মুস্তাফিজ শিহাব
বর্তমান সমাজের দিকে যদি আমরা তাকাই তবে স্পষ্ট দেখতে পাবো যে আমাদের সমাজের জনগণ শান্তিতে নেই এবং তারা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। একজন মানুষ জন্মগতভাবেই স্বাধীন এবং জন্মের পর থেকেই তার অন্যতম চাহিদা হয়ে দাঁড়ায় শান্তি ও নিরাপত্তা। শুধু মানুষ নয় অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রেও বিষয়টি একই। কিন্তু সেই শান্তি ও নিরাপত্তা যখন একটি সমাজে থাকে না তখন সেই সমাজ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে। তখন সেই সমাজকে পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। একটি সমাজ একক কোনো ব্যক্তি দ্বারা তৈরি হয় না তাই সমাজ পরিবর্তনের এই সিদ্ধান্তও একক কোনো ব্যক্তির একার পক্ষে নেয়া সম্ভব নয়। সে কারণে প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া।
আমাদের সমাজ যে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে তা প্রমাণ করার প্রয়োজন পড়ে না। পত্র-পত্রিকার পাতা খুললেই আমাদের চোখে পড়ছে বিভিন্ন অন্যায় সংঘটিত হওয়ার সংবাদ। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, খুন, ছিনতাই ইত্যাদিতে জর্জরিত আমাদের চারপাশ। মাত্র ৫০ টাকার জন্য একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে হত্যা করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। ধর্ষণ ছড়িয়ে পড়েছে মাত্রাতিরিক্তভাবে। দিনকেদিন বেড়েই চলছে ধর্ষণের ঘটনা। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১১ সালে সারা দেশে ৬২০ জন, ২০১২ সালে ৮৩৬ জন, ২০১৩ সালে ৭১৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়।
নারী ধর্ষণের পাশাপাশি বেড়েছে শিশু নির্যাতনও। আমরা এমন এক পরিস্থিতিতে এসে উপনীত হয়েছি যেখানে দুই বছরের শিশুও সুরক্ষিত নয়। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে ৮৬ জন, ২০১৩ সালে ১৭৯ জন, ২০১৪ সালে ১৯৯ জন, ২০১৫ সালে ৫২১ জন, ২০১৬ সালে ৪৪৬ জন এবং ২০১৭ সালে ৫৯৩ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আবদুস শহীদ মাহমুদ তাদের বার্ষিক শিশু অধিকার পরিস্থিতি-২০১৭ পর্যালোচনা করে ‘স্টেট অফ চাইল্ড রাইটস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলেন, ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে শিশু হত্যা এবং ধর্ষণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। ২০১৭ সালে ৩৩৯ জন শিশু হত্যা এবং ৫৯৩ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে যা ২০১৬ সালের চেয়ে ২৮ শতাংশ ও ৩৩ শতাংশ বেশি।
স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নিরাপত্তাহীনতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু এর কারণ কী? এই অনিরাপদ অবস্থার জন্য আপনি হয়তো সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দোষারোপ করতে পারেন আবার অনেকে এর সাথে জনগণের সচেতনতার অভাব এ বিষয়টিও তুলে ধরতে পারেন কিন্তু আমি শুধুমাত্র এই তিনিটি বিষয়ের উপর দোষারোপ করে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে পারছি না। সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছে নিরাপত্তা প্রদান করার, জনগণও বেশ সচেতন হয়েছি কিন্তু তবুও এই নিরাপত্তাহীনতা কমছে না। এর কারণ একটিই। আদর্শের অভাব।
