আকরাম হোসাইন ফকির
ধর্মজীবীদের একটি বড় অংশের পেশা মসজিদের ইমামতি করা। ইমাম শব্দের অর্থ নেতা হলেও এই কথিত ইমামগণের নেতৃত্বের পরিধি নামাজের সময়ের ৮/১০ মিনিটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। প্রকৃতপক্ষে তারা মসজিদ কমিটির বেতনভুক্ত কর্মচারী মাত্র। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তারা যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়িয়ে বিনিময়ে টাকা নেন তার যৌক্তিকতা কী? নামাজ পড়াতে ও পড়তে যা জানা আবশ্যক তা ইমাম সাহেব যেমন জানেন, মুসল্লীগণও তা-ই জানেন; ইমামের যতোটুকু সময় ব্যয় হয়, মুসল্লীদেরও ততোটুকু সময়ই ব্যয় হয়। মুসল্লীদের নামাজ পড়া ফরদ, ইমামেরও তাই। পার্থক্য হলো মুসল্লীদের নামাজের চাওয়া-পাওয়া আল্লাহর কাছে, পক্ষান্তরে ইমামের নামাজের চাওয়া-পাওয়া আল্লাহর কাছে নয়। তার বেতন বন্ধ হলে ইমামতিও বন্ধ!
এখানেই শেষ নয়, আল্লাহর পরিষ্কার ঘোষণা অনুযায়ী, যারা ধর্মের বিনিময় নেন, তাদের পেছনে নামাজও হয় না। আল্লাহ মুমিনদেরকে তাদের অনুসরণ করতে নিষেধ করে দিয়েছেন যাতে কোনোভাবেই এই দীনে কোনো পুরোহিত শ্রেণির আবির্ভাব হতে না পারে। আল্লাহ বলেন, ‘অনুসরণ ও আনুগত্য কর তাদের যারা তোমাদের নিকট থেকে কোনো মজুরি গ্রহণ করে না এবং হেদায়াত প্রাপ্ত। [সুরা ইয়াসিন-২১] সুতরাং যারা তাদের পেছনে নামাজে দাঁড়াবেন তারা আল্লাহর হুকুম অমান্য করছেন।
রসুল (দঃ) ও তাঁর সাহাবাগণ আল্লাহর দীন কায়েমের সংগ্রামে নিজেদের শেষ সম্বলটুকু ব্যয় করে নিঃশেষ হয়েছেন, এমন কি নিজেদের জীবনও উৎসর্গ করে গেছেন। পক্ষান্তরে আজকের আলেম নামধারীগণ ও পীররা সেই ইসলাম বিক্রি করে অর্থ সম্পদের পাহাড় গড়ছেন, এমনকি অনেকের শান-শওকত, রাজকীয় হালচাল মোগল বাদশাহদেরও হার মানায়। তাদের অনুসারী কাউকে যখন কোর’আন থেকে দেখিয়ে দেওয়া হয় যে, এই ধর্মব্যবসা অবৈধ তখন তারা প্রশ্ন করেন, তাহলে তারা খাবেন কী? প্রশ্নটি নিতান্তই বুদ্ধিহীন এবং আল্লাহর হুকুমের উপর অনধিকার চর্চা; যেহেতু হারাম করেছেন আল্লাহ, তাই তারা কী খাবেন এ প্রশ্নটিও আল্লাহকেই করা দরকার। তারা কী খাবেন আর কী খাবেন না তা কোর’আনে বর্ণিত আছে- আল্লাহ যা কিছু হালাল করেছেন তাই খাবেন। বর্তমানে তারা কী খাচ্ছেন, এর পরিণতি কী – তা’ও কোর’আনে সহজ-সরল ভাবে বলা হয়েছে যে তারা আগুন খাচ্ছেন (বাকারা ১৭৪)। আপদে-বিপদে কোনো উপায়ান্তর না থাকলে (শুধু প্রাণ বাঁচানোর জন্য যতটুকু দরকার) হারাম ঘোষিত মদ, শুকর, মৃত পশু ইত্যাদি সাময়িক ভাবে খাওয়ার সুযোগ আল্লাহ দিয়েছেন (বাকারা ১৭৩) কিন্তু ধর্ম-কর্মের বিনিময় গ্রহণের সুযোগ তিনি কোনো কালেই দেন নি; বরং যারা তা করবে তাদের বিষয়ে তিনি বলেছেন, তাদেরকে তিনি পবিত্র করবেন না, তাদের দিকে তাকাবেন না এবং তাদেরকে তিনি মর্মন্তুদ শাস্তি দিবেন। এখানে অনন্যোপায় হয়ে করলে ক্ষমা করার কোনো প্রতিশ্র“তি মহান আল্লাহ দেন নি বরং সকল মুমিনদেরকেই তিনি সালাহ শেষে মাঠে ঘাটে ছড়িয়ে পড়ে হালাল রোজগারের সন্ধানের নির্দেশ দিয়েছেন, মুসল্লীগণ যা করে থাকেন। [কোর’আন: ৬২: জুম’আ-১০] তারা কি খাবেন এ আয়াতে তারই দিক নির্দেশনা রয়েছে। এই দীনের বিনিময় সংক্রান্ত যে আয়াতগুলি উল্লেখ করলাম, এমন আরও বহু আছে, সেগুলিও তারাও গোপন করেন। এই সত্যগোপন ও দীনের বিনিময় গ্রহণ প্রসঙ্গে আল্লাহর কথা হলো, ‘তারা আগুন ছাড়া কিছুই খায় না’, অর্থাৎ তারা যা-ই খায় তাই আগুন। কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের দিকে দৃষ্টিপাত করবেন না, তাদের সঙ্গে কথাও বলবেন না, পবিত্রও করবেন না। পরকালে তাদের কোনো অংশ নেই। তাদের জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি রয়েছে। [৩: সুরা ইমরান: ৭৭] এমন কঠোর সাবধানবাণী আল্লাহ আর কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে উচ্চারণ করেছেন কি?
