ওমর (রা.) ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা। ইসলাম কবুলের পর তিনি আরব্য জাহেলিয়াতকে নিজের চরিত্র থেকে একেবারে ধুয়ে ফেলতে সফল হয়েছিলেন। সাহস ও বীরত্ব ছিল তাঁর জন্মগত স্বভাব। ইসলামের প্রাথমিক যুগে দরিদ্র ও দাসশ্রেণি থেকে যারা ইসলামে দীক্ষিগত হয়েছিলেন তাদের উপর ভয়াবহ নির্যাতন চালাতেন। কোরায়েশ বংশের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসাবে তাঁর ভিতরেও বংশীয় গরিমা ছিল। কিন্তু দীন গ্রহণের পর থেকে তাঁর ভিতরে কোনোরূপ বর্ণবাদী ধ্যানধারণা অবশিষ্ট ছিল না। তাঁর চারিত্রিক আদর্শ এতটাই উন্নত পর্যায় পৌঁছেছিল যে, তাঁর সময়ের প্রতি অপূর্ব নিষ্ঠা, আল প্রতি ভালোবাসা, সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা, দুনিয়ার ভোগবিলাস পরিহার, সত্যবাদিতা, আমানতদারিতা, দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি আল্লাহর সর্তকতা, অন্যায়ের ব্যাপারে কঠোরতা ইত্যাদি গুণগুলি তৎকালীন মানুষের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। যারাই ওমরের (রা.) সাহচর্য লাভ করেছেন তাদের প্রত্যেকের মাঝে ঐ সমস্ত গুণগুলি ফুটে উঠতো। তাঁর চারিত্রিক গুণাবলি সম্পর্কে ঐতিহাসিক পন্ডিত আল্লামা মাসউদী বলেন, ওমর এর মধ্যে যে সমস্ত উন্নত চারিত্রিক গুণাবলি ছিল, তার খেলাফতের সহকর্মীদের মধ্যেও অবিকল তার প্রতিফলন হতো। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আবু ওবায়দা (রা.), সালমান ফারসী (রা.), সা’দ ইবনে আমির (রা.) ইত্যাদি সাহাবীদের মধ্যে ওমরের (রা.) গুণাবলি বিদ্যমান ছিল।
১। কু-অভ্যাসের মূলোৎপাটন
আরব জাতির মধ্যে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও জাহিলিয়াতের সময়ে যে সমস্ত নাফরমানী ছিল তার অনেক খারাপ অভ্যাস তৎকালীন আরব জাতির মধ্যে ছিল। বংশ নিয়ে অহংকার, আত্মাম্ভরিতা, সাধারণ মানুষকে ঘৃণা করা, মানুষকে অপমান করে কথা বলা, কথায় কথায় গালি দেওয়া, উচ্ছৃংখল জীবন যাপন করা, মদ্যপান করা ইত্যাদি বিষয়গুলো বিশেষভাবে উলেস্নখযোগ্য ছিল। ওমরের (রা.) শাসনামলে এ সমস্ত অভ্যাসগুলো তিনি কঠোর হাতে দমন করেছিলেন। তাঁর সামনে যে সমস্ত গর্ব অহংকারের বস্তু পরিলক্ষিত হতো বা তা যদি কারো মধ্যে তিনি দেখতে পেতেন তাহলে তিনি তার সমস্ত শক্তি দিয়ে সেই অহংকার ও দাম্ভিকতাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতেন। নিজ বংশ নিয়ে যে অহংকার আরব সমাজে প্রচলিত ছিল সেটি তারা যুদ্ধের ময়দানে পর্যন্ত দেখিয়ে থাকতেন। ওমর সেটাকেও আইন করে বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
২। প্রভু ও দাসের মধ্যে ব্যবধান দূরীকরণ
ওমর (রা.) যখন খেলাফতের দায়িত্ব পালন করেন তখন প্রভু আর দাস বলে কোনো শব্দ ছিল না। মালিক এবং কর্মচারি সকলেই সমান সুযোগ ভোগ করতেন। উভয় শ্রেণি একে অপরকে অত্মা থেকে সম্মান করতেন। উভয় শ্রেণির মাঝে মানবিক মর্যাদার কোন ব্যবধান তিনি রাখেন নি। যখনই তিনি দেখেছেন যে, কোনো মালিক তার কর্মচারির প্রতি অবিচার করছে বা কর্মচারির বেতন ঠিকমতো পরিশোধ করেনি অথবা কর্মচারিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলছেন তখন তিনি সেগুলোকে কঠোর হাতে দমন করতেন এবং তিনি এগুলোকে কখনোই সহ্য করতেন না। একদিন আরবের সাফওয়ান ইবনে উমাইয়াসহ আরো অনেকে ওমরকে (রা.) তাদের বাড়িতে দাওয়াত দিলেন, তিনি সেখানে গিয়ে দেখলেন কর্মচারি এবং মালিকদেরকে একসাথে খেতে দেওয়া হয়নি। অবস্থা দেখে তিনি ব্যাপক মনঃক্ষুণ্ণ হলেন এবং তাদেরকে সাথে সাথে সতর্ক করে দিলেন যেন ভবিষ্যতে আর কখনো মালিক এবং কর্মচারিদের মাঝে এরকম কোন ব্যবধান না রাখা হয়।
