একটি বিষয় আমাদের সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত আছে। আর তা হলো, ধর্মগ্রন্থের উপর কোন ডিগ্রী অর্জন করতে না পারলে কোন ব্যক্তির সে বিষয় নিয়ে কথা বলার কোন অধিকার থাকে না। হতে পারে সে সাধারণ শিক্ষার মাধ্যমে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা ব্যারিস্টার হয়েছে। তাতে কি? ধর্ম বলে কথা, এ বিষয়ে চিন্তা করতে হলে, বা কথা বলতে হলে সেই গ্রন্থের উপর পাণ্ডিত্য অর্জন এর মাধ্যমে মুফতি, মাওলানা, মুহাদ্দিস অথবা আলেমতো হতেই হবে। ধর্মগ্রন্থের উপর উ”চতর ডিগ্রিধারী এই মুরুব্বীরা আবার খুঁটিনাটি ব্যক্তিগত বিষয়ের উপর ফতোয়াবাজি এবং তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় ছাড়া সমাজ এবং মানুষের সমস্যা সমাধানে তেমন কোন ভূমিকা রাখেন না। কিন্তু আমাদের সমাজের দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলোর সৃষ্টি হয়ে থাকে ধর্ম থেকেই, যেমন-জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, অপরাজনীতি, ধর্মব্যবসা ইত্যাদি। যদিও এই সমস্যা সমাধানের জন্য রাষ্ট্রীয় কর্ণধাররা বহু বিধিব্যবস্থার প্রয়োগ করে থাকেন। তথাপি সমস্যার উৎপত্তি যেহেতু ধর্ম থেকে তার সমাধান ধর্ম দিয়ে না দিলে তো আর তার স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না। কিন্তু ধর্মতো বড় শক্ত ব্যাপার, ধর্মীয় কিতাবের উপর পাণ্ডিত্যহীন সাধারণ মানুষেরতো এ ব্যাপারে মন্তব্য করাও মানা। আর এই জুজুর ভয় প্রতিষ্ঠা করেছেন সমাজের সেই আরবি ডিগ্রিধারী মুরুব্বিরাই। তাই সমাজবদ্ধভাবে বসবাসকারী মানুষ এ সকল সমস্যা দেখেও চোখ, কান বন্ধ করে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই।
যদি কোন সাহসী ব্যক্তি এ সমস্যা সমাধানে ধর্ম থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেন, তবেই হুঙ্কার আসে সেই সম্মানিত মহল থেকে জাত কী? কুল কী? লেবাস কোথায়? কোন মাদ্রাসার ছাত্র? কি ডিগ্রী ধারণ করেছে ইত্যাদি। অর্থাৎ সমস্যার সমাধান হল কিনা সেটা বিষয় নয়, যেহেতু ধর্মের উদ্ধৃতি দিয়ে কথা বলছে সুতরাং সেই ব্যক্তির দাড়ি, টুপি, জুব্বা এবং অবশ্যই মাদ্রাসার বিশাল ডিগ্রি চাই। অথচ ইসলামের প্রকৃত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখি যুগে যুগে বারবার ধর্মের আগমন ঘটেছে, সমাজে বিরাজমান সকল সমস্যার সমাধানের মাধ্যমে মানবতার কল্যাণ ও মানুষের মুক্তির জন্য। আর সেই ইতিহাস সৃষ্টিকারী নবী-রসুলগণের দিকে তাকালে দেখি সত্য পাওয়ার পর তারা সমাজে বিরাজমান সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে মানুষকে সেই সত্যের উপর ঐক্যবদ্ধ করার জন্যই সংগ্রাম করে গেছেন। কোন নবী রাসুল আলাদা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে নিজের উপর অবতীর্ণ হওয়া কিতাবের উপর পাণ্ডিত্য অর্জন করানোর জন্য তাঁর অনুসারীদের সর্বো”চ সময় ব্যয় করেন নি। তাদের সময় ব্যয় হয়েছে পুরাতন সমাজব্যবস্থা, রীতি-নীতি পরিবর্তন করে নতুন জীবনধারা প্রতিষ্ঠার কাজে। অন্যদিকে আসহাবগণ সত্য পাওয়ার পর সেই সত্যকে মুখস্থ করে সিনার মধ্যে বন্দি করে রাখাকে সর্বো”চ গুরুত্ব না দিয়ে, সেই সত্যকে পৃথিবীব্যাপী প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তাদের জীবন সম্পদ সর্বস্ব কুরবানী করে পৃথিবীর বুকে বেরিয়ে