আল্লাহর সব নবী-রসুলগণই ধর্মব্যবসায়ের বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থান নিয়েছেন এবং তাদের প্রবল বিরোধিতারও সম্মুখীন হয়েছেন। এর অন্যতম কারণ নবী রসুলরা তাদের এই ধর্মব্যবসাকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেছেন, যার ফলে তারা রুজি রোজগার বন্ধের আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে নবীরসুলদের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। নবী-রসুলগণ প্রায় সকলেই তাদের জাতির উদ্দেশ্যে একটি সাধারণ কথা বলেছেন যে, আমি তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় চাই না, আমার বিনিময় রয়েছে আল্লাহর কাছে। এটা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, তিনি যা তাদের সামনে উপস্থাপন করছেন তা নির্ভেজাল সত্য, হক্, এতে মিথ্যার কোনো মিশ্রণ নেই। কারণ প্রতিটি মিথ্যাই উদ্দেশ্য-প্রণোদিত এবং তাতে মানুষের কোনো না কোনো পার্থিব স্বার্থ থাকে। নবী-রসুলগণ যে কোনো পার্থিব স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করছেন না সেটা বোঝানোর জন্যই উপরোক্ত কথাটি বলতেন। বিনিময় গ্রহণ না করা তাঁদের সত্যতার একটি বিরাট প্রমাণ।
ধর্মব্যবসায়ের বিরুদ্ধে নবী-রসুলদের কঠিন ভূমিকার কিছু বিবরণ পবিত্র কোর’আনে বর্ণিত হয়েছে। যেমন:
১। নূহের (আ.) এর ঘোষণা: হে আমার সম্প্রদায়! এর পরিবর্তে আমি তোমাদের নিকট ধন সম্পদ চাই না। আমার পারিশ্রমিক আল্লাহর নিকট। [সুরা হুদ-২৯, সুরা শুআরা – ১০৯, সুরা ইউনুস – ৭২]
২। হুদের (আ.) ঘোষণা: হে আমার সম্প্রদায়! আমি এর পরিবর্তে তোমাদের নিকট কোনো মজুরি চাই না। আমার পারিশ্রমিক তাঁরই নিকট যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। তোমরা কি তবুও বুঝতে চেষ্টা করবে না? [হুদ-৫১, সুরা শুআরা – ১২৭]
৩। সালেহ (আ.) এর ঘোষণা: আমি তোমাদের নিকট এর জন্য কোনো পারিশ্রমিক চাই না। আমার মজুরি জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে। [শুয়ারা-১৪৫]
৪। লুতের (আ.) ঘোষণা: এর জন্য আমি কোনো মজুরি চাইনা। আমার মজুরি জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে। [শুয়ারা-১৬৪]
৫। শোয়েবের (আ.) ঘোষণা: আমি এর জন্য তোমাদের নিকট কোনো মূল্য চাই না। আমার মজুরি জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে। [শুয়ারা-১৮০]
৬। মোহাম্মদ (সা.) এর প্রতি আল্লাহর হুকুম:
ক. এবং তুমি তাদের নিকট কোনো মজুরি দাবি কোর না। এই বাণী তো বিশ্বজগতের জন্য উপদেশ মাত্র। [ইউসুফ – ১০৪]
খ. বল! আমি এর জন্য তোমাদের নিকট কোনো পারিশ্রমিক চাই না। এবং যারা মিথ্যা দাবি করে আমি তাদের দলভুক্ত নই। [সাদ – ৮৬]
গ. তাদেরকেই (নবীদেরকেই) আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেছেন। সুতরাং তুমি তাদের পথ অনুসরণ কর; বল! এর জন্য আমি তোমাদের কাছে কোনো মজুরি চাই না। [আনআম – ৯০]
ঘ. বল! আমি এর বিনিময়ে তোমাদের কাছ থেকে প্রেম-ভালোবাসা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার ব্যতীত অন্য কোনো মজুরি চাই না। [শুরা – ২৩]
ঙ. আমি তাদেরকে দিয়েছি উপদেশ, কিন্তু তারা উপদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। অথবা তুমি কি তাদের নিকট কোনো প্রতিদান চাও? তোমার প্রতিপালকের প্রতিদানই তো শ্রেষ্ঠ এবং তিনিই শ্রেষ্ঠ রেযেকদাতা। [২৩: সুরা মুমিনুন: ৭১-৭২]
চ. তবে কি তুমি উহাদের নিকট পারিশ্রমিক চাচ্ছো যা ওরা একটি দুর্বহ বোঝা মনে করে? [৫২: সুরা তুর: ৪০]
সুতরাং কোর’আনের ভাষ্যমতে দীনের, ধর্মের কোনো কাজ করে নবী ও রসুলরা যেমন পারিশ্রমিক গ্রহণ করতেন না, তেমনি তাঁদের উম্মাহর জন্যও পারিশ্রমিক গ্রহণ করার বৈধ নয়।