হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম
আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় আমাদের আন্দোলনে নাকি কোন শিক্ষিত লোক নেই। আমাদের আন্দোলনে কৃষক, শ্রমিক, রিকশাওয়ালা অর্থাৎ সমাজের নিম্ন শ্রেণির মানুষদের আনাগোনা বেশি। আলেমরাও বলেন আমাদের আন্দোলনে কোন বড় আলেম, মুফতি প্রমুখ ব্যক্তিত্ব নেই।
তাদের এই অহংকারের জবাবে আমরা বলব আমাদের আন্দোলনে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত অনেক লোক রয়েছে কিন্তু সেটা কোন প্রচারণার বিষয় নয়। শিক্ষা আজ যেন অহংকারের বিষয়ে পর্যবসিত হয়েছে। শিক্ষার মূল লক্ষ্য এখন আর মানবতার কল্যাণ নয়, দেশের সেবা নয়। আজ যারা মাদ্রাসা ও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছে তাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য কী? যদি ধরে ধরে জিজ্ঞেস করা হয় তবে এমন কাউকে পাওয়া যাবে না যে সে তার এই অর্জিত জ্ঞান দ্বারা কোন স্বার্থ উদ্ধার করবে না, তার প্রজ্ঞা ও বুদ্ধি দ্বারা সে মানবতার কল্যাণে কাজ করবে। প্রত্যেকেরই শিক্ষিত হওয়ার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে টাকা কামাই করা, এর জন্য যে কোন কাজ করতে তারা রাজি এমনকি দেশকেও তারা এ স্বার্থ হাসিলের জন্য বিক্রি করে দিতে পারে। অনেকে মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করে বিরাট শিক্ষিত হচ্ছেন, বড় আলেম হচ্ছেন, মুফতি হচ্ছেন, মুহাদ্দিস হচ্ছেন, আল্লামা হচ্ছেন, শায়েখ হচ্ছেন। বলতে গেলে বর্তমানে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা থেকে ডিগ্রিধারী শিক্ষিতদের অভাব নেই।
আসুন এবার ইতিহাস দেখি। আল্লাহর রসুলের আর মক্কার কুরাইশদের মধ্যকার যে হুদাইবিয়ার সন্ধি সাক্ষরিত হয় সেখানে আলী ইবনে আবু তালিব (রা.) আল্লাহর রসুলের নাম লেখার সময় ‘মুহাম্মাদুর রসুলাল্লাহ’ লিখলেন। কাফেরদের পক্ষ থেকে আমর বিন সোয়াইদ এ ব্যাপারে আপত্তি তুললেন এবং বললেন যে, “মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ লিখ, যদি ‘মুহাম্মাদ’ নামের পর ‘রসুলাল্লাহ’ শব্দটি থাকে তবে তোমাদের সাথে তো আমাদের আর কোন দ্ব›দ্বই থাকে না। আলী ইবনে আবু তালিব (রা.) এ কাজ করার ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানালেন। তিনি রসুলাল্লাহ শব্দটি কিছুতেই কাটতে চাইলেন না। এর মাধ্যমে রসুলের প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার নিদর্শন পাওয়া যায়। রসুল আলী (রা.) মনের অবস্থা জানতেন তাই তিনি তাঁকে আর বাধ্য করলেন না। রসুল জিজ্ঞেস করলেন কোথায় ‘রসুলাল্লাহ’ শব্দটি লেখা রয়েছে। আলী (রা.) যখন দেখিয়ে দিলেন তখন রসুল তাঁর পবিত্র হাত দিয়ে শব্দটি কেটে দিলেন।
আল্লাহ তাঁর রসুলের কাছে প্রথমবার যখন ওহী প্রেরণ করলেন তখন প্রথম শব্দটি ছিল, ‘পড়’। এর অর্থ হচ্ছে জানো, বুঝো, শিখো। এরপর তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে একদল মো’মেনদের নিয়ে ঐক্যবদ্ধ একটি জাতি গঠন করলেন। সর্বশেষে তিনি যখন বিদায় হজের ভাষণে লক্ষাধিক সাহাবাদের সামনে ভাষণ দিলেন তখন সেখানে শিক্ষিত লোক ছিল হাতে গোনা চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ জন। তবুও বর্তমানের শিক্ষিতদের মতো এত স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসায় পড়ে নি। তারা বড়জোর বংশের নাম পড়তে পারতেন, চুক্তি পড়তে পারতেন, লিখতে পারতেন। কবিতা, সাহিত্য ইত্যাদি পড়তে ও লিখতে পারতেন। এমনকি হাজারের চেয়ে বেশি সে সংখ্যা হতে পারে সেটাও অনেকে জানতেন না। ইতিহাস থেকে একটি অংশ তুলে