে আমাদের কথা হলো- ইসলাম ও ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এমন বিরূপ মন্তব্য ১৪০০ বছরে অনেক হয়েছে, রসুলের সামনেও হয়েছে। সে ক্ষেত্রে তিনি কী নীতি অবলম্বন করেছেন? তিনি যে নীতি নিয়েছেন সেটিই হবে এ ক্ষেত্রে ইসলামের নীতি। আমরা সেই নীতিমালা বিশ্বাস করি, সেটিই অনুসরণ করি।
রসুলাল্লাহ (সা.) যখন মক্কায় তওহীদের দাওয়াত দিতে লাগলেন তখন মক্কার কাফের-মোশরেকরা তাঁকে পাগল, গণক, জাদুকর, ভণ্ড ইত্যাদি বলে গালাগালি করেছে। শুধু গালাগালি দিয়েই তারা ক্ষান্ত হয়নি, রসুলাল্লাহর উপর অসম্ভব নির্যাতন করেছে, উটের নাড়ি-ভুড়ি চাপিয়ে দিয়েছে, পাথর নিক্ষেপ করে রক্তাক্ত করেছে, হত্যার ষড়যন্ত্র করেছে এবং সর্বশেষ রসুলাল্লাহ ও তাঁর জাতিকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্য বার বার যুদ্ধ করেছে। খেয়াল করুন, আল্লাহর রসুল এক্ষেত্রে কী নীতি মেনে চলেছেন। তিনি এখনকার মতো বিক্ষোভ, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ করেননি, গালাগালি করার জন্য কারো উপর আক্রমণ করেননি, কাউকে হত্যা করেননি, কাউকে চাপাতি বা তলোয়ারের আঘাতও করেননি। প্রথমতো তিনি এগুলো এড়িয়ে গেছেন, সহ্য করেছেন, দ্বিতীয়ত তিনি যৌক্তিকভাবে, উপযুক্ত উপায়ে মিথ্যাচারের জবাব দিয়েছেন তৃতীয়ত তিনি মানুষকে নিরন্তর তওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন, মানুষকে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করে গেছেন। তিনি একবার বললে নিশ্চয় তাঁর সাহাবাগণ আবু জেহেলদের কারো না কারো মাথা তলোয়ার দিয়ে ধড় থেকে আলাদা করে দিতে পারতেন কিন্তু রসুলাল্লাহ এ নীতি নেননি। এক সময় মদীনার মানুষকে তিনি সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছেন, সেখানে হেদায়াহ ও সত্যদীন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁর জাতি শাক্তিশালী হয়েছে। সমগ্র আরব উপদ্বীপ রসুলাল্লাহর (সা.) অধীন হয়েছে। পৃথিবীতে এক নতুন অপ্রতিরোধ্য শক্তি হিসাবে আবিভর্‚ত হয়েছে উম্মতে মোহাম্মদী। রসুলাল্লাহর (সা.) ইন্তেকালের পর তাঁর জাতি অর্ধ পৃথিবীতে তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ প্রতিষ্ঠা করলেন। তখন তাঁর বিরুদ্ধে করা সকল অপপ্রচার মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে গেল, অন্য দিকে তাঁর জাতির শক্তির সামনে দাঁড়ানোর সাহস আর কারো রইল না। কাজেই তাঁর বিরুদ্ধে কট‚ক্তি করা তো দূরের কথা তাঁর ব্যাপারে যে কোনো মন্তব্য করতে গেলে দশবার চিন্তা করেছে সকলে। এটাই ছিল রসুলাল্লাহর বিরুদ্ধে করা মিথ্যাচার, কট‚ক্তি ও নিপীড়নের উপযুক্ত জবাব।
বর্তমানে আমরা দেখি ইসলাম নিয়ে, ইসলামের কোনো বিষয় নিয়ে বা আল্লাহ-রসুলকে নিয়ে কট‚ক্তি করা হলে সেটা নিয়ে একটা শ্রেণি মিছিল করে, বিক্ষোভ করে, সমাবেশ করে, সরকারি সম্পদ ধ্বংস করে, দোকানপাট ভাংচুর করে, অগ্নিসংযোগ করে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সংঘাতে লিপ্ত হয়, বিভিন্ন অফিস-আদালত ঘেরাও করে, চাপাতি দিয়ে কাউকে আবার হত্যা করা হয়। অর্থাৎ এর প্রতিক্রিয়া দেখাতে গিয়ে জনগণের ক্ষয়ক্ষতি করা হয়, দেশের সম্পদ ধ্বংস করা হয়, আইনশৃঙ্খলায় বিঘ্ন ঘটানো হয়। কিন্তু এর ফলাফল কী? এতে কি কট‚ক্তি বন্ধ হয়ে যায়? ইসলামের বিরুদ্ধে, মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রপাগাণ্ডা