আতাহার হোসাইন:
কিছুদিন আগে বিশ্বের অন্যতম ধনী রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নতুন স্বাস্থ্যখাত নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। মূলত দেশটির নাগরিকদের চিকিৎসা সেবার দায়িত্ব অর্পিত আছে বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে। নিয়ম অনুযায়ী যারা স্বাস্থ্যবীমা করে রাখে তারা স্বাস্থ্যসেবা পায়, আর যারা তা করে না তারা বিনা চিকিৎসায় মারা যায় অথবা চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে ফতুর হয়ে যায়। এই অবস্থার অবসান ঘটাতে সেদেশের সরকার ব্রিটেনের ‘ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস’ (ঘঐঝ) এর ন্যায় সেবা প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু এই ব্যবস্থাটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সেদেশে ব্যাপক বাধার সৃষ্টি হয়। এতে আগে করা বীমা বাতিল করে নতুন করে বীমা করতে টাকা ব্যয় করতে হতে পারে এই ভয় থেকে সে দেশের চিকিৎসা সুবিধাপ্রাপ্তরা বিরোধিতা শুরু করে। তবে সবচেয়ে বাধার সৃষ্টি করে বীমা কোম্পানিগুলোর সিন্ডিকেট। এ সময় এ বিষয়ে সৃষ্ট মতভেদ এবং বিতর্কের কারণে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অসহযোগিতায় দেশে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়।
শুধু স্বাস্থ্যখাতই নয়, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্র তার নাগরিকদেরকে যে মৌলিক সেবাগুলো দিয়ে থাকে তার সবগুলো নিয়ে প্রায়ই তারা হিমশিম খায়। ব্যর্থ হয়ে বৈদেশিক ঋণের দারস্থ হয়। ফলে রাষ্ট্র বিভিন্নভাবে অন্য রাষ্ট্রের কাছে দায়গ্রস্ত হয়ে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব হারায়। রাষ্ট্র এবং নাগরিকের মধ্যে সম্পর্কটাই দাঁড়িয়েছে এমন যে, নাগরিক রাষ্ট্রের দিকে চেয়ে আছে রাষ্ট্র তার খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তা ইত্যাদি মৌলিক সেবাগুলো নিশ্চিৎ করবে আর তার বিনিময়ে নাগরিক রাষ্ট্রকে ভ্যাট-ট্যাক্স দিয়ে যাওয়ার মত দায়িত্বটুকু পালন করে যাবে। কিন্তু বাস্তবতার খাতিরে দেখা যায়, নাগরিকের সে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য কখনোই পূরণ হচ্ছে না। ফলে রাষ্ট্র এবং নাগরিকের সম্পর্ক অসন্তুষ্টিতে ভরপুর। নাগরিকগণ সব সময়ই মনে করে রাষ্ট্র তাকে ঠকাচ্ছে, রাষ্ট্র তাকে উপযুক্ত সেবা দিচ্ছে না। রাষ্ট্রের এ ব্যর্থতায় নাগরিকগণ রাষ্ট্রকে এভাবে শুধু দোষ দিয়েই যাচ্ছে; কিন্তু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে না। নাগরিকের মনোভাবটাই এমন যে, আমিতো তোমাকে ভ্যাট দিচ্ছি, ট্যাক্স দিচ্ছি, তাহলে তুমি আমাকে সেবা দিতে পারবে না কেন? আর রাষ্ট্র যুক্তি দেখাচ্ছে যে, সীমিত লোকবল ও অর্থের অপ্রতুলতার কারণে এর বেশি সেবা দেওয়া অসম্ভব। নাগরিককে আরো অর্থ দিতে হবে, ট্যাক্স বাড়াতে হবে, ভ্যাট বাড়াতে হবে। রাষ্ট্র বাধ্য হয়ে যখনই ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ায় তখন সাথে সাথে নাগরিকগণ রাষ্ট্রের উপর আরো বিক্ষুব্ধ হয়, প্রতিবাদ করে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সংঘাতে লিপ্ত হয়। ফলে না নাগরিক রাষ্ট্রের উপর সন্তুষ্ট আর না রাষ্ট্র নাগরিকের উপর সন্তুষ্ট। অর্থাৎ নাগরিক এবং রাষ্ট্রের সম্পর্কটা শুধুমাত্র ‘গিভ এন্ড টেক’ পর্যায়ে চলে গেছে। এটা এক অবর্ণনীয় দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক। তবে এখানে রাষ্ট্র বলতে আমি রাষ্ট্রীয় কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা, কর্মচারী- যেমন জনপ্রতিনিধি, আমলা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং অন্যান্য খাতের কর্মকর্তাদের কথা বোঝাচ্ছি। কারণ রাষ্ট্রের আলাদা কোন চেহারা নেই। রাষ্ট্রের পেছনে কিছু প্রতিষ্ঠান থাকে এবং প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে থাকে কিছু মানুষই।
প্রশ্ন হচ্ছে এমনটা হবে কেন? আমরা জানি, নাগরিকের প্রয়োজনেই রাষ্ট্রের জন্ম। সুতরাং সে প্রয়োজন পূরণ না হলে রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে কোন লাভ আছে কি? না, লাভ নেই। কিন্তু একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা ছাড়া পৃথিবীর যে কল্পিত রূপটি আমরা দেখতে পাই তা হচ্ছে নৈরাজ্যকর পৃথিবী, যেখানে শক্তির জোরে যার যা ইচ্ছা তা করার অধিকার পেয়ে যাবে, দুর্বলের উপর সবল অত্যাচার করবে, অনেকে না খেয়ে মারা যাবে। যা হবে মর্তের বুকে চূড়ান্ত জাহান্নামের একটি প্রতিচ্ছবি।
বিষয়টিকে আরেকটু পরিষ্কার করার জন্য দু’একটা উদাহরণ তুলে ধরছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষকে চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারীদের হাত থেকে রক্ষা করা। কিন্তু আমি যদি সেই দায়িত্বটুকু রাষ্ট্রের কাঁধে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিত হয়ে বসে থাকি, তবে তা কি আমার দিক থেকে যথাযথ কাজটি করা হলো? আমার চোখের সামনে কোন অসহায়কে খুন করা হলো, আমি কোন কিছুই করলাম না। কারণ আমি জানি, এর জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রয়েছে। যা করার তা তারাই করবে। এ ব্যাপারে আমার কোন দায়িত্ব নেই। লোকে লোকারণ্য স্থান থেকে ছিনতাইকারী কারো গলার হার ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে, আমি কিছুই করলাম না। এমনিভাবে যদি প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর দায়-দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে আমরা চুপ করে বসে থাকি তাহলে কি কোন দিন রাষ্ট্র শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে? না, পারবে না।
মূলত এই কাজগুলো করার দায়িত্ব ছিল নাগরিকেরই। কিন্তু বিচ্ছিন্ন নাগরিকগণের দ্বারা সেটা সম্ভব হয়ে উঠে না। তাই সমন্বিতভাবে কাজগুলো করার জন্য উদ্ভব ঘটেছে এই রাষ্ট্রব্যবস্থার। প্রতিটি ব্যাপারে অধিকতর যোগ্যতা সম্পন্ন (ঝঢ়বপরধষরুবফ) ও দক্ষ (ঝশরষষবফ) লোক রাষ্ট্রের কাছে থাকতে পারে, কিন্তু একজন সুনাগরিক হিসেবে আমিও রাষ্ট্রের সকল কাজের ব্যাপারে দায়িত্বশীল, অন্তত আমি যদি আমার নিজেরই কল্যাণ কামনা করি। তাই একথা বলাই যায় যে, মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের প্রধান কাজ নয়- এটা আমারই প্রয়োজন, সুতরাং আমারই কাজ। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র আমার সহযোগী। আমিই এখানে প্রথম পুুরুষ এবং রাষ্ট্রের অবস্থান দ্বিতীয় পুরুষের স্থানে।