বস্তুগত সভ্যতায় বাস করতে করতে আমরা এমন এক পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছি যেখানে আমরা আদর্শগত বিষয়গুলো, নীতি-নৈতিকতা ইত্যাদিকে রীতিমত বিসর্জন দিয়ে ফেলেছি। আমাদের কাছে আরামে থাকা ও শান্তিতে থাকা একই বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু একজন কোটিপতি ব্যক্তি আরামে থাকলেও সে শান্তিতে রয়েছে এ কথা কেউ বলতে পারবে না, এমনকি সে নিজেও স্বীকার করবে যে সে শান্তিতে নেই। আদর্শের অভাবে আমাদের মধ্যে আত্মিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে যার দরুণ আমরা ব্যক্তি জীবনে যেমন অশান্তিতে রয়েছি তেমনি সামাজিক জীবনেও চলছে অশান্তি ও নিরাপত্তাহীনতা। অস্ট্রিয়ান নিউরোলজিস্ট সিগমুন্ড ফ্রয়েডের (Sigmund Freud) একটি তত্ত্বের (theory) কথা এখানে উল্লেখ করছি। মানুষের প্রতিটি ঘটনা তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। প্রথমটি হচ্ছে তার সহজাত প্রবৃত্তি। উদাহারণ স্বরূপ বলা যায় ধরুন আপনি একটি আম বাগানের নিচ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। বাগানটিতে পাকা আমের গন্ধ মো মো করছে। এ সময়ে আপনার সহজাত প্রবৃত্তি বলবে আপনার আম খাওয়া উচিত। দ্বিতীয় যে বিষয়টি হচ্ছে সেটি হচ্ছে যুক্তিবোধ। সহজাত প্রবৃত্তি থেকে যদি আপনি সিদ্ধান্ত নেন আম খাবেন তবে অন্যের বাগানের আম খাওয়ার জন্য আপনি নিজেই বিভিন্ন যুক্তির মাধ্যমে আম খাওয়ার বিষয়টিকে সিদ্ধ করতে পারেন। সর্বশেষ যে বিষয়টি সেটি হচ্ছে আপনার আদর্শ। যদি আপনার মধ্যে আদর্শের প্রভাব বেশি হয়, নীতি-নৈতিকতা থাকে তবে আপনি অন্যের বাগানের আম নাও খেতে পারেন। না বলে কাজটি করা অন্যায় হবে এমনটি ভেবেও আপনি সেখান থেকে চলে আসতে পারেন। মূলত মস্তিস্কে এই তিনটি বিষয়ই থাকে এবং এই তিনটি বিষয়ের উপর ভিত্তি করেই মানুষ সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেই অনুযায়ী কাজ সম্পাদন করে। সহজাত প্রবৃত্তি থেকে উৎপন্ন একটি ইচ্ছাকে যুক্তিবোধ সহায়তা করে। আপনার ইচ্ছা অনুযায়ী তখন যুক্তি পরিচালিত হয়। কিন্তু সর্বশেষ যে আদর্শিক দিক সেটি একটি নির্দিষ্ট ধারায় চলে। আপনার মধ্যে নীতি-নৈতিকতা, বিবেকবোধ, আদর্শ থাকলে আপনি অনেক অন্যায় থেকেই নিজেকে বিরত রাখতে পারবেন।
বর্তমানে আমাদের সমাজের মানুষগুলো আদর্শিক শূন্যতায় ভুগছে। তারা তাদের সহজাত প্রবৃত্তির বসবর্তি হয়ে বিভিন্ন অন্যায় করে বসে কারণ তাদের মধ্যকার সেই নীতি-নৈতিকতা, বিবেকবোধ নেই যা কিনা তাদের সেই কাজ থেকে প্রতিহত করতে পারে। একটি অন্যায় করার পর অনেকের বিবেকবোধ জাগ্রত হয়, বিবেকের দংশনে দংশিত হয়ে সে পরবর্তীতে সে কাজটি করে না। কিন্তু আমাদের সমাজে এ ঘটনা এখন বেশ বিরল। তাহলে এখন আমাদের করণীয় কী হবে? বর্তমানের দাজ্জালীয় সভ্যতার প্রভাবে আমরা যেভাবে আত্মিকভাবে শূন্য হয়ে পড়েছি তাতে করে আমাদের সমাজের দশা দিনকে দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে। সহজাত প্রবৃত্তি ও সেই