প্রতিটি কাজের একটি ফলাফল রয়েছে। আপনি যদি ভালো কাজ করেন তবে সেই কাজের ফল একরকম আবার আপনি যদি খারাপ কাজ করেন তবে সেই কাজের ফল হবে ভিন্নরকম। প্রতিটি কাজের জন্য একটি নির্দিষ্ট ফল আপনি অবশ্যই লাভ করবেন।
ধরুন আপনি একটি আম গাছ লাগিয়েছেন, বছর ঘুরে গাছটি যখন বড় হবে, ফল দেয়ার সময় হবে, তখন সেই গাছ থেকে আপনি সুমিষ্ট আম লাভ করবেন, সেই ফল আপনাকে যেভাবে উপকৃত করবে সেভাবে উপকৃত করবে আপনার আত্মীয়, প্রতিবেশী এবং পরিবেশের অন্যান্য জীবদের। আর যদি আপনি আম গাছের বদলে মাকাল ফলের গাছ লাগান তবে আপনার গাছ থেকে মাকাল ফলই আসবে। সেই ফলে না আপনার কোন লাভ হবে, না আপনার আশেপাশের কারো। তাই আপনি কোন কর্ম করছেন সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কারণ কর্মফল এড়ানো কখনই সম্ভব নয়।
এবার আসুন আমাদের বর্তমান সভ্যতার দিকে একটু দৃষ্টিপাত করি। বর্তমান সভ্যতাকে আমি অন্তত সভ্যতা বলার পক্ষে নই। আমার সাথে অনেকই এ বিষয়ে দ্বিমত করতে পারেন কিন্তু হ্যাঁ আমি দ্ব্যার্থহীনকণ্ঠে বলবো বর্তমান সভ্যতা কোন সভ্যতাই নয়। যারা আমার সাথে একমত হবেন না তার সম্ভাব্য যে সকল যুক্তি উপস্থাপন করবেন সেগুলো হচ্ছে, বর্তমানে আমরা অন্যান্য সকল সময় থেকে অধিক উন্নত, আমাদের অত্যাধুনিক কল-কারখানা রয়েছে, অত্যাধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা হয়েছে, যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে, যোগাযোগ মাধ্যমে মাইলফলক অর্জন করেছি, আমরা মহাকাশে পৌঁছে গেছি, সর্বব্যাপী যেদিকে দেখবো উন্নয়ন আর উন্নয়ন। হ্যাঁ এটা ঠিক, এই উন্নয়নকে আমি অস্বীকার করছি না কিন্তু এই বস্তুগত উন্নয়ন কে সভ্যতা বলা যায় না। একে বড়জোড় প্রযুক্তিগত প্রগতি বলা চলে।
সভ্যাতা মানেই প্রযুক্তি ও নগরায়ণ নয়। সভ্যতা শব্দটির মূল ‘সভ্য’। সভ্য শব্দের অর্থ ভালো, মার্জিত, সুরুচিপূর্ণ, ভদ্র, শিষ্ট ইত্যাদি। অর্থাৎ ভালো কে গ্রহণ করে মন্দকে বর্জন করেই ধীরে ধীরে সভ্যতা গড়ে উঠে।
তো এই যে প্রযুক্তিগত প্রগতির ফলে আমরা আমাদের তথাকথিত সভ্যতাকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছি? যান্ত্রিকভাবে যত এগোচ্ছি তত আত্মিকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে আমাদের হাতে যে পারমাণবিক অস্ত্র জমেছে তার মাধ্যমে পুরো পৃথিবীকে ভেঙ্গে তছনছ করে দেয়া যাবে। ভেঙ্গে দিচ্ছে না এর কারণ এই নয় যে অসহায় মানব সন্তানদের ক্ষতি হবে, এর কারণ হচ্ছে ভয়। শত্রুকে মারলে আমিও মরবো, এই ভয়। এখানে মানবতা, দয়া, ন্যায়ের প্রতি সম্মান নয়, অন্যায়ের প্রতি বিরূপতা নয়, কত কোটি মানুষ মরবে সেই অনুভূতিও নয়- শুধুই ভয়। যান্ত্রিক ‘সভ্য’ ভাষায় এরই নাম দা’তাত (Deterrent)। যেই মুহূর্তে আমাদের বর্তমান পরাশক্তি রাশিয়া ও আমেরিকার যে কোনো একজন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারবে যে তারা অপর পক্ষ থেকে অধিক শক্তি অর্জন করেছে এবং অপরপক্ষের অস্ত্রের যথাযথ জবাব তার কাছে রয়েছে, অপরপক্ষের অস্ত্রে তার ক্ষতির কোন সম্ভাবনা নেই, তখনই সে অপরপক্ষকে হামলা করবে। আমার কথার সাথে যারা একমত হবেন না তাদের জন্য দুই দুটি বিশ্বযুদ্ধই অনেক বড় উদাহরণ। পিস্তল হাতে দ্বন্দযুদ্ধে (Duel) নামা দুইজন ব্যক্তি থেকে এটা আশা করাই ভুল যে তারা সারজীবন এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে, ট্রিগার চাপবে না।
আমরা আমাদের এই সভ্যতা নিজেদের হাতেই গড়েছি, আমরাই এখানে ন্যায়-অন্যায়কে বাদ দিয়ে শক্তিকেই মূল হিসেবে গ্রহণ করেছি। তাই এরফল আমাদের ভোগ করতেই হবে। আমরা দুই দুটি বিশ্বযুদ্ধ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারি নি। যদি যুদ্ধগুলোর আগেও গণভোট নেয়া হতো তবে নিরানব্বই শতাংশ লোক যুদ্ধের বিরুদ্ধে ভোট দিতো কিন্তু ঐ যে কর্মফল, এড়ানোর কোন উপায় তাদের জানা ছিল না। তেমনি তখনকার তুলনায় এখন আমাদের অবস্থা আরো করুণ। দিন দিন অবস্থা আরো করুণ হচ্ছে। প্রযুক্তিগত প্রগতি যত বাড়ছে তত নৈতিকতার অবসান হচ্ছে। শত ইচ্ছা থাকলেও আমরা পূর্বেও কর্মফল কে এড়াতে পারি নি, এবারও পারবো না। কারণ কর্ম অনুযায়ী ফল পাওয়া প্রাকৃতিক বিষয়।
তাহলে এখন উপায় কী? নিজেদের কর্মফলপ্রসূত যে ধ্বংসযজ্ঞ এর থেকে বাঁচার কী কোন উপায় নেই? উপায় আছে। যে পথে চললে, যে জীবনব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠা করলে মানুষ জাতি অপ্রতিরোধ্য এই আত্মহত্যার দিকে এগিয়ে যাবে না, তার বুদ্ধি ও মনের, দেহের ও আত্মার, যান্ত্রিক প্রগতি ও নীতি নৈতিকতার একটি সুষ্ঠু ভারসাম্য তৈরি হবে তেমন একটি পথ এখন আমাদেরকে সন্ধান করতে হবে।