রিয়াদুল হাসান:
জঙ্গিবাদ বর্তমানে মানবজাতির সর্বপ্রধান সমস্যা। এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে পৃথিবীর পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো। সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি পশ্চিমা ভাবধারার গণমাধ্যমগুলো জঙ্গিদের বিরুদ্ধে জনসমর্থন সৃষ্টিতে কাজ করে যাচ্ছে। তারা যেভাবে এ প্রচারণা চালাচ্ছে, তাতে কেবল জঙ্গিদের বিরুদ্ধে নয় খোদ ইসলামের বিরুদ্ধে মানুষের মনে ঘৃণার বোধ জন্ম নিচ্ছে। এ লড়াই যতটা না সামরিক তারচেয়ে বহুগুণ বেশি সভ্যতার সংঘাত (Clash of civilizations), ইসলাম বনাম পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতা। যেহেতু গোটা বিশ্বের গণমাধ্যমগুলো পশ্চিমা পরাশক্তিগুলো দ্বারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রিত, তাই এ যুদ্ধে তারা ইসলামের বিরুদ্ধে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতে পুরোপুরি সফল হয়েছে। যার বহিঃপ্রকাশ আমরা বিভিন্নভাবে দেখতে পাচ্ছি। ইউরোপের বহুদেশে মুসলিম (দাবিদার) মেয়েদের হেজাব ব্যবহার আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, চীনে দাড়ি রাখা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিশ্বময় ইসলামের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি মূল্যবোধ, সংস্কৃতি বা পরিচয়জ্ঞাপক বিষয়গুলোর বিরুদ্ধে সামাজিক চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে, মুসলিম দেখলেই তার গায়ে থু থু দিচ্ছে, কোর’আন পোড়াচ্ছে, মসজিদ মানেই জঙ্গি আস্তানা মনে করা হচ্ছে, মিনার ভেঙ্গে ফেলার আন্দোলন হচ্ছে, কারো নামে মুসলমানিত্বের চিহ্ন থাকলে তাকে যতদূর সম্ভব হয়রানি করা হচ্ছে। এভাবে জঙ্গিবাদের ফলাফল ভোগ করতে হচ্ছে ১৬০ কোটি মুসলিমকেই। তাই জঙ্গিবাদকে এখন আর কেবল রাজনীতিক বিষয় ভেবে দূরে সরিয়ে রাখলে চলছে না, সর্বশ্রেণির মানুষকেই জঙ্গিবাদের মৌলিক বিষয়গুলো সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। যেমন:
১. কারা, কী উদ্দেশ্যে জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করেছে?
২. জঙ্গিবাদ সৃষ্টিতে কীভাবে ‘আলেমদের’ ব্যবহার করা হয়েছে?
৩. জঙ্গিবাদের ফসল উঠছে কার ঘরে, আর কে হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত?
৪. ইসলামের দৃষ্টিতে জঙ্গিবাদ কেন অবৈধ?
৫. জঙ্গিবাদ নির্মূলের সঠিক পন্থা কী?
জঙ্গিরা ভিনগ্রহের প্রাণী নয়, এক সময় তারা আমাদের সমাজেরই অংশ ছিলেন। কিন্তু জীবনের একটি পর্যায়ে এসে তারা জঙ্গিবাদ (যা একটি ভ্রান্ত মতবাদ) দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গেছেন। কোথাও কোথাও জঙ্গি হওয়ার অন্য কারণও থাকে যেমন নির্যাতিত হয়ে আত্মরক্ষার জন্য বা স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্য লড়াই চালাতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে মানুষ জঙ্গিবাদের আশ্রয় নিয়েছে। কারণ যা-ই হোক না কেন, জঙ্গিরা তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে ‘জেহাদ’ বলেই বিশ্বাস করেন এবং অন্যদেরকেও কথিত ‘জেহাদে’ যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করেন। ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া সম্পর্কে সাধারণ মানুষের সঠিক ধারণা না থাকায় জঙ্গিদের দ্বারা সাধারণ মানুষ উদ্বুদ্ধ হয়ে বিপথে পা বাড়ায়। ধর্মকে ব্যবহার করে এক শ্রেণির রাজনীতিকও স্বার্থ হাসিল করেন। তারা মানুষের ধর্মানুভূতিকে উত্তেজিত করে তোলে এবং সহিংস হতে উদ্বুদ্ধ করে। এভাবে তারা প্রায়শই দেশে দাঙ্গাময় পরিবেশ সৃষ্টি করে। যে দেশে জঙ্গিবাদীদের সন্ত্রাস প্রকট আকার ধারণ করে সেখানেই সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালিয়ে দেশ দখল করার সুযোগ খোঁজে পশ্চিমা পরাশক্তিগুলো।
এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, পশ্চিমা পরাশক্তিগুলো এক ঢিলে দুই পাখি মারার উদ্দেশ্যে জঙ্গিবাদ ইস্যুটির জন্ম দিয়ে তা বিশ্বময় রপ্তানি করেছে এবং সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। স্বল্পমেয়াদী উদ্দেশ্য হলো পররাজ্য দখল করা, পরসম্পদ লুট করা আর দীর্ঘমেয়াদী উদ্দেশ্য হলো একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ‘ইসলাম’-কে ধ্বংস করে দেওয়া। এর স্বল্পমেয়াদী উদ্দেশ্যটি নিয়ে আলোচনার তেমন প্রয়োজন নেই, এ বিষয়ে বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি উক্তিই যথেষ্ট হবে আশা করি। তিনি ২৩ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, “তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ সূচনা করে মুসলিম বিশ্বকে পদানত রাখার পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্র শুরু করেছে। দেশটি আফগানিস্তানে যুদ্ধের সূচনা করে, তা এখন সম্প্রসারিত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে।” এ যুদ্ধে পক্ষে-বিপক্ষে মুসলিম দাবিদারদেরকেই ব্যবহার করা হচ্ছে অবিশ্বাস্য কূটকৌশলে। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার এ এক ভয়াবহ নীতি। তারা একদিকে জঙ্গিদেরকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, অন্যদিকে তাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছে। তাদের এ কর্মপন্থা দেখে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ আছে যে, আসলে তারা জঙ্গিবাদের মূলোৎপাটন চায়, নাকি এটা তাদের রাজনীতির খেলামাত্র (Political game)? আমাদের দেশের অর্থনীতিকে যেমন বলা হয় কৃষি অর্থনীতি, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে বলা হচ্ছে যুদ্ধ অর্থনীতি (War Economy), অস্ত্র ব্যবসা তাদের আসল ব্যবসা। যুদ্ধ না থাকলে তারা সঙ্কটে পড়বে, তাদের প্রয়োজন বিশ্বজোড়া অস্ত্রের বাজার। তারা চায় যুদ্ধ জিইয়ে রাখতে, কিন্তু তাদের সৈন্যরা যুদ্ধবিমুখ ও ভোগবাদী। তাই দরকার পড়েছে মুসলিমদের একটি দলকে আরেকটি দলের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেওয়া। জঙ্গিবাদের ধুয়া তুলে একটার পর একটা দেশ এভাবেই তারা দখল করে নিয়ে পা চাটা পুতুল সরকার বসাচ্ছে। সুতরাং জঙ্গিরা পশ্চিমাদের দৃষ্টিতে অতি প্রয়োজনীয় শত্র“ (Useful enemy)। অনেক দেশের সরকারও জঙ্গিবাদ নির্মূল হোক এটা চায় না, জঙ্গিরা থাকলে তাদের বহুমুখী স্বার্থোদ্ধারের পথ খোলা থাকে। কিন্তু সত্যিকারভাবে যারা মানুষের কল্যাণকামী এবং যারা ইসলামপ্রিয় তাদেরকে বুঝতে হবে যে, এ জঙ্গিবাদ পাশ্চাত্যের গর্ভে জন্ম নেওয়া ইসলামের শত্র“। জঙ্গিবাদের অজুহাত দিয়ে যে পরিমাণ মুসলিম হত্যা করা হয়েছে এবং ইসলামকে সন্ত্রাসের ধর্ম বলে পরিচিত করা সম্ভব হয়েছে আর কোনো উপায়ে সেটা সম্ভব হয় নি। তাই সাম্রাজ্যবাদীরা উপরে উপরে তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ চালিয়ে গেলেও জঙ্গিবাদকে তারা নিজেদের স্বার্থেই ধ্বংস হতে দেবে না, জঙ্গিবাদ না থাকলে অস্ত্র ব্যবসাই তো বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু যারা প্রকৃতই মানুষ, যাদের মধ্যে মানুষের ধর্ম মানবতাবোধ কাজ করে তাদের উচিত জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া। নয়তো এই ইস্যুকে ব্যবহার করে আরো লক্ষ লক্ষ মানুষকে হতাহত ও বাস্তুহারা করবে পশ্চিমা ‘সভ্য’ দেশগুলো।
জঙ্গিবাদ নিয়ে হাজার হাজার বই লেখা হয়েছে, হাজার হাজার পত্রিকা এ নিয়ে লক্ষ লক্ষ লাইন লিখেছে। তারা জঙ্গিবাদের ইতিবৃত্ত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তারা অনেকেই এটা প্রমাণ করেছেন যে, “পশ্চিমা বিশ্বই জঙ্গিবাদের স্রষ্টা”। জঙ্গিবাদ যে একটি বড় সমস্যা এ নিয়ে কোনো মতভেদ নেই, কিন্তু আজ পর্যন্ত এ বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা এর সুষ্ঠু কোনো সমাধান বাতলাতে পারেন নি। কিন্তু হেযবুত তওহীদকে আল্লাহ দয়া করে জঙ্গিবাদ নির্মূল করার সঠিক উপায় দান করেছেন। বিশ্বে এখনো শক্তি প্রয়োগ করাকেই এ সমস্যার সমাধান হিসাবে ভাবা হচ্ছে, যদিও আজ পর্যন্ত এ পথে কেউ সফল হয় নি, বরং জঙ্গিবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে। ইদানীং বিদগ্ধজনেরা জঙ্গিবাদকে আদর্শিকভাবে মোকাবেলার পরামর্শ দিচ্ছেন। আমাদেরও বক্তব্য সেটাই। যেহেতু জঙ্গিরা ইসলাম দ্বারা অনুপ্রাণিত (Motivated), তাই ইসলামিক যুক্তি প্রমাণ দ্বারাই তাদের আদর্শকে ভ্রান্ত প্রমাণ না করা গেলে তারা ফিরবে না, দিন দিন আরো নতুন জঙ্গি জন্ম দিতে থাকবে। এমনই অকাট্য দলিল-প্রমাণ ও যুক্তি মানবজাতির সামনে তুলে ধরছে হেযবুত তওহীদ। আমরা আশা করি সরকার, সাধারণ জনগণ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সবাই জঙ্গিবাদ ও ধর্ম নিয়ে অপ-রাজনীতির সমাধানকল্পে আমাদের প্রস্তাবিত বিষয়টি নিয়ে ভাববেন।