সিলেট জেলা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ-এর একাত্মতা প্রকাশ
সর্ব ডান থেকে, সিলেট প্রেসবিটারিয়ান চার্চ এর সহকারী পুরোহিত ডিকন নিঝুম সাংমা, ক্যাথলিক ধর্ম যাজক, খাদিম মিশন, বিশপ হাউস সিলেট এর ফাদার হেনরী রিবেরু , দৈনিক দেশেরপত্রের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক রুফায়দাহ পন্নী, সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ.এফ.রুহুল আনাম চৌধুরী (মিন্টু) সিলেটের জেলা প্রশাসক মো: শহিদুল ইসলাম, দৈনিক দেশেরপত্রের বিশেষ প্রতিনিধি আজমল হোসাইন, সিলেট বৌদ্ধবিহার অধ্যক্ষ শ্রীমৎ সংঘানন্দ থের এবং সিলেট মহানগর সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুস সহিদ খান
সিলেট প্রতিনিধি:
সিলেট জেলা পরিষদ মিলনায়তনে দৈনিক দেশেরপত্র এবং দৈনিক বজ্রশক্তির সৌজন্যে স্থানীয় সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ধর্মগুরু এবং সুধীসমাজকে নিয়ে একটি বিশেষ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অনুষ্ঠানের প্রতিপাদ্য ছিল সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যামানার এমামের প্রদত্ত প্রস্তাবনা। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন সিলেটের জেলা প্রশাসক মো: শহিদুল ইসলাম।
অনুষ্ঠানের প্রারম্ভেই মানবজাতিকে ন্যায়ের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে দেশেরপত্রের দেশজুড়ে চলমান কার্যক্রম সম্পর্কে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এরপর “সনাতন ধর্ম” শিরোনামে অপর একটি প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে সেমিনারের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করা হয়। পরবর্তীতে দেশেরপত্রের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক রুফায়দাহ পন্নী এবং পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট মো: রিয়াদুল হাসান তাদের স্ব স্ব বক্তব্যে সকল ধর্মের অনুসারীদেরকে ধর্মের মূল শিক্ষা, সনাতন শিক্ষার উপরে একতাবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান এবং মাননীয় এমামুয্যামানের শিক্ষা তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সিলেট প্রেসবিটারিয়ান চার্চের সহকারী পুরোহিত মি. ডিকন নিঝুম সাংমা। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, “মানবতার কল্যাণ সকল ধর্মেরই শিক্ষা, কিন্তু ঈশ্বর বিদ্বেষী এক শ্রেণির লোক এই শিক্ষা থেকে সরে গেছে। বাইবেল বলছে, আমরা সবাই একই বাবা-মা আদম হাওয়ার সন্তান। কিন্তু বাস্তবে আমরা একে অপরের শত্র“ হয়ে আছি, একে অপরকে হত্যা করে চলেছি।’ তিনি বাইবেলের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘ঈশ্বর বলেছেন তোমার সকল চিত্ত দিয়ে ঈশ্বরের প্রেম করো, অতঃপর সকল চিত্ত দিয়ে প্রতিবেশীর প্রতি প্রেম করো।’ এই ভালোবাসা প্রেম মানবতাই হল সনাতন। ঈশ্বর বলেছেন যে তিনি আদি তিনিই অন্ত। তাই তাঁর ধর্মও এক, যার কোন পরিবর্তন নেই। আজ আমরা ব্যক্তিস্বার্থের জন্য অপরের চরিত্র হনন করছি, জঘন্য সব কর্ম করে যাচ্ছি। আমরা ধর্মের মূল সূত্র (ঈশ্বরের আনুগত্য) থেকে সরে গেছি।’ তিনি দৃপ্তকণ্ঠে যামানার এমাম জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর অনুসারীদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেন এবং একসঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
