রিয়াদুল হাসান:
ষড়যন্ত্রের রঙ্গমঞ্চ আফগানিস্তানে ধর্মের অপব্যবহার:
পূর্ব প্রকাশের পর: ঠাণ্ডা যুদ্ধ কিন্তু সব জায়গায় ঠাণ্ডা থাকেনি, কোথাও কোথাও তা শ্যুটিং ওয়ারেও রূপ নিয়েছে- যেমন আফগানিস্তান। কম্যুনিস্ট মতবাদকে ভূলুণ্ঠিত করার প্রচেষ্টার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করল সোভিয়েত শাসনাধীন এলাকার মুসলমানদেরকে কম্যুনিস্ট রাশিয়ার বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতি ও স্বাধীনতার চেতনাকে ব্যবহার করতে। আফগানিস্তানে এক দশক দীর্ঘস্থায়ী যে যুদ্ধ (১৯৭৯-১৯৮৯) হয় সেটা ছিল কোল্ড ওয়ারেরই অন্তর্ভুক্ত। এটি বাহ্যত ছিল আক্রমণকারী রুশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের কম্যুনিস্ট-বিরোধী গেরিলাদের যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে আফগানিস্তানের স্বাধীনতাকামী জনগণের কাছে অস্ত্র সরবরাহ করে এবং তাদেরকে প্রশিক্ষিত করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত করে।
ভৌগোলিক স্বাধীনতা বা ভূখণ্ডরক্ষার যুদ্ধগুলিতে অধিকাংশ জনগণকে সম্পৃক্ত করার জন্য ঐ জাতির মধ্যে বিরাজিত বিভিন্ন চেতনাকে কাজে লাগানো হয়। যেমন কেউ কেউ বর্ণভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে কাজে লাগিয়েছেন, যেমন: নেলসন ম্যান্ডেলা, মার্টিন লুথার কিং প্রমুখ। কেউ কেউ ভাষাকে কাজে লাগিয়েছেন, যেমন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। আবার কেউ কেউ ধর্মকেও কাজে লাগিয়েছেন। কিন্তু আদতে এ সবই ছিল স্বাধীনতার আন্দোলন, কেবল যেখানে যে ফ্যাক্টরটা বেশি ফলপ্রদ সেখানে সেটাই ব্যবহৃত হয়েছে। ভারতবর্ষের স্বাধিকার আন্দোলনে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ছাড়াও হিন্দু, মুসলমান, শিখ জাতীয়তাবাদী সহিংস/অহিংস দল অনেক ছিল। ক্রুসেডের সময় ইউরোপিয় জাতিগুলিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত করার জন্য খ্রিস্টধর্মকে ব্যবহার করেছিল রাজ্যগুলির রাজন্যবর্গ ও ধর্মব্যবসায়ীরা। রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আফগানদেরকে এই অসম যুদ্ধে লিপ্ত করার জন্যও যুক্তরাষ্ট্র ধর্মকে ব্যবহার করেছে।
আফগানরা প্রায় শতভাগ জনগোষ্ঠী ইসলাম ধর্মের অনুসারী, তারা অন্যান্যদের মত নামকাওয়াস্তে মুসলমান না, তাদের ধর্মচেতনা গভীর এবং তারা জাতিগতভাবেও কঠোর পরিশ্রমী ও সাহসী। পৃথিবীর সমস্ত মোসলেম দেশগুলোর মধ্যে বর্তমান পরিস্থিতিতেও আফগানিস্তান ধর্মীয় অনুভূতির দিক দিয়ে সর্বাগ্রে। ইসলামের অবমাননা করে কেউ কিছু করলে সবচেয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায় আফগানিদের মধ্যে। এই চেতনা এখন অনেকটা হ্রাস পেয়ে গেলেও আফগান-রাশিয়া যুদ্ধের সময় তা এখনের তুলনায় বহুগুণ বেশি ছিল। সেই যুদ্ধে একদিকে তদানীন্তন সুপারপাওয়ার রাশিয়ার সাথে তাদের প্রশিক্ষিত লক্ষ লক্ষ সেনা, কমান্ডো, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, ট্যাংক, জঙ্গি বিমান ইত্যাদি ইত্যাদি। অন্যদিকে একটি দরিদ্র দেশের “অশিক্ষিত” জনগণ- যারা কিনা মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, কৃষক-শ্রমিক, দিনমজুর, রাখাল। সাথে তাদের সামান্য কিছু ভাঙ্গা বন্দুক, কাটা রাইফেল, পাহাড়ের