রিয়াদুল হাসান:
বর্তমানে মুসলিম বিশ্ব যে সঙ্কটের মোকাবেলা করছে এ সঙ্কট ভয়াবহ সঙ্কট। এ সঙ্কটের গোড়া অনেক গভীর এবং এটি একদিনে সৃষ্টি হয় নি। দীর্ঘদিন পূর্বে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে ভ্রান্ত পথে চলতে চলতে আজকে আমরা এখানে এসে দাঁড়িয়েছি। এই সংকটকে আমরা বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি। যেমন বলতে পারেন এটা সাম্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্র, বলতে পারেন মুসলিম দাবিদার জনগোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ অনৈক্য হানাহানি, বলতে পারেন তাদের আদর্শচ্যুতি অর্থাৎ সঠিক পথ থেকে সরে যাওয়া, লক্ষ্য হারিয়ে ফেলা, বলতে পারেন এই পরিণতি আল্লাহর গজব, শাস্তি।
মুসলিম বিশ্বের এই সঙ্কট নিয়ে রাষ্ট্রপ্রধানদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে বহু আগেই। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তটস্থ, দিশা পাচ্ছেন না কীভাবে এটার মোকাবেলা তারা করবেন। জঙ্গিবাদ এমন একটি ইস্যু যা এখন সাম্রাজ্যবাদী অস্ত্রব্যবসায়ী পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। তারা এখন এটাকে অসিলা বানিয়ে একটার পর একটা মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। উদ্বাস্তু হচ্ছে মুসলমান, ঘরবাড়ি ধ্বংস হচ্ছে মুসলমানের, শিশুরা এতিম হচ্ছে মুসলামনের, সমুদ্রে ডুবে মরছে সবাই মুসলমান, একটার পর একটা দেশ শহর নগর ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে মুসলমানের। এটা চিরন্তন সত্য যে, যাদের দেশ থাকে না তাদের ধর্মও থাকে না তাদের ঈমানও থাকে না, তাদের কাছে ওসবের গুরুত্ব হারিয়ে যায়। খাদ্যের জন্য, আশ্রয়ের জন্য, জীবন বাঁচানোর জন্য তারা সব কিছুর সাথে আপস করতে পারে, সব সত্যকে, ধর্মকে, বিশ্বাসকে জলাঞ্জলি দিতে বাধ্য হয়ে যায়। তাদের একটাই পরিচয়, তারা ছিন্নমূল, উদ্বাস্তু। তাদের ঈমান কিসের আর ধর্ম কিসের?
এই সঙ্কটটি মোকাবেলা করার জন্য সরকারগুলো নতুন নতুন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বানাচ্ছে, অপরাধ দমনের জন্য নতুন নতুন প্রযুক্তি আমদানি করছে, আইনকে কঠিন থেকে কঠিনতর করছে। কিন্তু বিশ বছর আগের সঙ্কটের চিত্রের সাথে বর্তমানের তুলনা করলেই দেখা যাবে বিশ বছর আগের চেয়ে প্রতিটি দেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদী হামলা করে মানুষ হত্যা, খুন, আতঙ্কবিস্তার ইত্যাদি বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাহলে অর্থ দাঁড়ালো যে, তাদের সকল প্রচেষ্টার ফলাফল শূন্য। পরাশক্তিগুলো বিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের মারাণাস্ত্র তারা ব্যয় করছে কিন্তু জঙ্গিবাদ যেমন ছিল তার চেয়ে বহুগুণ বেশি ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে।