প্রবৃত্তিকে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে যুক্তিবোধ মানুষের মধ্যে সর্বদাই ছিল ও থাকবে কিন্তু আদর্শ মানুষ একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে অর্জন করে। মানুষ এই আদর্শের শিক্ষা লাভ করে পরিবার থেকে, সমাজ থেকে, ধর্ম থেকে। অতএব এখন আমাদের একমাত্র করণীয় হচ্ছে একটি সঠিক আদর্শ গ্রহণ করা যার মাধ্যমে আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি এবং সেই প্রবৃত্তিকে বাস্তাবায়ন করার যুক্তিগুলো নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এই তিনটি বিষয়ের ভারসাম্য একজন মানুষকে সঠিকভাবে চলতে সহায়তা করে।
মানুষ দেহ ও আত্মার সমন্বয়ে গঠিত একটি সৃষ্টি। সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যতই প্রচেষ্টা করুক শুধু মাত্র আইন ও শৃঙ্খলার কঠোরতা দ্বারা মানুষকে বাঁধতে পারবে না। মানুষের মধ্যকার আদর্শিক উন্নতি যদি সাধিত না হয় তবে মানুষ সকল কঠোরতা থাকা সত্ত্বেও অন্যায় করবে। এ জন্য বর্তমান সমাজকে পরিবর্তনের প্রথম ধাপ হিসেবে আমাদের এই আত্মাহীন, বস্তুবাদী দাজ্জালীয় সভ্যতাকে ছুঁড়ে ফেলতে হবে। স্রষ্টা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং সৃষ্টি করেই তিনি ক্ষান্ত হননি। তিনি মানুষকে ঠিকভাবে চলার জন্য যুগে যুগে নবী-রসুলদের মাধ্যমে ব্যবস্থা (System) প্রেরণ করেছেন। সেই ব্যবস্থায় বরাবরই শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ যে জীবন ব্যবস্থা প্রেরিত হয় তা অর্ধ দুনিয়ায় শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হয়েছিল যার সাক্ষী ইতিহাস। একটি অন্যায়ের কোনো বিবরণ সেখানে নেই। জনগণ এতটাই শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে বসবাস করত যে মাসের পর মাস আদালতে কোনো বিচার আসত না। দুই একটি চুরি বা ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেও আদর্শগত দিক থেকে উন্নত হওয়ায় তারা নিজেরাই তা স্বীকার করত এবং যেচে এসে শাস্তির জন্য ফরিয়াদ করত। প্রকৃত ইসলামের আদর্শ তাদের এতটা বিবেকবান করে তুলেছিল। আমি কোনো গল্প বলছি না যারা ইতিহাস সম্পর্কে জানেন তারা আমার সাথে একমত হবেন এবং যারা জানেন না তারা দয়া করে ইতিহাস খুলে দেখবেন। নারীদের অধিকার বলবৎ ছিল, অধিকারের নামে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা ছিল না। একজন নারী একা শত শত মাইল পথ হেঁটে যেতে পারত তার সম্মান নষ্ট হওয়ার কোনো ভয় ছিল না।
অতএব আমাদের আদর্শ লাগবেই এবং যদি আদর্শ গ্রহণই করতে হয় তবে প্রকৃত ইসলামের আদর্শ থেকে উত্তম আদর্শ নেই। কারণ সেই আদর্শ দ্বারা একবার অর্ধ পৃথিবীতে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অতএব এখন আপনাদের বিষয়টিকে নিয়ে ভাবতে হবে এবং গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। আমাদের তৈরি তন্ত্র-মন্ত্রগুলো যখন আমাদের শান্তি প্রদান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে তখন ¯্রষ্টার ব্যবস্থা নিয়ে দেখতে অসুবিধা কোথায়? সিদ্ধান্ত পুরোটাই আপনাদের হাতে।
(লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, facebook/glasnikmira13)