ধরছি। খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) তখন ইরাকে মুসলিম বাহিনীর প্রধান। হিরার রাজকুমারী ছিলেন কিরামা বিনতে আবদুল মসি। রসুলাল্লাহ একদিন গল্প করার সময় পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের ব্যাপারে কথা উঠলে তিনি বলেন যে হিরা একদিন মুসলমানদের দখলে হবে। তখন এক সরলমনা সাহাবা শুবিল জিজ্ঞেস করেছিলেন যে হিরা বিজয় হলে সে কি সেখাকার রাজকুমারীকে পাবে যে কিনা তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে সুন্দরী নারী? আল্লাহর রসুল হেসে সম্মতিসূচক বাক্য বলেছিলেন। সেই হিরা যখন বিজয় হল তখন শুবিল কমান্ডারের কাছে গিয়ে সে কথা বললে কমান্ডার সাক্ষিদের মাধ্যমে ব্যাপারটি নিশ্চিত করলেন ও হিরার রাজপরিবারে সে ঘোষণা পাঠিয়ে দিলেন। হিরার রাজকুমারী ততদিনে বৃদ্ধা হয়ে গিয়েছেন তাই শুবিল তাকে দেখে রীতিমত অবাক হল এবং তার বদলে এক হাজার দিরহাম মুক্তিপণ চাইল। হিরার রাজকন্যা এ কথা শুনে মনে মনে হাসলেন আর ভাবলেন মূর্খ আরব! রানির মুক্তিপণ মাত্র এক হাজার! তিনি সেটা দিয়ে নিজেকে মুক্ত করলেন। বাহিনী প্রধান খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) এ কথা শুনে এক গাল হেসে নিলেন কারণ শুবিলের এক হাজারের চেয়ে বেশি যে সংখ্যা রয়েছে তা জানা ছিল না। এই ছিল তৎকালীন উম্মতে মোহাম্মদী জাতির অবস্থা। যে জাতি লেখাপড়া জানতো না সে জাতি কিসের পরশে অর্ধপৃথিবীতে সত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল? সে কোন শিক্ষা যে শিক্ষা তাদের সমগ্র দুনিয়ার শিক্ষকের আসনে আসীন করল?
লেখাপড়া জানে না, ভালো পোশাক নেই কিন্ত মো’মেন হয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সর্বাত্মক সংগ্রাম করে গোটা অর্ধ দুনিয়ায় সত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল সেই জাতি। এরপর আমরা হলাম শিক্ষিত। বাগদাদে, স্পেনে, আলেপ্পোতে আমাদের শত শত মাদ্রাসা। ভলিউম ভলিউম বইয়ের স্তুপের নিচে আমরা নিজেদের চাপা দিলাম। ফিকাহ, হাদিস, তাফসির, সূ²াতিসূ² মাসলা মাসায়েলের উপর আমরা হলাম মহা পণ্ডিত। কিন্তু তারপর কী হল? হালাকু খানের মার খেলাম, স্পেন থেকে আমাদের সমূলে বিনাশ করা হল। এক হাজার বছর পর যখন ইংরেজরা এ জাতিকে পদানত করল তখন এ জাতির মধ্যে হাজার হাজার পীর, সাধক, আলেম। কিন্ত জাতি ইতোমধ্যেই ব্রিটিশদের গোলাম।
আমি আপনাদের আহ্বান করব হৃদয় খুলে আমার কথা উপলব্ধির চেষ্টা করুন। আমাদের বর্তমান একশ ষাট কোটির জাতিতে লক্ষ লক্ষ আলেম, মুফতি, মুহাদ্দিস, আল্লামা, শায়েখ, হাফিজ, তাফসিরবিদ, ভাষাবিজ্ঞানী, আরবি ভাষার পণ্ডিত। আমি একটি কথা বললে তারা আমার কথার মধ্যে আরবি উচ্চারণগত দশটি ভুল বের করেন। অহংকারে আজ তাদের পা মাটিতে পড়ে না। কিন্তু এ অহংকারে লাভ কী? পাশ্চাত্য পরাশক্তিদের চেয়ে পণ্ডিত হতে পারবেন? পারবেন না কারণ বর্তমানে যে ইসলামের উপর পণ্ডিত হয়ে আপনারা অহংকার করছেন, আরবি ভাষা অতি শুদ্ধভাবে বলতে পেরে অন্যকে হেয় করছেন, সে ইসলাম আপনারা শিখেছেন খ্রিষ্টানদের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা থেকে। অন্যদিকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজ্ঞ, বিশেষজ্ঞ হয়ে বসে আছেন কিন্তু পুরো জাতি গোলাম। সমগ্র পৃথিবীর কোথাও জাতি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না। সিরিয়াতে আজ গণকবর, লিবিয়ায় দুর্ভিক্ষ, আফগানিস্তান ধ্বংসস্তুপ, আফ্রিকায়, মায়ানমারে হাজার হাজার লোককে হত্যা করা হচ্ছে কিন্তু কেউ কোন প্রতিবাদ করতে পারছে না। এত পাণ্ডিত্য দিয়ে আমাদের কী লাভ হচ্ছে?