বন্ধ হয়ে যায়? না। বরং আগে যে গালাগালি হতো এখন তার চেয়ে আরও বেশি হচ্ছে। আমাদেরকে বুঝতে হবে- ইসলামের বিরুদ্ধে এই প্রপাগাণ্ডা, এই বিদ্বেষ কবে থেকে কীভাবে সৃষ্টি হলো। এটা মূলত ক্রুসেডের সময় থেকে ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। পুরো ইউরোপ জুড়ে তখন ব্যাপকভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও পরিকল্পিতভাবে প্রপাগাণ্ডা চালানো হয়েছে। ক্রমে সেই ইসলাম বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীব্যাপী। আমাদেরকে বুঝতে হবে সময়ের ব্যবধানে মুসলিম নামক জাতি মূল আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে অনৈক্য, হানাহানিতে লিপ্ত হয়েছে, দুর্বল হয়েছে। ঔপনিবেশিক যুগে সারা পৃথিবীর মুসলিম নামক জাতি পাশ্চাত্য জাতিগুলোর দাসে পরিণত হয়েছে। এখনো তারা নানা মাজহাব, ফেরকা, মতবাদ, দল-উপদলে বিভক্ত, অনৈক্য ও হানাহানিতে লিপ্ত। সারা পৃথিবীতে এখন তারা সবচেয়ে বেশি লাঞ্ছিত, অপমানিত, অবহেলিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত। যে যেভাবে পারছে এই জাতিকে ফুটবলের মতো লাথি মারছে, অপমান করছে। যখন আমরা অন্য জাতিগুলোর বুটের নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছি তখন আমাদের আগে ভাবতে হবে কীভাবে আমাদের জাতিকে গোলামীর জিঞ্জির থেকে মুক্ত করব, কীভাবে আমরা অপমান লাঞ্ছনার হাত থেকে জাতিকে বাঁচাবো, কীভাবে আমরা আবার শ্রেষ্ঠ জাতি হব।
কাজেই এখন বিক্ষোভ করে, মিছিল করে শুধু লোক দেখানো হবে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবে না। এখন আমাদেরকে রসুলাল্লাহর নীতি অনুসরণ করতে হবে। প্রথমত তাদেরকে উপেক্ষা করতে হবে, রসুলাল্লাহ সেটাই করেছেন এবং আল্লাহও কোর’আনে সেটাই বলেছেন (তাদের উৎপীড়ন উপেক্ষা করুন ও আল্লাহর উপর ভরসা করুন; সুরা আহযাব- ৪৮)। দ্বিতীয়ত তাদের প্রপাগাণ্ডা ও মিথ্যাচারের যৌক্তিক জবাব দিতে হবে উত্তম পন্থায়, মানুষের কাছে সত্য উপস্থাপন করতে হবে হেকমতের সাথে (সুরা নাহল- ১২৫)। তৃতীয় ও প্রধান কাজ হলো- জাতিকে তওহীদের ভিত্তিতে সত্য ও ন্যায়ের উপর ঐক্যবদ্ধ করা। যদি আমরা মুসলমানরা ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ হতে পারি তাহলে কারো সাহসই হবে না ইসলামের কোনো বিষয় নিয়ে বিদ্বেষ প্রচার করার। যারা দুর্বল তাদেরকে নিয়ে সবাই উপহাস করে, বিদ্রুপ করে। দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার এখন জগতের রীতি। ইহুদি-খ্রিষ্টান বস্তুবাদী সভ্যতা এখন অস্ত্রের শক্তিতে মহাশক্তিশালী হয়ে অহংকারে ফেটে পড়ছে। তারা ইসলামকে টার্গেট করেছে। দুনিয়া থেকে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য তারা প্রপাগাণ্ডা চালাচ্ছে। তারা মুসলমানদেরকে মানবজাতির সামনে জঙ্গি, সন্ত্রাসী, ক‚পমণ্ড‚ক ইত্যাদি বলে প্রচার করছে। একে একে মুসলমান নামক দেশগুলো তারা ধ্বংস করে দিচ্ছে। কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারছে না, একটা ভূখণ্ড রক্ষা করতে পারছি না, আমাদের মা-বোনদের রক্ষা করতে পারছি না। এখন তাদের গালাগালিকে অবলম্বন করে যদি চাপাতি মারা হয় তবে তারা বোমা মারবে, মুসলমানরা আত্মঘাতি বোমা বিস্ফোরণ করলে তারা পারমাণবিক বোমা নিয়ে প্রস্তুত। কাজেই উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই, অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় সুচিন্তিতভাবে