গোপালগঞ্জ জেলা পরিষদ মিলনায়তনে হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর প্রস্তাবনা নিয়ে একটি সর্বধর্মীয় সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। দৈনিক দেশেরপত্র এবং দৈনিক বজ্রশক্তির যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই সেমিনারে জেলার সর্বধর্মীয় নেতৃবর্গ উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ সকল ধরনের সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, ধর্মব্যবসা ও ধর্ম নিয়ে অপরাজনীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবার বিষয়ে এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর প্রস্তাবের সাথে একমত পোষণ করেন।
“সকল ধর্মের মর্মকথা, সবার উর্ধ্বে মানবতা’ শীর্ষক এই সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো: খলিলুর রহমান। এছাড়া বিশেষ অতিথি হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন- বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের গোপালগঞ্জ জেলা সাধারণ সম্পাদক বাদল কৃষ্ণ বিশ্বাস, দৈনিক দেশেরপত্রের উপদেষ্টা মসীহ উর রহমান, শেখ ফজিলাতুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর অশোক কুমার সরকার, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের গোপালগঞ্জ জেলা সভাপতি ডা: প্রহল্লাদ চন্দ্র বিশ্বাস, বিশিষ্ট শিল্পপতি বিজয় কুমার মোদী, দৈনিক দেশেরপত্রের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শাহানা পন্নী (রুফায়দাহ), গোপালগঞ্জ খ্রিস্টান ফেলোশীপের সভাপতি রেভা: সামূয়েল এস বালা, গোপালগঞ্জ খ্রিস্টান ফেলোশীপের সহ-সভাপতি পাষ্টর অনুকূল বিশ্বাস, সার্বজনীন কেন্দ্রীয় কালীবাড়ী, গোপালগঞ্জ-এর সভাপতি এ্যাড. জগদীশ চন্দ্র বৈদ্য, জেলার রঘুনাথ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সরজকান্তি বিশ্বাস প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো: খলিলুর রহমান বলেন- ‘আজকের এই অনুষ্ঠানটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুগে যুগে এ ধরনের বহু উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু নানা কারণে সেগুলোর অধিকাংশই সফলতার মুখ দেখে নি। কিন্তু এবার সফল করতে হবে। এ দেশে আমরা সকল মানুষ একই খাবার খাই, একই আবহাওয়ায় বসবাস করি, কিন্তু বিভক্ত হই ধর্মের ভিত্তিতে। কেউ যখন বিপদগ্রস্ত হয় তখন সে অপরের সহযোগিতা পায়। এটাই জগতের নিয়ম। এটাই হলো মানবতার কথা, ভ্রাতৃত্বের কথা। কিন্তু আমরা সেই নিয়ম-নীতি আর মানবতাকে উপেক্ষা করে চলেছি। আজকের সমাজে সহযোগিতা-সহমর্মিতার কথা আলোচিত না হয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়।’ তিনি বলেন- ‘পৃথিবীর কোনো ধর্মই মানবতা লঙ্ঘনের কথা বলে না। সকল ধর্মই মানবতার কথা বলে, মানবিকতার কথা বলে। আজকে সমাজে সংখ্যালঘুদেরকে বিভিন্নভাবে বৈষম্যের শিকার হতে হয়। এটা শুধু ধর্মের ভিত্তিতেই হয় তা নয়। এর মূল কারণ হলো মানবতার অবক্ষয়।’ তিনি তার সম্প্রদায়ের সবাইকে দেশেরপত্রের কর্মকাণ্ডে সকল প্রকার সহযোগিতা অব্যাহত রাখার জন্য আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের গোপালগঞ্জ জেলা সভাপতি ডা: প্রহল্লাদ চন্দ্র বিশ্বাস বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বলেন- ‘আজকের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পেরে আমি ধন্য। আমরা যদি মানবতাকে বিশ্বাস করি তাহলে আমাদের মধ্যে আর কোনো ভেদাভেদ থাকবে না, অন্যায় অবিচার থাকবে না। ধর্ম কাকে বলে? ধর্ম হলো যাকে ধারণ করা হয়। আমাদেরকে মানবতা ধারণ করতে হবে। মানবতার কল্যাণই হলো সকল শ্বাশ্বত, সনাতন ধর্মের মূলকথা। সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। এই যদি হয় ধর্মের কথা, তাহলে আমাদের মধ্যে এত দ্বন্দ্ব-সংঘাত কেন? আমাদের উচিত মানবতাকে ধারণ করা।’
