আল্লাহর রসুলের ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি ভবিষ্যদ্বাণী হচ্ছে, “এমন এক সময় আসবে যখন আমার উম্মাহ তিয়াত্তর ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে এবং এদের মধ্যে একটি ভাগ ছাড়া বাকি সবাই আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে। উপস্থিতগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রসুল, সেই একটি ভাগ কারা যারা সত্যের উপর অটল থাকবে? আল্লাহর রসুল বললেন, আমি ও আমার সাহাবিদের অনুসৃত পথকে যারা অনুসরণ করবে তারা।”
বর্তমানের মুসলিম জাতির দিকে যদি আমরা দৃষ্টিপাত করি তবে দেখবো আজ আমরা বহুভাগে বিভক্ত। এই বিভক্ত জাতির প্রতিটি ফেরকা, মাজহাব বিশ্বাস করে যে শুধু তারাই প্রকৃত ইসলামে রয়েছে বাকি সবাই পথভ্রষ্ট ঠিক অন্যান্য ধর্মের লোকেরা যেমন বিশ্বাস করে শুধু তাদের ধর্মই সত্য এবং অন্য সকল ধর্মের মানুষ জাহান্নামে যাবে। কিন্তু আসলে অন্যান্য ধর্মের লোকেরা যেমন তাদের নবীর (আ.) দেখানো পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছে তেমনটাই ঘটেছে এই শেষ দীনের, ইসলাম, অনুসারীদের সাথেও। ইসলামের চুলচেরা বিশ্লেষণের ফলে আজ ইসলামের যে বিকৃতি ঘটেছে তার ফলেই আজ আমরা এতগুলো ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছি।
প্রকৃত ইসলামে কোন ফেরকা মাজহাবের বিভক্তি ছিল না। গোটা জাতিটি ছিল অখণ্ড, যাদের নেতা ছিলেন একজন, হুকুম চলতো শুধু এক আল্লাহর। কিন্তু সেই এক জাতি ভেঙ্গে গিয়ে আজ আল্লাহর হুকুমকে বাদ দিয়ে দাজ্জালের তৈরি তন্ত্র-মন্ত্র কে গ্রহণ করে প্রকাশ্যে শিরকে লিপ্ত রয়েছে। আকিদা বিচ্যুতির কারণে তারা এই সরল বিষয়টিও দেখতে পারছে না। জাতীয় জীবনে তওহীদ না থাকায় এ জাতি যে আল্লাহর দৃষ্টিতে মো’মেন মুসলিম ও উম্মতে মোহাম্মদী নেই তা এরা উপলব্ধি করতে পারছে না।
বর্তমান এই জাতিকে এই সত্যটি উপলব্ধি করাবে কে? এ নিমজ্জিত জাতিকে উদ্ধারের একমাত্র আশা কারা? এর একমাত্র আশা তিয়াত্তর ফেরকার সেই ফেরকা যারা আল্লাহর রসুল ও তাঁর আসহাবদের অনুসৃত পথে রয়েছে। তাহলে তাদের বৈশিষ্ট্য কী হবে? তাদের চেনা যাবে কীভাবে? তাঁদের কাজ কী হবে?
একটি বস্তুকে যদি আপনি ধারণ করেন তবে সেই বস্তুটির গুণাগুণ সবসময়ই একই হবে। এমন হবে না যে একই বস্তু ভিন্ন ভিন্ন লোক ধারণ করায় এর প্রভাব ভিন্ন ভিন্ন হচ্ছে। যেমন ধরুন আপনি খুশবু লাগালে আপনার শরীর থেকে যেরূপ সুঘ্রাণ পাওয়া যাবে তেমনি অন্য কেউ লাগালেও একই হবে। তেমনি প্রকৃত ইসলাম গ্রহণ করার ফলে আল্লাহর রসুলের আসহাবরা যেই চরিত্র অর্জন করেছিলেন যেই কাজ করেছিলেন এই জান্নাতি ফেরকাও ঠিক একই কাজ করবে অর্থাৎ এদের দায়িত্বও হবে প্রকৃত ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা, পথভ্রষ্ট এ জাতিকে পুনরায় প্রকৃত ইসলামে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। যেহেতু তাঁদের ও পূর্ববর্তীদের একই দায়িত্ব, একই বিষয় তাহলে পূর্ববর্তীদের মতো এদেরও মুখোমুখী হতে হবে একই বাধার, যেই বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল প্রত্যেক নবীকে। চারদিক থেকে প্রতিরোধ আসবে, প্রতিরোধ আসবে পাশ্চাত্য দাজ্জালীয় শিক্ষায় শিক্ষিতদের কাছ থেকে, আসবে তাদের কাছ থেকে যাদের ইসলামের নাম শুনলেই পা থেকে মাথা অবধি জ্বলে যায়, সবচেয়ে বড় বাধা আসবে এই শেষ ইসলামের লেবাসধারীদের কাছ থেকে যারা ধর্মের ধারক বাহক সেজে বসে রয়েছে এবং ধর্মই তাদের কাছে জীবিকা, উপার্জনের মাধ্যম। তারা রসুলের সুরত ধারণ করে মানুষকে ঠকিয়ে ধর্মকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে নিচ্ছে। ভুললে চলবে না আল্লাহর রসুল সর্বপ্রথম বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন আরবের তদানিন্তন ধর্মের পুরোধা, কাবার রক্ষণাবেক্ষণকারী কোরাইশদের কাছ থেকে, সাধারণ মানুষ থেকে নয়।