গুহার কামারখানার তৈরি ছুরি-চাকু-পিস্তল আর আছে গরুমারার লাঠি। যুদ্ধে আনুমানিক ১৫ লক্ষ আফগান প্রাণ হারিয়েছে যার সিংহভাগই ছিল বেসামরিক জনতা [Noor Ahmad Khalidi, “Afghanistan: Demographic Consequences of War: 1978-87,” Central Asian Survey, vol. 10, no. 3, pp. 101–126, 1991। রুশ বিমানগুলো নির্বিচারে আফগানিস্তানের গ্রামের পর গ্রাম জনশূন্য করে দিয়েছে, বৃষ্টির মত বোমাবর্ষণ করেছে সাধারণ মানুষের ওপর। কেবল স্থল মাইন পেতে দুই লক্ষের উপর মানুষ হত্যা করেছে, চার লক্ষকে করেছে পঙ্গু, অচল। পরবর্তী প্রজন্মকে প্রতিবন্ধী বানিয়ে দেওয়ার জন্য খেলনা বোমা ফেলে রেখেছে দেশের সর্বত্র, যেন শিশুরা আকৃষ্ট হয়ে সেগুলিতে হাত দেয় এবং বিস্ফোরণের শিকার হয়। রাশিয়া প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২০০ কোটি টাকা খরচ করে দীর্ঘ ১০ বছর যুদ্ধ পরিচালনা করে। এতে করে রাশিয়ার অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যায়, রুবলের মান বাংলাদেশের টাকার চেয়ে অনেক নিচে নেমে যায়। এ নিয়ে কৌতুকও চালু হয়েছিল- যেমন: কেউ যদি প্রশ্ন করে, রুবল, ডলার ও পাউন্ডের পার¯পরিক বিনিময় হার কত? এর উত্তর হবে, এক পাউন্ড রুবল = এক ডলার।
বিভিন্ন মোসলেম দেশ থেকে লাখ লাখ যুবক আফগানিস্তানে ছুটে গিয়েছিল আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করার জন্য। তারা কি বুঝেছিলেন যে, এটা জেহাদ ফি সাবিলিল্লাহ নয়, এটি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাথের্র যুদ্ধ, এ যুদ্ধে আল্লাহ-রসুলের কিছু আসে যায় না? বুঝতে পারেননি, কারণ এই যুবকদেরকে প্রাণদানে উদ্বুদ্ধ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র মোসলেম দেশগুলিতে হাজার হাজার ধর্মব্যবসায়ীকে ভাড়া করছিল যারা তাদের যার যার দেশের যুবকদেরকে যুদ্ধে যোগদানের জন্য উত্তেজিত ও সংঘটিত করেছিল। তারা বলত যে এটা যুদ্ধ নয়, জেহাদ ও কেতাল ফি-সাবিলিল্লাহ। আমাদের দেশেরও একজন বিখ্যাত মোফাসসের তিনিও শত শত ওয়াজে তখন কম্যুনিজম ও কম্যুনিস্ট রাশিয়ার বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়েছেন, জেহাদী প্রেরণা সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছেন। যদিও মার্কিনি পুঁজিবাদী গণতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তখন তিনি কী কী তৎপরতা দেখিয়েছেন সেটা আমাদের জানা নেই।
মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম. সাখাওয়াত হোসেন তার “আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের ইতিকথা: আফগানিস্তান হতে আমেরিকা” গ্রন্থে লিখেছেন,
“আফগান জেহাদে যোগদানকারী আরবদের মধ্যে মিশরের জেহাদীদের সংখ্যায় ছিল বেশি। এর কারণ সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য ইসলামের পুনঃজাগরণের প্রচেষ্টার সাথে মিশরের উত্তর হতে দক্ষিণ পর্যন্ত গোপন সংস্থাগুলো তৎপর রয়েছে বেশি। তদুপরি আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যাপিঠে সমগ্র মুসলিম জনগোষ্ঠী থেকে ছাত্ররা একত্রিত হয় উচ্চ শিক্ষার জন্যে। এখানে পরিচিত হয় ইসলাম প্রবর্তনের তথাকথিত অগ্রগামী ধর্মীয় গুরুদের সাথে।”