মুসলমান জনগোষ্ঠীর যে দুঃজনক অধ্যায় এখন অতিক্রান্ত হচ্ছে, এ পরিণতি একদিনে আসে নি। দীর্ঘদিনের অনুসৃত জীবনপদ্ধতির প্রভাবে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে, এখন বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সাথে শাসক শ্রেণির কোনো সম্পর্কই নেই। এ কারণে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী সংকটের ভয়াবহতা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারছে না, আর যারা শাসক তারা মূলত ক্ষমতা ও অর্থের লোভেই রাজনীতি করে থাকেন। তাদের কাছে দেশ ও জাতির দুর্দশা, সংকট ইত্যাদি ব্যক্তিস্বার্থের তুলনায় গৌণ। তাদের দেশপ্রেম অনেকাংশেই প্রদর্শনীর বস্তু। আমাদের হেযবুত তওহীদের বক্তব্য হচ্ছে, এই মহাসংকট থেকে বাঁচার জন্য এখন পুরো মুসলমান জনগোষ্ঠীকে ভাবতে হবে, সবাইকে এর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে এ থেকে মুক্তির পথ সন্ধান করতে হবে, সবাইকে বসতে হবে। অনেকে ভাবছেন এটা মুসলমানদের সংকট, সুতরাং অমুসলিমদের এ নিয়ে ভাবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমরা এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করি। কেননা একটি দেশ যখন আক্রান্ত হয় তখন সেখানে সব ধর্মের লোকই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এদেশে হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, মুসলমান, আদিবাসী নৃগোষ্ঠী আছেন কিন্তু সংকটটা মুসলমানদের নিয়ে। এ সত্যটি মুসলিমরা যেন ভুলে না যায়। মরক্কো, আলজেরিয়া, নাইজেরিয়া, লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাক, ইরান, ইয়ামেন, আফগানিস্তান, পাকিস্তান সবগুলো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এবং তাদের এই সংকট দুনিয়াজোড়া। তাই আমরা বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্নভাবে চিন্তা করলে হবে না, পুরো পরিস্থিতি নিয়ে একটা সামগ্রিক চিন্তা করতে হবে। চিন্তা না করলে অস্তিত্বই থাকবে না।
সরকার সঙ্কট মোকাবেলা করছেন শক্তি দিয়ে, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে। সাধারণ জনগণের মধ্যে কিন্তু জঙ্গিবাদের ইস্যু নিয়ে বিভক্তি আছে। বিরাট একটা সংখ্যক লোক বিভিন্ন কারণে সরকারের বিরোধিতা করতে গিয়ে সকল বিষয়েই সরকারবিরোধী অবস্থান নিচ্ছেন। এ কারণে জঙ্গিবাদের মত একটি জাতীয় সংকটেও তারা সরকারকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত নন, অনেকে এমনও বলে থাকেন যে, জঙ্গিবাদ ইস্যুটি আসলে বানোয়াট ইস্যু। তারা চান যে কোনো মূল্যে সরকারের পতন হোক। জঙ্গিবাদ যে কেবল সরকার নয়, রাষ্ট্রের পতন ডেকে আনছে সেটা তাদের কাছে কোনো মাথা ব্যথার বিষয়ই নয়। তারা লক্ষ করেন না যে, জাতির সদস্যদের এই জাতীয় গোড়ামিপূর্ণ মনোভাবের পরিণামেই আজকের ইরাক, সিরিয়া ধ্বংসস্ত‚পে পরিণত হয়েছে। জাতীয় ঐক্যের অনুপস্থিতিই দেশগুলোকে পরাশক্তিদের লীলাভ‚মিতে পরিণত করেছে।