তাহলে একটি শান্তিপূর্ণ এবং কল্যাণ রাষ্ট্রের চরিত্র কী হবে? শান্তিপূর্ণ এবং কল্যাণ রাষ্ট্রের চরিত্র হবে সেই রাষ্ট্রের প্রত্যেকে, অন্ততপক্ষে বেশিরভাগ নাগরিক হবে প্রতিটি ব্যাপারে দায়িত্ববান। আর এটা যখন করা হবে তখন রাষ্ট্রের অনেক দায়িত্বই কমে আসবে। তখন রাষ্ট্রকে আলাদাভাবে নাগরিকদের খাওয়া-পরা, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদির জন্য এত হাস-ফাঁস করতে হবে না। নাগরিকগণও রাষ্ট্রের উপর পুরোপুরি সন্তুষ্ট থাকবে। দূর হবে রাষ্ট্র এবং নাগরিকের মধ্যে বিরাজমান দ্বন্দ্ব ও সংঘাতমুখী সম্পর্ক।
রাষ্ট্র এবং নাগরিকের মধ্যে এই সম্পর্ক সৃষ্টি হলে দেশে এত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দরকার হবে না (এমনকি কোন বাহিনীরই দরকার হবে না), এত হাসপাতালেরও দরকার হবে না। এতিমদের জন্য এতিমখানা, মানসিকভাবে অসুস্থ (পাগল)দের জন্য আলাদা হাসপাতাল, ক্লিনিক দরকার হবে না, বৃদ্ধদের জন্য দরকার হবে না বৃদ্ধাশ্রমের, দুঃস্থ ও বয়স্কদের জন্য সরকারকে আলাদা বাজেট গঠন করতে হবে না, বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়ন-রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হোটেল (সরাইখানা) ইত্যাদি নির্মাণ নিয়ে রাষ্ট্রকে অত মাথা ঘামাতে হবে না।
অনেকের কাছে বিষয়টি অভাবনীয় মনে হতে পারে। মনে হতে পারে আকাশ কুসুম-কল্পনাও। কিন্তু বিষয়টি আকাশ কুসুম কল্পনা বলে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকতো, যদি এর আগের এরূপ কোন নজির আমাদের সামনে না হাজির থাকতো। নজির খুঁজতে আমরা একটু পেছনের দিকে গেলেই হবে। বেশিদূর নয়, গত শতাব্দীতেও পৃথিবীর অধিকাংশ শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, পুকুর, পয়নিষ্কাশনব্যবস্থা, সরাইখানা ইত্যাদি নির্মিত হতো ব্যক্তি উদ্যোগে কিংবা সাধারণ মানুষের উদ্যোগে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাই। ধরুন, আজকের যুগে আপনি ইবনে বতুতার ন্যায় পরিব্রাজক হবেন। চিন্তা করে দেখুনতো আপনার কত টাকার প্রয়োজন হতে পারে? আপনি যদি পৃথিবীর অন্যতম ধনী ব্যক্তিও হোন, তবুও জীবন সায়াহ্নে দেখবেন আপনি ফতুর হয়ে গেছেন। আর যদি মধ্যম সারির সাধারণ কোন ভ্রমণকারী হোন তাহলে পকেটের টাকা খুইয়ে আপনি রাস্তায় মরেও থাকতে পারেন। কিন্তু ইবনে বতুতার ভ্রমণকাহিনী পড়ে দেখুন। কপর্দকহীন অবস্থায় বেরিয়ে তিনি পৃথিবীর বিরাট অংশ ভ্রমণ করেছেন। তিনি যেখানেই গিয়েছেন সেখানকার ধনী ব্যক্তি কিংবা রাজা-বাদশাহদের উষ্ণ আতিথ্য পেয়েছেন। সেখানে থাকা-খাওয়ার নিশ্চয়তা পেয়েছেন। সেই সাথে রাশি রাশি উপহার, ঘোড়া, স্বর্ণমুদ্রা ইত্যাদিও পেয়েছেন। তিনি