জঙ্গিবাদের স্রষ্টা যে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটিশ প্রভৃতি বিশ্বমোড়ল এ বিষয়টি এখন এতই সুস্পষ্ট যে বিষয়টিকে ওপেন সিক্রেট বললেও বেশি বলা হয়। আফগানিস্তানে বিভিন্ন মোসলেম দেশ থেকে যে মোজাহেদরা এসেছিলেন তাদেরকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ওসামা বিন লাদেন, আব্দুল্লাহ আজ্জাম প্রমুখ যারা আজ মিডিয়ার বদৌলতে ইতিহাসের অন্যতম ঘৃণিত ব্যক্তি। এমনিভাবে আজকের যত সন্ত্রাসী নেতাদের নাম উল্লেখ করা হচ্ছে তাদের বেশিরভাগই আফগান ছায়াযুদ্ধের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন প্রাক্তন অথবা নবীন যোদ্ধা। মার্কিনি গোয়েন্দা সংস্থা CIA এই সব স্বেচ্ছাসেবী মোজাহেদদের তালিকা সংরক্ষণ করত যে ডেটাবেইজ-এ, সেই কম্পিউটার ফাইলটির নাম ছিল “আল কায়েদা”, যার আক্ষরিক অর্থই হচ্ছে ডেটাবেইজ, বেইজ বা ভিত্তি। সুতরাং আল কায়েদা কোনো বিশেষ সামরিক দলের নাম ছিল না, আফগানিস্তানে লড়াই করতে আসা সকল মোজাহেদরাই ছিল আল কায়েদার নামক তালিকাটির অন্তর্ভুক্ত। Co-operative Research History Commons. Retrieved January 9, 2007.- এর বিবরণে সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে, A CIA program called “Operation Cyclone” channeled funds through Pakistan’s Inter-Services Intelligence agency to the Afghan Mujahideen who were fighting the Soviet occupation. CIA and British Recruit and Train Militants Worldwide to Help Fight Afghan War. অর্থাৎ অপারেশান সাইক্লোন নামে সি.আই.এ-র একটি কর্মসূচি ছিল যা পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে আফগান মোজাহেদিনদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করত। সিআইএ এবং ব্রিটিশ আফগান যুদ্ধের জন্য সারা বিশ্ব থেকে ‘মিলিট্যান্ট’ (জঙ্গি) রিক্রুট করেছে এবং তাদেরকে প্রশিক্ষিত করে তুলেছে।
এই যে ‘প্রশিক্ষণ’, এটা দিয়েছিল কিন্তু দাড়ি টুপিধারী জবরদস্ত আলেমরা-মোল্লারাই। কিন্তু এই লোকগুলি যে সি.আই.এ-র নিয়োজিত সেটা কি এই আল্লাহর জন্য আত্মোৎসর্গকৃত মোজাহেদরা বুঝতে পেরেছিলেন? পারেননি। কী নিষ্ঠুর প্রতারণা! দুঃখে হৃদয় ভেঙ্গে যায়। যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র দিল কিন্তু একটাও প্রাণ দিল না। প্রাণ দিল বোকার হদ্দ আবেগপ্রবণ পাশ্চাত্যের ক্রীড়নক, মূল্যহীন খেলনারূপী মুসলমানরা। যখন রাশিয়া ভেঙ্গে গেল, আফগান মোজাহেদরা নিজেদেরকে জয়ী ভেবে আত্মতৃপ্তি লাভ করলেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জয়ী হলো যুক্তরাষ্ট্র। বহিরাগতরা যার যার দেশে ফিরে গেলেন। তখন তারা আফগানফেরত মোজাহেদ, ‘জেহাদী জোশে’ উদ্দীপ্ত, ইসলামের জন্য জীবনপণ সংগ্রামের বাসনা তখনও বুকের মধ্যে জাজ্বল্যমান।
কিন্তু বিড়ালের ইঁদুর নিয়ে খেলা তখনও শেষ হয়নি। এই চেতনা পশ্চিমের জন্য বড় বিপজ্জনক সেটা বুদ্ধিমান জাতিগুলি বেশ বুঝতে পেরেছিল। তারা জানে যে, ধর্মীয় চেতনা নিয়ে খেলার চেয়ে বিপজ্জনক আর কিছু নেই। তাই মুসলমান জাতিটির মধ্যে জেহাদের যে চেতনা তারা তৈরি করে দিয়েছে, এই চেতনাকে এবার শেষ করে দিতে হবে। অন্যথায় সেটা যে কোনো সময় ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে দাঁড়াবে। এজন্য তারা ইসলামকেই টার্গেট করল। (চলবে..)