আমরা মুসলিম বিশ্বের পঞ্চান্নটি রাষ্ট্রের মানুষকে দুটো ভাগে ভাগ করতে পারি। সব সরকারকে আমরা একটা ভাগ ধরতে পারি যারা জঙ্গিবাদকে মোকাবেলা করার জন্য শক্তি-আইন প্রয়োগ করে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। দ্বিতীয় ভাগটি হলো জনগণ, যারা নিজেদেরকে তওহীদি জনতা বলে বিশ্বাস করেন। তাদের মধ্যে বিভিন্ন ভাগ রয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন ফেরাকা, মাযহাব, সুফিবাদী তরিকাপন্থী, বিভিন্ন জঙ্গিবাদী, রাজনৈতিক ইসলামিক দল এবং সাধারণ ধর্মবিশ্বাস মুসলমান ইত্যাদি সব মিলিয়ে সেই তওহীদি জনতা। সাধারণ মানুষ আছেন যারা কোনো দল করেন না, তারা ঘর-সংসার করে জিন্দেগি পার করে দিচ্ছেন।
সরকারের মধ্যেও আবার ভাগ আছে। কেউ সামরিক শাসনে বিশ্বাসী, কেউ পুঁজিবাদ, কেউ গনতান্ত্রিক, কেউ রাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী। মুসলিম বিশ্বের সরকারগুলো কিন্তু এই রকম। এই সরকার ও তওহীদী জনতা উভয়ের উদ্যেশ্যেই আমাদের কথা, এই সঙ্কটটি আমাদের সবাইকে এখন ভিন্নভাবে উপলব্ধি করতে হবে, এর গোড়া কোথায় তা বুঝতে হবে।
নবী করিম (দ.) যখন আল্লাহর পক্ষ থেকে তওহীদটা পেলেন তিনি তখন আরবের লোকদেরকে এই তওহীদের উপরে ঐক্যবদ্ধ করলেন। তিনি সর্বপ্রথম বললেন, “হে মানুষ তোমরা বল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। তাহলে তোমাদের পায়ে সমগ্র বিশ্ব লুটিয়ে পড়বে। তোমরা পরকালেও মুক্তি পাবে।” সেই আরবের লোকদেরকে যখন তিনি আহŸান করলেন যে, তোমরা ব্যক্তিগতভাবে মূর্তিপূজা করো, বিভিন্নভাবে ধর্ম পালন করো, কেউ কোনো ধর্মেই বিশ্বাস করো না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তোমরা সবাই অশান্তিতে নিমজ্জিত রয়েছ। এই অশান্তির আসল কারণ তোমরা আল্লাহর হুকুম থেকে সরে গিয়েছ। এখন সমাধানের একটাই পথ, তোমাদের এই হানাহানি, যুদ্ধ, রক্তপাত, দারিদ্র্য, সংঘাত, গোত্রীয় ষড়যন্ত্র ইত্যাদির হাত থেকে তোমাদের নিস্তারের রাস্তা কিন্তু একটা। তোমরা যদি সবাই মিলে একটা কথার উপর ঐক্য হতে পারো লা এলাহ এল্লাল্লাহ- আল্লাহর হুকুম ছাড়া তোমরা কারও হুকুম মানবে না। এবং আমাকে আল্লাহর রসুল হিসাবে গ্রহণ করবে।
কিন্তু সকল নবী-রসুলদের মত তাঁকেও ভুল বোঝা হয়েছে, কাবাকেন্দ্রিক ধর্মব্যবসায়ী পুরোহিতরা উনার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছে, পাগল, গণক, কবি, জাদুকর ইত্যাদি অপবাদ তাঁর উপর আরোপ করা হয়েছে, তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে, তাঁর উপর পাথর নিক্ষেপ করা হয়েছে, শেষ পর্যন্ত উনাকে দেশ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। কিন্তু তিনি তাঁর লক্ষ্যে অবিচল, অটল, অনড়, সাবের হয়ে, কোনরূপ সহিংসতার দিকে না যেয়ে কোনরূপ উত্তেজিত না হয়ে তাঁর সাহাবীদেরকে বলতেন, “সবর করো, সবর করো, আল্লাহর সাহায্য আসবে, সত্যের বিজয় হবে।”
একটা পর্যায়ে মদীনার লোকজন তাঁকে মেনে নিলেন। মক্কার কাফেররা আবু জাহেল, আবু সুফিয়ান, ওতবা, শায়েবা, ওয়ালিদ, উমাইয়্যাদের নেতৃত্বে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। কিন্তু তারা বারবার হামলা চালিয়েও মো’মেনদের সাথে পরাজিত হয়েছে। আল্লাহ তাঁর সত্যদীনের আলোকে দিনকেদিন উদ্ভাসিত করেছেন। রসুলাল্লাহ মক্কা বিজয় করলেন, মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে জাজিরাতুল আরবে পূর্ণ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলো। বিভিন্ন গোত্র, বিভিন্ন মতভেদ ভুলে গিয়ে তারা এক জাতি হলেন।