যখন ঘরে ফিরেছেন তখন একজন বৃহৎ ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। এটা শুধু বতুতার ক্ষেত্রেই হয়েছে তা নয়, ঐ সময় যারাই সাধু-সন্ন্যাসী হয়ে পথে নেমেছেন তাদের সবারই একই অবস্থা হয়েছে। অন্তত চাল-চুলো নেই বলে না খেয়ে মরতে হয় নি। এমনটি কেন হয়েছিল? কারণ তখন মানুষ রাষ্ট্রের উপর এতটা নির্ভরশীল ছিল না। একই সাথে পারিবারিক, সামাজিক ও আত্মীয়তার বন্ধনগুলো ছিলো অত্যন্ত দৃঢ়। একে অন্যকে সহযোগিতার জন্য নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতো। কোন মুসাফিরকে খাদ্য, তার জন্য উপযুক্ত বিশ্রামের ব্যবস্থা করা ও রসদ যোগানোকে সম্মানের, আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হতো। প্রতিটি অবস্থা-সম্পন্ন বাড়িতেই অতিথিশালা, বাংলো বাড়ি ইত্যাদি থাকতো।
আজকে আমাদের সমাজে দারিদ্রতা একটি প্রকট সমস্যা। গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে ভিখারীর অভাব নেই। হাত পাততে মানুষ লজ্জাবোধ করে না। অথচ আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হওয়ারও অনেক আগে শেষ রসুল আনীত ইসলাম প্রতিষ্ঠার পরে অর্থনৈতিকভাবে তৎকালীন আরব এতটাই স্বাবলম্বী হয়েছিলো যে ভিক্ষা করাতো দূরের কথা, দানের অর্থ গ্রহণ করার মত লোকও খুঁজে পাওয়া যেত না। আর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আলাদা কোন বাহিনীর প্রয়োজন হতো না। মানুষ তার সম্পদ রাস্তায় ফেলে গেলে, কিংবা হারিয়ে ফেললে পরে এসে যথা স্থানে খুঁজে পেত। প্রত্যেক নাগরিকই একই সাথে একজন সেনা সদস্যও ছিলেন। তারা পালাক্রমে সীমান্ত পাহারা দিতেন-নিজস্ব উপার্জন থেকে ব্যয় করে।
আজ পাশ্চাত্য সভ্যতার জড়বাদী, বস্তুবাদী সভ্যতার প্রভাবে আমাদের মধ্য থেকে সেই সহজাত চিরায়ত গুণগুলো তিরোহিত হয়ে গেছে। এতদসত্বেও হিসেব করলে দেখা যাবে এখনও ব্যক্তি ও সামাজিক উদ্যোগে যে কাজগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে তার সমান কাজ চালিয়ে যাওয়া রাষ্ট্রের পক্ষে অল্প কয়েকদিনও চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে যে, সে সময়তো মানুষ সংখ্যায় কম ছিলো, সুতরাং সমস্যাও কম ছিলো। এর উত্তরে বলা যায়, সংখ্যাটা কোন বিষয় নয়। আজকে সংখ্যা বেড়েছে, সে তুলনায় সম্পদের পরিমাণও বেড়েছে। নিত্য নতুন প্রযুুক্তি যুক্ত হয়ে মানুষের কাজকে সহজ করে দিয়েছে, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিতে পৃথিবীকে এনে দিয়েছে হাতের মুঠোয়। আগের যে কোন সময়ের চেয়ে জমিতে বেশি পরিমাণে ফসল উৎপাদন হয়। সুতরাং নাগরিকগণ যদি রাষ্ট্রের উপর দায় চাপিয়ে নিজে বসে না থাকে এবং রাষ্ট্রের উপর অর্পিত দায়িত্বটুকু নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়, তাহলে অনেক সমস্যা এমনিতেই কমে যাবে। এবং একই সাথে আজকে ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো তোমাদেরকে এই দেব, সেই দেব বলে যে প্রতিশ্র“তি দিয়ে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় তারও কোন প্রয়োজনীয়তা থাকবে না।