রিয়াদুল হাসান:
এটা দৃশ্যমান বাস্তবতা যে আমাদের আলেমরা ওয়াজ করছেন, ধর্ম উপদেশ দিচ্ছেন, মসজিদে ইমামতি করছেন, মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছেন, বিভিন্ন সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছেন, গণমাধ্যমে বহু ধর্মীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন। এসব থেকে মনে হচ্ছে যেন দীনের অগ্রগতি সাধনে আলেমদের অনেক অনেক অবদান, অনেক কিছু করছেন আলেমরা। কিন্তু বাস্তবে তাদের কাজের ফলে সমাজে কী ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সেটার একটি বিচার করা প্রয়োজন আছে। যে কোনো উদ্যোগেরই সাফল্য আর ব্যর্থতার হিসাব মিলাতে হয়।
আমাদের আলেম সাহেবগণ ওয়াজ করে ইসলামের পথে চলার উপদেশ মানুষকে দেন এবং এটাই তাদের মূল কাজ বলে বিবেচিত হয়। সামাজিক অপরাধ, নিরাপত্তাহীনতা, অবিচার, বৈষম্য, জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি আমাদের সমাজের বাস্তব সমস্যা। ইসলামে যে জিনিসগুলোকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয় যেমন সুদ, ঘুষ, রাহাজানি, দুর্নীতি, ডাকাতি, চুরি, ব্যভিচার, গুম-খুন, অন্যের হক নষ্ট করা ইত্যাদি তালিকা করলে অন্তত দশটা অপরাধকে নির্দিষ্ট করে তারা যদি সেগুলোর বিরুদ্ধে প্রথামাফিক ওয়াজ নসিহত করতে থাকেন তাহলে কি সমাজ থেকে ঐ অপরাধগুলো দূর হবে বা সামান্যও হ্রাস পাবে? পাবে না। তার প্রমাণ আজ থেকে দশ বছর আগের তুলনায় দেশে মাদ্রাসার পরিমাণ মসজিদের পরিমাণ অর্থাৎ আলেমের সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তাদের ওয়াজ নসিহতও বেড়েছে আর যে অপরাধগুলো বললাম সেগুলোর মাত্রাও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, তারা মানুষের মন থেকে অপরাধ প্রবণতা হ্রাস করতে, মানুষের আত্মাকে বিশুদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এর কারণ একজন অন্যায়কারী আরেক অন্যায়কারীকে অন্যায় করা থেকে নিবৃত্ত করতে পারে না। একজন পেশাদার রাজনীতিবিদ যখন তার বক্তৃতায় মানুষকে দেশমাতৃকার জন্য ত্যাগ স্বীকার করার আহ্বান করেন তাতে মানুষ কতটা অনুপ্রাণিত হয়? অনেকে বলেন, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আলেম সাহেবদের জুম্মার খোতবায় বয়ান করা উচিত, তাদের বিরাট দায় রয়েছে। কিন্তু ধর্মজীবী আলেমসমাজ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে চাইলে তা গ্রহণযোগ্যতা পায় না। কারণ জঙ্গিবাদীরা ঈমানী চেতনা দ্বারা আত্মোৎসর্গীকৃত (যদিও সেটা ভুল পথ) পক্ষান্তরে ধর্মজীবী দরবারী আলেমরা টাকার বিনিময়ে ওয়াজ করেন। তাদের ওয়াজের কোনো তাসির (প্রভাব) মানুষের উপর পড়ে না, জনতা কেবল ওয়াজ শোনার সওয়াবটারই প্রত্যাশী (যদিও এতে কোনো ফায়দা হয় না।) কোনো দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা যদি ঘুষের বিরুদ্ধে উপদেশ দেয় তার ফল যতটুকু হবে, লেবাসধারী ধর্মব্যবসায়ীরা বা ধর্ম থেকে পার্থিব স্বার্থ হাসিলকারীরা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বা কোনো সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে ওয়াজ করলে ততটাই ফলপ্রদ হবে। আল্লাহ যদি তাদের প্রশ্ন করেন, “তোমরা কি লোকদেরকে সৎ কাজে আদেশ করছ এবং তোমাদের নিজেদের সম্বন্ধে বিস্মৃত হচ্ছ? অথচ তোমরা গ্রন্থ পাঠ কর; তাহলে কি তোমরা হৃদয়ঙ্গম করছ না?” [আল কোর’আন: সুরা বাকারা ৪৪] তারা এর কী জবাব দেবেন? অথবা যদি বলেন, “তোমরা এমন কথা কেন বলো যা তোমারা নিজেরা করো না। তোমরা নিজেরা যা করো না তা অপরকে করতে বলা আল্লাহর ক্রোধ উদ্রেক করে।” [আল কোর’আন, সুরা সফ ২-৩]