৩। কুৎসা রটনাকারী কবিদের ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বন
ওমর (রা.) এর শাসনামলে তখনো আরব সমাজে মানুষ বংশমর্যাদা নিয়ে একে একে অপরকে কুৎসা রটনা করে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতো। আর জাহেলিয়াতের যুগে এ কুৎসা রটনার অন্যতম হাতিয়ার ছিল অশালীন কবিতা রচনা। কবিতা রচনা করে এক গোত্র অন্য গোত্রকে অপমান করতো। আরব সমাজের চিরাচরিত বদ অভ্যাস, উচ্ছৃংখলতা ও অবৈধ প্রেমের প্রধান বাহন ছিল এই কবিতা। তৎকালীন সময়ের কবিরা নিজ-নিজ প্রিয়ার নাম নিয়ে অত্যন্ত নগ্ন ও অশালীন কবিতা লিখতেন এবং এগুলো সমাজে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। তারপর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে নগ্নতা, উচ্ছৃংখলতা ব্যাপকভাবে প্রসার হতো। যখন মুখে মুখে একে অপরকে কবিতার মাধ্যমে কুৎসা রটনা করে অপমান অপদস্থ করত তখন তাদের মধ্যে মারামারি থেকে শুরু করে যুদ্ধ পর্যন্ত বেঁধে যেত। আর এই যুদ্ধ বছরের পর বছর পর্যন্ত চলতে থাকত। ওমর (রা.) এই প্রকার কুৎসা রটনামূলক কবিতাকে একটি ‘অপরাধ’ বলে ঘোষণা করলেন এবং এই অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রাখলেন। যারা এরকম কুৎসা রটনামূলক কবিতা রচনা করেছিলেন তাদের অনেককে ওমর (রা.) শাস্তি দিয়েছিলেন।
৪। ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মতামতের অধিকার প্রদান
ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মতামতের অধিকার মানুষের জীবন-যাপনের একটি অন্যতম মাধ্যম। মানুষ যখন একটি সমাজে বসবাস করে তখন তার ব্যক্তি স্বাধীনতা না থাকলে সে সমাজে উন্নত চরিত্র এবং আত্মামর্যাদা নিয়ে বসবাস করতে পারেনা। তাই ওমর (রা.) ব্যক্তি স্বাধীনতাকে যথেষ্ট মর্যাদা দিয়েছিলেন এবং সমাজের প্রত্যেকের ব্যক্তি স্বাধীনতাকে তিনি গুরুত্ব দিয়ে তাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ দিয়েছিলেন। ওমরের (রা.) শাসনামল ব্যতীত আর কোন খলিফার শাসনামলে এমন নিরঙ্কুশভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা জনগণ ভোগ করতে পারেনি। ওমরের পরবর্তী শাসকগণ বিশেষ করে উমাইয়া খলিফাগণ মতামত প্রকাশের অবাধ অধিকারের ঘোর বিরোধী ছিলেন। খলিফা আব্দুল মালিক প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন যে, কোনো ব্যক্তি তার নির্দেশের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারবে না। যারা তার বিরুদ্ধে কথা বলবেন তাকে তিনি কঠিন শান্তি দিতেন। উসমান (রা.) এবং আলী (রা.) অবশ্য ব্যক্তিস্বাধীনতার উপরে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করেন নাই। কিন্তু এই হস্তক্ষেপ না করার খারাপ পরিণতির দিকটি তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন নাই। এজন্য আলী (রা.) “জামাল” ও “সিফফিনের” রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে শামিল হতে বাধ্য হন। অপরদিকে ওমর (রা.) অত্যন্ত উচ্চস্তর ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মতামত প্রকাশের অধিকার দান করা সত্ত্বেও জনসাধারণের আত্মার আইন শৃঙ্খলা ও শাসন ক্ষমতার পূর্ণ মর্যাদা বজায় ছিল। ওমর (রা.) ঘোষণা দিতেন যে, পৃথিবীর প্রতিটি আদম সন্তান মায়ের গর্ভ থেকে স্বাধীনরূপে জন্মলাভ করেছে। সুতরাং প্রত্যেক আদম সন্তান স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করতে পারবে।