সঠিক নীতি অবলম্বন করতে হবে যেটা রসুলাল্লাহর দেখানো নীতি। আমরা সেটাই করছি। মনে রাখতে হবে, ইসলামবিদ্বেষীরা ইসলামের বিরুদ্ধে যে প্রপাগান্ডা চালায় তার ভিত্তি কিন্তু প্রচলিত বিকৃত ইসলামের ধ্যানধারণা ও ইসলামের ইতিহাসের অপব্যাখ্যা। তারা কোর’আনের বিভিন্ন আয়াত তুলে এনে বোঝানোর চেষ্টা করে যে দেখ, ইসলাম কীভাবে সন্ত্রাসের শিক্ষা দেয়। দেখ, আল্লাহর রসুল কেমনভাবে বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকারের বিরুদ্ধবাদী ছিলেন, কী নিষ্ঠুর মানুষ ছিলেন ইত্যাদি। তাদের এই মতবাদগুলো প্রমাণ করার জন্য তারা কোর’আন, সহিহ হাদিসগ্রন্থ, প্রাথমিক যুগের ইতিহাসগ্রন্থের পাশাপাশি জঙ্গিবাদীদের বর্তমান রূপকে দলিল হিসাবে ব্যবহার করে। তারা বোঝাতে চায় যে, জঙ্গিরাই ইসলামের সাচ্চা অনুসারী, ইসলামের প্রকৃত শিক্ষাটি এমনি করেই মানুষকে সন্ত্রাসীতে রূপান্তরিত করে। ধর্মবিশ্বাস তাই একটি ভাইরাস। তাদের এইসব অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আমাদের আলেম ওলামারা কোনো যৌক্তিক প্রতিরোধ দাঁড় করাতে পারেন না। কারণ ইসলামবিদ্বেষীরাও তো কোর’আন হাদিস থেকেই উদ্ধৃত্তি দিচ্ছে, তার বিরুদ্ধে আলেম ওলামারা যাবেন কী করে? যেখানে যুক্তি হার মানে সেখানেই অন্ধভাবে শক্তির প্রয়োগ শুরু হয়। কিন্তু এ যুগটি যুক্তির যুগ, বিজ্ঞানের যুগ। এই যুগে মানুষের উপর যুক্তিহীন কিছু অন্ধত্ব চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে লাভ হবে না। মানুষ সেগুলো গ্রহণ করবে না। ইসলামবিদ্বেষীদের মতাদর্শ দিয়ে তাই প্রতিনিয়ত যুক্তিশীল মানুষ প্রভাবিত হচ্ছেন, তারাও মনে মনে ইসলাম বিদ্বেষী, ধর্মবিদ্বেষী হয়ে উঠছেন, ধর্মের বিলোপ আশা করছেন। আমাদের আলেম ওলামারা যুগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চেষ্টা করছেন, হুঙ্কার দিয়ে, ফতোয়া দিয়ে যুক্তিশীলতাকে দাবিয়ে রাখার ব্যর্থ প্রয়াস করে যাচ্ছেন। কিন্তু আসলে এসব চেষ্টা ইসলামবিদ্বেষীদের পক্ষেই যাচ্ছে। ইসলামের প্রকৃত ব্যাখ্যা, ইসলামবিদ্বেষীদের প্রদর্শিত যুক্তির পাল্টা ও সত্য যুক্তি আমাদের কাছে আছে, এই অকাট্য যুক্তিগুলো আলেমদের কাছে নেই, মাদ্রাসায় ওগুলো শেখানো হয়নি। বিকৃত ইসলামের দ্বারা তারা
নিজেরাও ধর্মের ব্যাপারে অন্ধ, গোড়ামিতে পূর্ণ। আমরা চেষ্টা করছি ইসলামবিদ্বেষীদের অভিযোগগুলোর জবাবগুলো উপস্থাপন করতে। যেমন তারা বলে থাকেন, ১. আল্লাহর বিধান নারী জাতিকে বাক্সবন্দী করেছে এবং তাদেরকে ভোগের বস্তুতে পরিণত করেছে, ২. উম্মতে মোহাম্মদী সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন চালিয়েছিল, ৩. কোর’আন ও সুন্নাহ জঙ্গিবাদ শিক্ষা দেয়, ৪. ইসলাম জোর করে ধর্মান্তরকরণে উৎসাহী করে, ৫. ইসলাম দাস ব্যবস্থাকে বিলুপ্ত করে নি, ৬. জিজিয়া সংখ্যালঘুদের উপর একটি সাম্প্রদায়িক নির্যাতন ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা হেযবুত তওহীদ পাশ্চাত্যের ইসলামবিদ্বেষীদের আরোপিত এ ধরনের বহু প্রচলিত অপবাদের যৌক্তিক ও প্রামাণিক খণ্ডন করেছি। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি ইসলামের প্রকৃত রূপটি, প্রকৃত ব্যাখ্যাগুলো মানুষের সামনে উপস্থাপন করতে যেন একাধারে ধর্মান্ধতা ও ধর্মবিদ্বেষ দুটোই নির্মূল হয়ে যায়। এটাই হচ্ছে আমাদের প্রতিবাদের ভাষা।