সমাজে এত অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি কিন্তু সেগুলোর বিরুদ্ধে আমাদের আলেম সমাজ ঐক্যবদ্ধ হতে পারেন না। তাদের সংখ্যাটি বিরাট যা নিয়ে তাদের অহংকার আর হুঙ্কারের সীমা নেই। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ফতোয়া এক লক্ষ আলেম সই-স্বাক্ষর করেছেন। কিন্তু হতাশাজনক বিষয় হচ্ছে দেশে যে পঁচিশ হাজার কওমী মাদ্রাসা আছে [দৈনিক সমকাল, ১৭ এপ্রিল, ২০১৭], সেখানকার আলেমরা এতে স্বাক্ষর করেন নি। হেফাজতে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামের আলেমরা স্বাক্ষর করেন নি, সরকারের লেজুড়বৃত্তিকারী ইসলামিক দলগুলোও তাতে স্বাক্ষর করে নি এমন কি খোদ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক নিজেই তাতে স্বাক্ষর করেন নি। উল্টোদিকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন জঙ্গিবাদের উত্থান রোধকল্পে সরকারের নির্দেশে জুমার খোতবা তৈরি করে মসজিদগুলোতে পাঠিয়েছে। সেই খোতবা প্রত্যাখ্যান করেছেন কওমী মাদ্রাসার অধিকাংশ আলেম। তারা কেবল নিজেদেরকেই হক্কানি আলেম বলে মনে করেন, অন্যদেরকে গোনেন না। সরকার সব ইসলামী দলকে আহ্বান করেছে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কিন্তু ধর্মীয় দলগুলো সাড়া দিচ্ছেন না।
তাদের অনাগ্রহের কারণ তারা অনেকেই সরকারের বিরুদ্ধে এবং সরকার বেকায়দায় পড়লে তারা একপ্রকার সুখ অনুভব করেন। এই সঙ্কট যে সরকারের একার নয়, দেশ ধ্বংস হলে তাদের ধর্মব্যবসার আস্তানাগুলোও ধ্বংস হয়ে যাবে, ইরাক সিরিয়ায় ইমাম সাহেবরা এখন উদ্বাস্তু, তাদের টাকা দেওয়ার মুসল্লি নাই এই পরিণতিগুলো তারা ভাবছেন না। মোদ্দা কথা, তারা জঙ্গিবাদের মতো এমন ভয়াবহ বিভ্রান্তির বিরুদ্ধেও ঐক্যবদ্ধ হতে পারছেন না।
সুতরাং এটা সুনিশ্চিত যে আলেমগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে কোনো একটি জাতীয় সঙ্কটও মোকাবেলা করতে পারবেন না, জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারা তো বহু দূরের কথা। এটা তাদের একটা বড় ব্যর্থতা। তারা যেটা পারেন সেটা হচ্ছে, হঠাৎ একটি ইস্যু পেলে চিৎকার করে ফতোয়াবাজি করতে, মানুষকে উত্তেজিত করে দিতে, কারো উপর আক্রমণ করে তাকে হত্যা করার প্ররোচনা দিতে। এটা করার জন্য তারা অনেক মিথ্যা গুজব রটনা করতে পারেন, এটা তাদের একটি বড় যোগ্যতা। কোনো জায়গায় শান্তি স্থাপনে তারা ভূমিকা রাখতে না পারলেও অস্থিরতা সৃষ্টিতে অতিশয় দক্ষ। কিন্তু সেই উত্তেজনাও সাময়িক, দুই কি তিনদিন থাকে এই প্রভাব। এর মধ্যেই বহু নির্মম ঘটনার সাক্ষী হয় মানুষ, সমাজ আচ্ছন্ন হয় বিদ্বেষের বিষবাষ্পে। এটা করে তারা জনগণকে বুঝাতে চাচ্ছেন যে আমরা ধর্মের কর্তৃপক্ষ, আমাদের অবস্থানকে শক্ত করো, দৃঢ় করো, অর্থ দাও। জনগণও ভাবছে যে এরা না থাকলে ধর্মই থাকত না, মসজিদে নামাজ হতো না, আজান হতো না, জানাজা হতো না। তাই ধর্মের ‘রক্ষক’ হিসাবে তারা দাঁড়িয়ে আছেন।