রসুলাল্লাহ মদীনা সনদের মাধ্যমে দু’টি মৌলিক কথার উপরে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করলেন। প্রথমত, বহিঃশত্রæর হাত থেকে মদীনা রক্ষা করা, দ্বিতীয়ত, অভ্যন্তরীণ শত্রুদের হাত থেকে মদীনাকে হেফাজতে রাখা। ইহুদি, পৌত্তলিক, মুসলমান, নাস্তিক উনারা মদীনা সনদের মাধ্যমে এক জাতি হলেন। পরবর্তীতে পুরো আরববাসীকে রসুলাল্লাহ একটি জাতিতে পরিণত করলেন যে জাতিটি একটি কথার উপর ঐক্যবদ্ধ হলো যে, আমরা আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারও হুকুম মানবো না। এই ক্রমবর্ধমান ঐক্যবদ্ধ জাতির মধ্যে তিনি তেইশ বছর ছিলেন। তেইশ বছরের নব্যুয়তি জীবনে ঐ জাতির ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বৈবাহিক, ব্যবসা-বাণিজ্য, যুদ্ধ-বিগ্রহ, সন্ধি-প্রস্তাব ইত্যাদি অনেক সমস্যা এসেছে। সে সমস্যাগুলো তিনি একে একে আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী সমাধান দিয়েছেন। আল্লাহর সেই হুকুমগুলির সমষ্টিই হচ্ছে আজকের কোর’আন।
প্রশ্ন হচ্ছে, কোর’আনটা কাদের জন্য? কোর’আনটা এমন একটি জাতির জন্য যারা তওহীদের উপর ঐক্যবদ্ধ এবং যাদের একজন নেতা রয়েছে। সেই জাতির মধ্যে সিয়া সুন্নি ছিল না, কোনো দলাদলি হানাহানি ছিল না। তাদের নেতা ছিলেন আল্লাহ রসুল, তাঁদের জীবনবিধান ছিল আল্লাহর হুকুম। সেই জাতি লক্ষ্যহীন ছিল না, তাদের প্রতিটি সদস্যের একটি মাত্র লক্ষ্য ছিল – আর সেটা হচ্ছে সমগ্র পৃথিবীর মানবজাতির জীবনে চূড়ান্ত শান্তি প্রতিষ্ঠা। তিনি এই জাতিটাকে ঐক্যবদ্ধ করে, তাদের জীবনের একটি লক্ষ্য স্থির করে দিয়ে, তাদেরকে সেই গন্তব্যের দিকে পরিচালিত করে সাড়ে বারো লক্ষ বর্গমাইল এলাকায় অনন্য ন্যায় ও শান্তির উদাহরণ সৃষ্টি করে আল্লাহর কাছে চলে গেলেন। এন্তেকালের চারদিন আগে যখন কেউ কেউ সতের বছরের ওসামা বিন যায়েদকে (রা.) সম্মিলিত অভিযানের সেনাপতি হিসাবে মানতে চায় নি। তখন আল্লাহর রসুল অত্যন্ত অসুস্থ শরীর নিয়ে একজন সাহাবির কাঁধে ভর করে এসে মসজিদের নববীতে রাগান্বিত স্বরে বললেন, “তোমরা তো এভাবে তার বাবাকেও নেতা মানতে অস্বীকার করেছিলে।” তিনি তাদেরকে বিভক্তি সৃষ্টি করতে কঠোরভাবে নিষেধ করলেন।
তিনি চলে যাবার পর জাতির নেতা হলেন আবু বকর (রা.), ওমর (রা.), উসমান (রা.), আলী (রা.) প্রমুখ খলিফাগণ। ৬০/৭০ বছরে অর্ধেক দুনিয়াতে সাহাবীদের সংগ্রামের ফলে সত্যদীন প্রতিষ্ঠা হলো। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, সামরিক শক্তিতে, নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিতে, শিক্ষায়, সাহিত্যে, চিকিৎসা বিজ্ঞানে সর্বক্ষেত্রে এই জাতি শিক্ষকের আসন আসিন হলো। একটি রেনেসাঁ ঘটে গেল, মানুষের চিন্তার জগতে বিপ্লব সাধিত হলো। সেই রেনেসাঁর ঢেউ ইউরোপেও লেগেছিল যার দরুণ পরবর্তী যুগে ইউরোপ আবার সর্ববিষয়ে শ্রেষ্ঠ হয়ে গেল। (চলবে)