মোহাম্মদ আসাদ আলী
এক হাজার বছর আগের পৃথিবী আর একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবী এক নয়। এক হাজার বছর আগের পৃথিবীর সমস্যা ছিল একরকম, বর্তমান যুগের সমস্যা অন্যরকম। তখনকার মানুষের চিন্তাধারার সাথেও বর্তমান যুগের মানুষের চিন্তাধারার বিস্তর তফাৎ হয়ে গেছে। সবকিছুই পরিবর্তিত হয়েছে, শুধু ইসলামকে আমরা আটকে রেখেছি হাজার বছর আগের ফকিহ-মুফাসসির-মুহাদ্দিসদের লেখা কিতাব-কালামের মধ্যে। চিন্তাশীলতা ও যুক্তিশীলতার এই যুগে আমাদের দায়িত্ব ছিল ইসলামকেও যুক্তিনির্ভর যুগোপযোগী দ্বীন হিসেবে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা, কিন্তু আমরা যুগের এই চাহিদা অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছি। পৃথিবীতে যখন তথ্য-প্রযুক্তির জোয়ার বয়ে যায় আমরা তখন ছবি তোলা জায়েজ কিনা তা নিয়ে বিতর্ক করি। পৃথিবী যখন সাম্রাজ্যবাদে জর্জরিত আমরা তখন ফেরকাবাজে লিপ্ত। পৃথিবী যখন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নামক অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের সঙ্কটে নিমজ্জিত আমরা তখন মানুষের দাড়ি আর টাখনুর কাপড় মাপতে ব্যস্ত। এভাবে ধর্মকে আমরা ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আবদ্ধ করে ফেলেছি।
আল্লাহর দেওয়া আকাশের মত বিশাল ইসলামকে আমরা যারা দাড়ি, টুপি, মেসওয়াক, পাগড়ী, টাখনু, ঢিলা, কুলুখ ইত্যাদির মধ্যে আবদ্ধ করে রেখেছি, হাশরের দিনে কী জবাব দেব আল্লাহ ও রসুলের কাছে?
আজ আমাদের সমাজব্যবস্থা বিপর্যস্ত কিন্তু ধর্ম তা নিয়ে কথা বলে না। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা ভঙ্গুর কিন্তু ধর্ম তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। আমাদের অর্থব্যবস্থা শোষণবান্ধব কিন্তু ধর্মের তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা মানুষকে পশু বানাচ্ছে কিন্তু ধর্মের সেদিকে নজর নেই। আমাদের বিশ্ব উত্তপ্ত হয়ে আছে অন্যায়, অবিচার, যুদ্ধ, রক্তপাতে কিন্তু ধর্ম আছে চোখ বন্ধ করে। বাস্তব সমস্যার কোনো সমাধান মানুষ ধর্ম থেকে পাচ্ছে না। অন্যান্য ধর্মের মত ইসলামকেও নিছক পরকালমুখী আচার-অনুষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। তাহলে মানুষ কেন সেই ধর্মের দিকে আকৃষ্ট হবে?
যে মানুষ ক্ষুধার জ্বালায় কষ্ট পাচ্ছে তার খাদ্য দরকার। যে তাকে খাদ্য দিবে সে-ই তার কাছে অবতার। মানুষ তাকেই আলিঙ্গন করে নিবে। সে কোন ধর্মের কোন জাতের তা দেখবে না। আমরা আল্লাহর রসুলকে বিশ্বের রহমত বলে গর্ববোধ করি, কিন্তু আমাদের ধর্ম যদি ঐ ক্ষুধার্ত মানুষের কষ্ট দূর করতে না পারে, এমনকি এ নিয়ে ভাবনারও প্রয়োজনবোধ না করে তাহলে ঐ ক্ষুধার্ত মানুষগুলো কোন কারণে আমার ধর্মের দিকে আকৃষ্ট হবে? তারা সেই মতবাদের দিকেই আকৃষ্ট হবে যে মতবাদ তাদের জীবন বাঁচাতে এগিয়ে আসবে। যেমন রাশিয়া, চীন, কিউবা, ভিয়েতনামের অনাহারী মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য সমাজতন্ত্র এগিয়ে এসেছিল, তাই তারা সমাজতন্ত্রকে আলিঙ্গন করে নিয়েছে। যদি ইসলাম এগিয়ে আসত তাহলে ইসলামকেই তারা আলিঙ্গন করে নিত আর আল্লাহ-রসুলকে নিজেদের প্রাণের চেয়ে প্রিয় মনে করত।
একইভাবে যে মানুষের থাকার জায়গা নেই, ফুটপাতে রাত কাটাচ্ছে, দেশে দেশে বিতাড়িত হচ্ছে, তার নিরাপদ আশ্রয় দরকার। যে তাকে আশ্রয় দিবে সে-ই তার ভক্তিস্থানীয় হবে। আমাদের ধর্ম তো ওসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। ওগুলোকে দুনিয়াদারী মনে করা হচ্ছে। মানুষ রোদ বৃষ্টিতে কষ্ট পাচ্ছে কিন্তু আমরা কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে আলীশান মসজিদ বানাচ্ছি, সোনার গম্বুজ বসাচ্ছি। তাহলে ঐ আশ্রয়হীন মানুষ কেন ধর্মের দিকে আকৃষ্ট হবে? আলীশান মসজিদের পাশে ভিক্ষারত অনাহারী ছিন্নমূল মানুষটির কাছে আল্লাহর ঘর মসজিদের দুনিয়াবী কোনো মাহাত্ম্য আছে কি?
প্রকৃতপক্ষে মানুষের এসব বাস্তব সমস্যা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা অর্থাৎ যুগের চাহিদা পুরণ করতে ব্যর্থ হওয়ার পরিণতি এই হয়েছে যে, যারা সমাজ নিয়ে একটু হলেও চিন্তা করে, পৃথিবীর সঙ্কটগুলোকে উপলব্ধি করে এবং তার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করে, তারা ধর্ম থেকেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ধর্ম তাদের কাছে প্রাচীন ঐতিহ্যের নামমাত্র। বাস্তব সমস্যার সমাধান হিসেবে তারা গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ ইত্যাদি ব্যবস্থা বেছে নিচ্ছে। এই ব্যবস্থাগুলো প্রতিষ্ঠার জন্য তারা জান-মাল দিয়ে সংগ্রাম করছে, প্রয়োজনে জীবন দিচ্ছে, যেভাবে উম্মতে মোহাম্মদী জাতি এক সময় আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছে। কিন্তু উম্মতে মোহাম্মদীর সাথে এই গণতন্ত্রী-সমাজতন্ত্রীদের পার্থক্য হচ্ছে, এদের এই আত্মত্যাগ শেষাবধি মানুষকে ন্যায়, শান্তি ও সুবিচার এনে দিতে পারছে না, কারণ এগুলো মানবসৃষ্ট মতবাদ, ত্রুটিযুক্ত ও ভারসাম্যহীন, শান্তি আসবে কেবল আল্লাহর দেওয়া ব্যবস্থায়, যেটা উম্মতে মোহাম্মদী করে দেখিয়েছি ইতিহাসে।
কিন্তু সেই আল্লাহর দেওয়া আকাশের মত বিশাল ইসলামকে আমরা যারা মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকা, হুজরার মধ্যে আবদ্ধ করে রেখেছি এবং মানবজাতিকে দিনদিন ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যেতে দেখেও দাড়ি, টুপি, মেসওয়াক, পাগড়ী, টাখনু, ঢিলা, কুলুপ ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত রয়েছি তারা হাশরের দিনে কী জবাব দেব আল্লাহ ও রসুলের কাছে?