এরপর বিশিষ্ট শিল্পপতি বিজয় কুমার মোদী তার বক্তব্যে বলেন- মানুষ হলো স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। একটি গাভী যখন দুধ দেয় তখন কে হিন্দু, কে বৌদ্ধ, কে খ্রিস্টান তা দেখে না। কারও ব্যাপারে সে বৈষম্য করে না। তাহলে আমরা মানুষ হয়ে কেন আমাদের নিজেদের মধ্যে এই বিভেদের প্রাচীর খাড়া করে রেখেছি? ঈশ্বর মানুষের কল্যাণের জন্য যে জ্ঞান দান করেছেন সেই জ্ঞানকে কল্যাণের পথে খরচ না করে আমরা একে অপরকে হত্যা করে চলেছি। মানুষের জন্য ধর্ম। মানুষের শান্তির জন্য ধর্ম। কিন্তু সেই ধর্মকে উছিলা করেই যখন একজন মানুষ আরেকজনকে হত্যা করে, তখন ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা কোথায় থাকে?’ তিনি বলেন- দৈনিক দেশেরপত্র পত্রিকা তাদের আদর্শকে ধরে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে চলবে এই আমার চাওয়া’।
সার্বজনীন কেন্দ্রীয় কালীবাড়ী, গোপালগঞ্জ-এর সভাপতি এ্যাড. জগদীশ চন্দ্র বৈদ্য তার বিশেষ অতিথির বক্তব্য দানকালে বলেন- ‘আমরা সাম্প্রদায়িকতার আঘাতে বারবার যখন জর্জরিত হয়ে চলেছি তখন এ ধরনের সময়পোযোগী পদক্ষেপের বড়ই প্রয়োজন ছিল। আমরা কেমন যেন ভুলে যাই যে, আমরা মানুষ। আমরা একই পিতা-মাতার সন্তান হয়েও এক জন আরেকজনের বুকে ছুরি চালাচ্ছি। আসলে আমরা ধার্মিক হই নি। আমরা ধর্মের উপাসনালয়ে যাই কিন্তু ধার্মিক হই নি। আজকে ধর্মে ধর্মে যে কোন্দল সারা দুনিয়ায় চলছে তার নিষ্পত্তি ঘটাতে হবে। আমাদের সর্বাগ্রে প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ হওয়া।’
এরপর শেখ ফজিলাতুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর অশোক কুমার সরকার তার বক্তৃতায় বলেন- ‘হিংসা-বিদ্বেষ যতক্ষণ আমাদের সহাবস্থান করবে ততক্ষণ আমাদের লক্ষ্য অর্জিত হবে না। আমরা কাক্সিক্ষত শান্তি পাবো না। আমাদেরকে আগে অনৈক্যের কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে। সংস্কৃতিও এখানে একটি বড় বিষয়। যখন দেশীয় সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করা হয় আর আকাশ সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করা হয় তখন জাতীয় ঐক্য অনেকাংশেই দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই পরিবার, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সকল পর্যায়েই তরুণদেরকে প্রকৃত দেশপ্রেমের শিক্ষা দিতে হবে, হিংসার মন্ত্র থেকে তাদেরকে মুক্ত রাখতে হবে।’
এছাড়াও দৈনিক দেশেরপত্রের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শাহানা পন্নী (রুফায়দাহ) তার বক্তব্যে বলেন-‘আজকে আপনাদের সামনে আমরা যে ঐক্যের কথাগুলো বলছি সেগুলো আমাদের কথা নয়। এগুলো যামানার এমাম, এমামুয্যামান, জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর কথা, তাঁর শিক্ষা। তিনিই আমাদেরকে পৃথিবীর যত অশান্তির মূল কারণ অবগত করেছেন। তাঁর শিক্ষা থেকেই আমরা বলছি- আজকে সকল ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে বিরাজিত এত অন্যায়-অবিচার, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ইত্যাদির মূল কারণ হলো সকল ধর্মের অনুসারীরাই তাদের যার যার ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা থেকে দূরে সরে গেছে। প্রতিটি ধর্মের অনুসারীরাই মানবতা থেকে দূরে সরে গেছে, অথচ মানবতার কল্যাণ সাধনই প্রতিটি ধর্মের মর্মকথা। আমরা এই মানবতার সরূপ প্রকাশ করার জন্যই চেষ্টা করে চলেছি। কিন্তু এক শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী ও ধর্ম নিয়ে অপরাজনীতিকারীরা আমাদের এই মহৎ উদ্যোগকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টায় লিপ্ত। এনশা’আল্লাহ আমরা সফল হবো। একই স্রষ্টার সৃষ্টি, একই পিতা-মাতার সন্তান মানবজাতি অচীরেই ঐক্যবদ্ধ হবে। অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে ‘সকল ধর্মের মর্মকথা, সবার উর্ধ্বে মানবতা’ এবং ‘এক জাতি এক দেশ, ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ’ শীর্ষক ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন দৈনিক দেশেরপত্রের উপদেষ্টা মসীহ উর রহমান। সঞ্চালনা করেন তানজীদ ইমাম (তিতুমির)।