পড়েছিলেন। তাদের প্রত্যেককে হয়তো টোকা দিলেই গড়গড় করে কোরআনের আয়াত আর হাদিস বেরিয়ে আসতো না, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও দুনিয়া সম্পর্কে অগাধ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন না, নূরানী চেহারা আর থলথলে মেদ বিশিষ্ট ভুঁড়ি ছিল না, ধবধবে সাদা পোষাক পরিহিত থাকতো না। কিন্তু তারা প্রত্যেকেই ছিল আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সর্বস্ব ত্যাগী, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় জর্জরিত রণ-ক্লান্ত মলিন চেহারার অধিকারী এবং স্রষ্টার সান্নিধ্যে জীবন উৎসর্গকারী একদল যোদ্ধা।
রাসুলের ওফাতের পর যে আসহাবগণ প্রিয় নবীর শিক্ষাকে বুকে ধারণ করে দুনিয়ার বুকে ছড়িয়ে পড়েছিলেন সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে, রাসুলের হাতে গড়া সেই প্রিয় আসহাবদের জ্ঞানের পরিধি কতটুকু ছিল তা একটি উদাহরণের মাধ্যমে স্পষ্ট করছি- একদিন আল্লাহর রসুল কিছু অনুসারী নিয়ে গল্প করছিলে। কথাপ্রসঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর কথা উঠলে তিনি মন্তব্য করেন যে, “মুসলমানগন শীঘ্রই হীরা জয় করবে।” একথা শুনে শুবিল (রা.) নামের একজন সরল প্রাণ সাহাবী আগ্রহ সহকারে জিজ্ঞেস করে, “ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমরা হীরা জয় করলে আমি কি কিরামা বিনতে আব্দুল মসী অর্থাৎ হীরার রাজকুমারী কে পাব?” আরবের লোকেরা তখন তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে বলে জানতো। রাসুল (সা:) হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, “হ্যাঁ সে তোমারই হবে।”
রাসুল (সা:) এর ভবিষ্যৎ বাণী অনুযায়ী মুসলিম বাহিনী যখন আল্লাহর তরবারি খ্যাত মহাবীর খালিদের নেতৃত্বে হীরা অঞ্চল জয় করলেন, তখন সুবিল খালিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলেন, “ওহে কমান্ডার! আমি কি হীরার রাজকুমারীকে পাব? আল্লাহর রসুল প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে সে আমার হবে।” সেই প্রতিশ্রুতির সাক্ষীদেরও উপস্থিত করলেন। তখন কিরামা বিনতে আব্দুল মসী অর্থাৎ হীরার রাজকুমারীকে শুবিলের নিকট দেয়ার সিদ্ধান্ত হলো। কিন্তু শুবিলের সঙ্গে যখন রাজকুমারীর সাক্ষাৎ হয় রাজকুমারী তখন ৮০ বছরের বার্ধক্যে উপনীত হয়েছিলেন।
সুবিল অধীর আগ্রহে তার পুরস্কারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। কিরামা তার সামনে হাজির হয়। বেচারা সুবিল তার কাঙ্ক্ষিত রমণীর দিকে একনজর তাকিয়ে সুখে-দুঃখে নির্বাক হয়ে যায়। কারণ সে যেই সুন্দরী রমণীর কথা শুনেছিলো, তার সেই রূপ লাবণ্যে কিছুই অবশিষ্ট নেই। রাজকুমারী বিব্রতকর নীরবতা ভেঙে বলে, “একজন বৃদ্ধা মহিলাকে দিয়ে তুমি কি করবে আমাকে যেতে দাও।”
সুবীল মুক্তিপণ আদায়ের একটি সুযোগ দেখতে পায়। সে বলে, “না আগে আমার শর্ত পূরণ করতে হবে।”
কি তোমার শর্ত? তুমি কত মুক্তিপণ চাও।”
“১০০০ দিরহামের কমে যদি আমি তোমাকে ছেড়ে দেই তাহলে আমি সুবীলের মায়ের পুত্র নই।”
ধূর্ত মহিলা ভান করে বিস্ময় প্রকাশ করে, “১০০০ দিরহাম? ১ দিরহাম কম নয়।”
“হ্যাঁ, এক দিরহামও কম নয়।”
রাজকুমারী দ্রুত ১০০০ দিরহাম সুবীলের হাতে দিয়ে প্রাসাদে ফিরে যায়।