একই ঘটনা হয়েছিল প্রতিটি যুগেই। ঈসা (আ.) এর বিরুদ্ধে কঠিনতম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল তৎকালীন ধর্মের আলেম, ধার্মিক, রাব্বাই সাদ্দুসাইরা অর্থাৎ ধর্মের ধারক বাহক সেজে থাকা গোষ্ঠীটি। তাদের এই প্রতিরোধের কারণ হচ্ছে তাদের অহংকার এবং দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে তাদের কায়েমী স্বার্থে, উপার্জনের পথে হস্তক্ষেপ। এখনও মিলাদ পড়িয়ে, মুর্দা দাফন করে, ওয়াজ করে, মাহফিল ইজতেমা করে, মুর্দার কুলখানী করে এক কথায় অন্যান্য ধর্মের মতো পৌরোহিত্য করে এবং ভারসাম্যহীন বিকৃত তাসওয়াফের পীর-মুরিদী করে যে সহজ উপজীবিকার পথ রয়েছে তা জান্নাতি ফেরকার অভ্যুদয়ের ফলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। এই দুই কারণেই তারা মাহদী (আ.) এবং ঈসা (আ.) এর আগমন ঘটলেও তাঁদের অস্বীকার করবে।
জান্নাতি ফেরকা অন্যান্য বাহাত্তর ফেরকার সামনে ইসলামের সঠিক আকিদা তুলে ধরবে এবং তাদের সেই সঠিক আকিদার দিকে আহ্বান করবে। জাতি যে চুলচেরা বিশ্লেষণের ফলে ইসলামের মূল তওহীদ থেকে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছে তা উপলব্ধি করানোর আপ্রাণ চেষ্টা করবে এই জান্নাতি ফেরকারা। একজন ব্যক্তিকে বাহ্যিকভাবে দেখে বোঝার উপায় নেই যে লোকটি ভালো নাকি খারাপ। উভয়ের বাহ্যিক দৃশ্য একই এমনকি ভালো ব্যক্তিটির তুলনায় খারাপ ব্যক্তিটি সুদর্শন হতে পারে। শুধু ভিতরের চরিত্রের জন্যই দুজন দুই দিকে, একজন ভালো এবং অন্যজন মন্দ। বর্তমানে আমরা যে দীনকে ইসলাম বলে আঁকড়ে ধরে আছি এ দীনও বাহ্যিকভাবে আল্লাহর রসুলের আনীত দীনের মতোই। যেকের আসকার, সালাহ, সওম অর্থাৎ কার্যকলাপ একই। কিন্তু এই ইসলামের ফলাফল এবং আল্লাহর রসুলের ইসলামের ফলাফল মোটেও এক নয়। যারা ইতিহাস জানেন তারা অকপটে আমার এই কথা স্বীকার করে নিবেন। জান্নাতি ফেরকা এই প্রকৃত ইসলামের রূপ গোটা বাহাত্তর ফেরকার সামনে তুলে ধরবে।
যে জাতি ছিল বিস্ফোরণমূখী, সংগ্রামী, যারা সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেদের জীবন সম্পদকে অকপটে উৎসর্গ করেছিল সে জাতি আজ বিকৃত আকিদার ফলে অর্ন্তমুখী হয়ে পড়েছে। সে জাতি আজ সারা পৃথিবীময় মার খাচ্ছে। জান্নাতি ফেরকা এই উম্মাহর হারিয়ে যাওয়া সেই সংগ্রামী চরিত্রকে পুনরায় জাতির জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে।
জান্নাতি ফেরকারা এ বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পথে নামবে। তাঁরা বাহাত্তর ফেরকাকে উদ্দেশ্য করে বলবে, “ভাই দেখুন আমাদের মধ্যে মাসলা মাসায়েল নিয়ে যতই বিভেদ থাকুক আমরা অন্তত এক আল্লাহ, এক রসুল ও এক কেতাবে বিশ্বাসী তো? তাহলে মেহেরবানী করে শুধু এর উপর ঐক্যবদ্ধ হও। বাকি যে সব মতভেদ রয়েছে সেগুলোকে ব্যক্তিজীবনেই রাখো, সেগুলো নিয়ে আর মতভেদ করো না। যেখানে আল্লাহর রসুল বহুবার বলেছেন যে আল্লাহকে ব্যক্তিজীবন ও জাতীয় জীবনে হুকুমদাতা (ইলাহ) হিসেবে মেনে নিলে জাহান্নামের আগুন আর স্পর্শ করতে পারবে না, জান্নাতে যাওয়া যাবে সেখানে আমরা শুধু শুধু মতভেদ করে নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিচ্ছি কেন?”
জান্নাতি ফেরকাকে চেনার আরেকটি অন্যতম উপায় হচ্ছে এই বাহাত্তর ফেরকার কেউ যদি তাঁদের কাউকে প্রশ্ন করে যে আপনি শিয়া না সুন্নী, আহলে সুন্নাতে জামায়াত না আহলে হাদিস, মালেকী না হাম্বালী, না অন্য কিছু? তখন তাঁরা জবাব দিবে, ভাই আমি তার কোনটাই না, আমি প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছি মো’মেন ও উম্মতে মোহাম্মদী হতে। জাতীয় জীবনে ইসলাম না থাকায় আমরা তো তওহীদ থেকেই দূরে সরে এসেছি। সর্বপ্রথম তওহীদ গ্রহণ করে আবার ইসলামে ঢোকাটাই এখন মূল কাজ। প্রথমে বাড়িতে ঢুকতে হবে এরপরই না বিবেচনা করবো আমি কোন কামরায় থাকবো। তাই নয় কী?