পাকিস্তান আমলে একবার আহমদিয়া জামায়াতকে অনেক আলেম কাফের ফতোয়া দিয়ে দাঙ্গা সৃষ্টি করেছিল। বিষয়টি আদালতে গড়ালে বিচারপতি মুনির ও কায়ানীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ইসলাম, মুসলিম ও কাফেরের সংজ্ঞা বের করার জন্য। এই বিখ্যাত মুনির কমিশন পাকিস্তানের হাজার হাজার আলেমের কাছ থেকে ইসলাম, মুসলিম ও কাফেরের সংজ্ঞা জানতে চান এবং তাদের সাথে আলাপ আলোচনা করেন। তাদের বক্তব্য শোনার পরে মুনির কমিশনের সদস্যদ্বয় দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘এসব বিবরণের পর এ কথা বলা বাহুল্য যে কোনও দু’জন আলেমও এই মৌলিক বিষয়ে একমত নন। তবে তারা একটি বিষয়ে সম্ভবত একমত যে ইসলামের কোনো বিষয়েই তারা একমত হবেন না। আমরা যদি নিজেরা ইসলাম ও মুসলমানের সংজ্ঞা নির্ধারণ করি তাহলে এদের সবার মতে আমরা ইসলামের গণ্ডি বহির্ভূত হয়ে পড়ব। আর এদের একজনের সংজ্ঞা যদি আমরা গ্রহণ করি তাহলে সেই একজন আলেমের দৃষ্টিতে আমরা মুসলমান থাকব ঠিকই অন্য সকলের দৃষ্টিতে আমরা কাফের হয়ে যাব। [মুনির কমিশন রিপোর্ট পৃ:২১৫]
ইসলামিক বিশেষজ্ঞদের একটি সফলতা বলা যেতেই পারে। তাদের মধ্যে কিছু আছেন যারা ভিন্ন ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করে আরবী ফার্সি উর্দূ ভাষায় লেখা ইসলামের বিভিন্ন কেতাবের বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ইসলামের প্রকৃত আকিদা না থাকায় সেই বইগুলো থেকে জাতি উপকৃত হতে পারছে না। তাদের সেই কেতাবগুলো মূলত দীনের বিভিন্ন মাজহাবের মতাদর্শের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও ব্যক্তিগত জীবনের নানারূপ মাসলা মাসায়েলে পরিপূর্ণ। পাশাপাশি যে সংবিধানের অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি দুনিয়ার কোথাও প্রতিষ্ঠিতই নেই সেই সমস্ত বিষয় নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় ভরপুর।
ব্যর্থতা শুধু আলেমদের নয়, আমাদেরও আছে। আমাদের মতো সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী মানুষদের বড় ব্যর্থতা হলো আমরা সমাজের যাবতীয় অন্যায়কে পাশ কাটিয়ে, মুখ বুজে সহ্য করে কোনোমতে নিজে খেয়ে পরে বেঁচে থাকাকেই যথেষ্ট মনে করছি। এদিকে আমাদের দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে যাক ওটা রক্ষা করবে সরকার, আমাদের ধর্ম ধ্বংস হয়ে যাবে যাক – ওটা রক্ষা করবে আলেমরা, এমন বদ্ধমূল ধারণা নিয়ে বসে আছি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা ধর্ম সম্পর্কে জানব না, জান্নাতে যাওয়ার পথ আমাদেরকে আলেমরাই দেখাবেন। আমাদের এই স্থবিরতা, চিন্তার জড়ত্ব, আত্মকেন্দ্রিকতাই আমাদের সব সর্বনাশের কারণ। এখন অন্যের সমালোচনা বাদ দিয়ে আত্মসমালোচনা করতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে কোথায় আমরা পথ হারিয়েছি। তা না হলে সাম্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্র ও জঙ্গিবাদীদের কাজের ফলে যে ভয়াবহ তাণ্ডব ধেয়ে আসছে তাতে করে আমাদের ধর্মও ধ্বংস হবে, দেশও ধ্বংস হবে।