শুবিল তার সহযোদ্ধাদের নিকট ফিরে এসে খুব গর্বভরে এ গল্পটি বলে, সবকিছু শুনে তার বন্ধুরা হাসিতে ফেটে পড়ে। তারা বলে, “তুমি চাইলে আরো অনেক বেশি দিরহাম পেতে পারতে।” এই মন্তব্যে হতভম্ব হয়ে সরল প্রাণ সাহাবি বললেন, “আমি জানতাম না যে হাজারের চেয়ে বড় কোন সংখ্যা আছ।” (বই-আল্লাহর তলোয়ার,লেখক-মেজর জেনারেল এ আই আকরাম)
ইরাকের ভূমিতে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠাকারী মোজাহেদ জানতেন না হাজারের উপরে কোন সংখ্যা হতে পারে! এমন সহজ সরল ও স্বল্প জ্ঞানের অধিকারী সাহাবীও যখন দীন প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হতে পারেন, তখন আমাদের আজকের ধর্মের ধারক-বাহকরা কি করে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত, কেতাবের জ্ঞানহীন বলে মানুষকে তাচ্ছিল্য করতে পারে? কী করে তারা রাসুলের দেখিয়ে দিয়ে যাওয়া এমন সহজ-সরল দীনকে কঠিন দুর্বোধ্য করে সাধারণ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে নিয়ে গেছে! শুধু তাই নয়, ধর্মগ্রন্থের উপর পাণ্ডিত্য অর্জন ছাড়া ধর্ম পালনই সম্ভব না, এ ধারণা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে ধর্মের ঠিকাদার আর সাধারণ মানুষকে তাদের খদ্দের বানিয়ে রেখেছে। আর তাই ধর্ম সম্পর্কে জানতে গেলে সাধারণ মানুষকে এদের দ্বারস্থ হতেই হবে। আর সাধারণ মানুষ ঐশী কিতাবের উপর পাণ্ডিত্য না থাকার হীনমন্যতায় এদেরকে ধর্মগুরু ও জান্নাতে যাওয়ার অসিলা মনে করে, ওদের প্রতিটি অযুক্তিক কথাকেই ধর্ম জ্ঞান করছে। ফলে বিশাল সংখ্যাবিশিষ্ট মুসলিম জনগোষ্ঠী জানতেই পারছে না যে, আল্লাহর সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য কাড়িকাড়ি দোয়া-দরুদ, আর হাদিস মুখস্থ করার মাধ্যমে মুফতি, কারি, হাফেজ, মাওলানা, শায়েখ, মুহাদ্দিস হওয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ আল্লাহর প্রয়োজন একদল মোমেন, যারা জীবন সম্পদ দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রামের মাধ্যমে আল্লাহর দীনকে আল্লাহর জমিনে প্রতিষ্ঠা করবে (সুরা হুজরত-১৫)।
শত শত বছর ধরে মাসলা-মাসায়েলের জ্ঞানে অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে অন্ধত্বের এই চর্চা তাদের যুক্তিবোধের দরজাকে এমনভাবে বন্ধ করে দিয়েছে, যে ধর্ম আজকে তাদের কাছে যুক্তি জ্ঞানের ঊর্ধ্বের বিষয় হয়ে গেছে। তাই এই বিকৃত ধর্মচর্চাই যে পুরো মুসলিম জাতির ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটা তারা দেখেও বুঝতে পারছে না। এমনকি সেই ধ্বংস থেকে উত্তরণের উপায় বের না করে, পুরো জাতি ধর্ম জ্ঞানে পাণ্ডিত্য অর্জনেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে আছে। আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে আল্লাহর রসুল মুসলিম জাতিকে শক্তিশালী ও সুসংগঠিত করার জন্য যেমনি করে তার উম্মাকে দুনিয়ার বুকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ঠিক তেমনি করে আজকের মুসলিম জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে জাতিকে রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে প্রচেষ্টাই কি প্রধান দায়িত্ব নয়? নাকি যার যার মাদ্রাসায় ধর্মব্যবসা রক্ষার্থে জাতির মধ্যে ধর্ম জ্ঞানে পাণ্ডিত্য অর্জনের গুরুত্ব বোঝানো প্রধান দায়িত্ব? সকল বিবেকবান মানুষের কাছে এই চিন্তার দায় রইল।