৫। আরবের প্রভাবশালী নেতাদের দাম্ভিকতায় হস্তক্ষেপ।
আরব সমাজে একটি প্রচলিত রীতি ছিল যে, সমাজের উচ্চস্তরের লোকজনকে অর্থাৎ প্রভাবশালী নেতাদেরকে নিন্মস্তরের লোকেরা যখন সম্বোধন করতেন তখন তারা বলতেন “আমার পিতা মাতা আপনার উপর উৎসর্গ”, “আল্লাহর আমাকে আপনার উপর কোরবান করুক” ইত্যাদি নানা প্রকার স্তুতিবাক্য ব্যবহার করত। যা ওমর (রা.) কোনভাবেই সহ্য করতে পারেননি। এই সমস্ত বাক্য দ্বারা যেহেতু মানুষে মানুষে একটা অহেতুক প্রভূত্ব ও দাসত্বের মনোভাব বৃদ্ধি পায় এজন্য ওমর (রা.) এই স্তুতিমূলক বাক্যকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করলেন। কেউ যদি তাকে এরূপ বলত তবুও তিনি তাকে সতর্ক করতেন। ওমরের (রা.) এই প্রকারের ব্যবহারের দ্বারা সাধারণ মানুষের অšত্মর যে কত উন্নত হয়েছিল এবং সাধারণ মানুষ যে কত স্বাধীন মতামত প্রকাশ করত তা নিম্নে কয়েকটি ঘটনা হতে উপলব্ধি করা যায়
(ক) একদিন ওমর (রা.) বক্তব্যয় বলতেছিলেন, ভাইসব! আমি যদি দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হইয়া যাই তবে তোমরা কি করবে? তৎক্ষণাৎ এক ব্যক্তি তরবারি মুক্ত করে বলল, “এটি দিয়ে আমি তোমার মস্তক দ্বিখন্ডিত করে দিব।” ওমর (রা.) লোকটির মনোবল পরীক্ষার জন্য ধমক দিয়ে বললেন “এত স্পর্ধা!” লোকটি বললো নিশ্চয়ই! নিশ্চয়ই!। এ কথা শোনার পর ওমর (রা.) হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললেন, “আলস্নাহকে ধন্যবাদ যে, আমার জাতির মধ্যে এমন লোকে বিদ্যমান আছে যদি আমি বিপদে চলে যাই তবে তিনি আমাকে সরল পথে আনতে সমর্থ হবেন।”
(খ) মুসলিমরা যখন পুরো আরব উপদ্বীপে সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তখন অনেক মুজাহিদ তৎকালীন খ্রিষ্টান নারীদেরকে বিবাহ করছিলেন। ওমর (রা.) এই বিয়েকে পছন্দ করতেন না। তাই তিনি তৎকালীন ওই এলাকার আমির হুযাইফা ইবনুল ইয়ামানকে চিঠি লিখে বললেন, তিনি এরূপ বিবাহ পছন্দ করেন না। জবাবে হুজাইফা উত্তর দিলেন, এটা কি আপনার ব্যক্তিগত মত নাকি শরিয়তের বিধান? ওমর লিখিলেন, এটি আমার ব্যক্তিগত মত, শরিয়তের বিধান নয়। হুজাইফা তখন বললেন, “আপনার ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ মেনে চলতে আমরা প্রয়োজনবোধ করি না।” শেষ পর্যন্ত দেখা গেল যে, ওমর (রা.) এর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও অনেক লোকই খ্রিষ্টান নারীদেরকে বিবাহ করেছিলেন।
এ দুটি ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ওমর (রা.) এর শাসনামলে মানুষ এতোটাই ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মতামত প্রকাশ করতে পারত যা কেবল কল্পনাই করা যায়, যার স্বপ্ন দেখা যায় কিন্তু বাস্তবে মেলে না। ওমর (রা.) এই উদারতা সৃষ্টির ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা হয়ে মানবজাতির সামনে শিক্ষনীয় হয়ে আছে। এক কথায় ওমর (রা.) আল্লাহর দীনকে এমনভাবে ধারণ করেছিলেন এবং সেটাকে নিজের শাসনব্যবস্থায় প্রয়োগ করেছিলেন যা গোটা মুসলিম জাতির প্রত্যেকটি মানুষের মানসিক পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল। তাঁর সময়ে তিনি সততা, দৃঢ়তা, আদর্শবাদী ও নিষ্ঠাবান চরিত্র, আলস্নাহর প্রতি ভক্তি, সংকটকালে সবর ও আত্মমর্যাদার এক জীবন্ত মূর্তিতে পরিণত হয়েছিলেন।