এখন আমাদের করণীয় হচ্ছে তওহীদকে আঁকড়ে ধরা। জ্বী, এটাই আমাদের একমাত্র কথা। কালেমার, আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম মানবো না, ভিত্তিতে আজ আমরা ঐক্যবদ্ধ হব। আমরা নিজেদের জীবন-সম্পদ আল্লাহর পথে উৎসর্গ করে, মানবতার পথে উৎসর্গ করে মো’মেন হব। পৃথিবীর কোন শক্তিকে আমরা পরোয়া করব না, কোন অন্যায়ের সামনে মাথানত করব না। যেমনটি আল্লাহর রসুল কাফেরদের সামনে বলেছিলেন। তাঁর এক হাতে চন্দ্র ও অপর হাতে সূর্য এনে দিলেও তিনি তওহীদ প্রত্যাখ্যান করবেন না। যদি আমরা মো’মেন হতে পারি তবে আল্লাহ কোর’আনে ওয়াদা দিয়েছেন যে তিনি আমাদের বিজয়ী করবেন। দু’টি জিনিস যা আল্লাহর রসুলের সাহাবারা করেছেন ও আল্লাহ তাঁদের বিজয়ী করেছেন। প্রথমটি তওহীদ, আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম না মানা ও দ্বিতীয়টি জীবন-সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় পূর্ণরূপে ব্যবহার করে সর্বাত্মক সংগ্রাম করা। এ দুটি জিনিস থাকলে আমরা হব মো’মেন। আর যদি আমরা মো’মেন হতে পারি তবে আল্লাহ কোর’আনে ওয়াদা দিয়েছেন যে তিনি আমাদের বিজয়ী করবেন। এই কারণেই রসুলের সাহাবাদের সামনে তৎকালীন পরাশক্তিরা তুলোর মতো উড়ে যায়।
আমরা হেযবুত তওহীদ সেই মো’মেন হওয়ার দিকে আপনাদের আহ্বান করছি। আমরা শিক্ষার বিরুদ্ধে নই। শিক্ষার অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে। প্রথমে মো’মেন হতে হবে এরপর সে মো’মেন হবে শিক্ষিত। মো’মেন তার সে শিক্ষাকে মানবতার কল্যাণে ব্যবহার করবে। আজকের শিক্ষিতরা খাদ্যে ভেজাল দিচ্ছে, ঔষধে বিষ মেশাচ্ছে। এরা শিক্ষিত নয়। শিক্ষিতদের রূপ এমন হয় না। আল্লাহর রসুল ও তাঁর সাহাবীরা যে আদর্শ ও শক্তির বলে অর্ধ দুনিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল সেই একই আদর্শ ও শক্তি আল্লাহ আবার মাননীয় এমামুয্যামানের মাধ্যমে হেযবুত তওহীদকে দিয়েছেন। ইনশা’আল্লাহ, একদিন দেখবেন যাদের শ্রমিক, কৃষক, রিক্সাওয়ালা ইত্যাদি বলে হেয় করছেন, নিজেদের জ্ঞানের জন্য অহংকার করছেন, তারাই একদিন সত্যের পতাকাতলে সমগ্র দুনিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে। মনে রাখবেন, পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ বলেছেন, “যাদেরকে দুর্বল করে রাখা হয়েছিল, আমার ইচ্ছা হল তাদের প্রতি অনুগ্রহ করার, তাদেরকে নেতা করার ও তাদেরকে উত্তরাধিকারী করার (সুরা কাসাস ৫)।”
লেখক: এমাম, হেযবুত তওহীদ