বিশেষ অতিথি সিলেট বৌদ্ধবিহারের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ সংঘানন্দ থের দৈনিক দেশেরপত্র কর্তৃক উত্থাপিত মানবজাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, ‘এই উদ্যোগ অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং মূল্যবান।’ সকল ধর্মের অনুসারীদেরকে এক জায়গায় একত্রিত করার জন্য তিনি আয়োজকদের প্রতি অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, আমাদের চারপাশে আমরা দেখছি বিশাল বিশাল প্রাচীর। এসব কিসের প্রাচীর? এগুলো হল বিরোধের প্রাচীর আর বিদ্বেষের প্রাচীর। কারা এই প্রাচীরগুলি নির্মাণ করেছেন? এই আমরাই যারা বিভিন্ন ধর্মের ধ্বজা ধারণ কোরে আছি এবং পৌরহিত্য করছি তারাই নিজেদের স্বার্থে এই প্রাচীরগুলি নির্মাণ করেছি এবং সকল ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করে রেখেছি। এর ফলে ধর্মের নাম নিয়ে বহু সহিংস ঘটনা ঘটছে এবং মানবতা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে।’ তিনি এসব সহিংস কর্মকাণ্ডের জন্য প্রধানত তিনটি কারণকে দায়ী করেন- রাজনৈতিক কারণ, আর্থিক কারণ এবং অজ্ঞানতা। এসব দাঙ্গা হাঙ্গামার প্রথম কারণ হল রাজনৈতিক। এই নোংরামী শুরু করেছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা। আজও যারা রাজনীতি করছেন তাদের অনেকেই সেই ব্রিটিশের প্রেতাত্মা। তারাই এই দাঙ্গা বাধিয়ে রেখেছেন। আর আর্থিক লাভের জন্য ধর্মকে সাইনবোর্ড হিসাবে ব্যবহার করছে ধর্মব্যবসায়ী পুরোহিত শ্রেণি। তৃতীয়ত, অজ্ঞানতা। একজন সাধারণ বৌদ্ধ জানে না যে ইসলাম কি, একজন মুসলিম জানে না যে শ্রীকৃষ্ণ কে, একজন খ্রিস্টান জানে না যে সনাতন ধর্মের শিক্ষা কি। এই না জানার সুযোগেই ধর্মব্যবসায়ীরা ধর্মের অপব্যাখ্যা করে সাধারণ মানুষকে ব্যবহার করে অন্য ধর্মের উপরে হামলা চালাচ্ছে আর ঘৃণা ছড়াচ্ছে। এরাই হচ্ছে ধর্মের দালাল। এদের বিরুদ্ধে আমাদের সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। বিশ্বশান্তির দিকনির্দেশ করতে গিয়ে তিনি তার গুরুর ভাষ্যের উদ্ধৃত্তি দিয়ে বলেন, ‘আমাদের সব ধর্মের প্রধান ব্যক্তিরা যদি এক টেবিলে বসে আলোচনা করতে পারেন, একত্রে খেতে পারেন, মানবজাতির কল্যাণের জন্য একত্রে ধ্যান করতে পারে তাহলেই বিশ্বের আশিভাগ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এসলাম শব্দের অর্থই শান্তি, অথচ প্রায়ই এসলামের সঙ্গে টেররিজম শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়।’ তিনি গৌতম বুদ্ধের উক্তি উল্লেখ করেন যে, ‘মা যেমনভাবে তার সন্তানের প্রতি প্রীতি লালন করেন, তেমনি দৃশ্যমান ও অদৃশ্য সর্বজীবে প্রীতি লালন করবে। যে ধর্মের প্রবেশদ্বারই হচ্ছে অহিংসা তারা কিভাবে মায়ানমারে মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করছে, তাও ধর্মের নামে। যারা এমন করছে তারা নিশ্চয়ই বুদ্ধের অনুসারী নয়।’ তিনি প্রত্যেককে স্ব স্ব ধর্মের কুলাঙ্গারদের চিহ্নিত করে তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করার আহ্বান জানান। মঞ্চে উপবিষ্ট জেলা প্রশাসককে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘সকল ধর্মের মূল শিক্ষাগুলি নিয়ে জেনারেল রিলিজিয়াস স্টাডি নামক একটি বিষয় সকল ধর্মের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা গেলে অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কে আমাদের যে অজ্ঞতা তা দূর হবে, এবং তখন আর তাদেরকে ধর্মব্যবসায়ী বা রাজনৈতিক ধান্ধাবাজরা সত্য থেকে টলাতে পারবে না।’
অতিথি বিশপ হাউজ, সিলেটের খাদিম মিশনের ক্যাথেলিক ধর্মযাযক অনুষ্ঠানের বিশেষ ফাদার হেনরি রিবেরু একজাতি একদেশ ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ শ্লোগানের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে বলেন, ‘অনেক দেরিতে হলেও একটা মোক্ষম সময়ে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। এটা যদি আরও অনেক আগে হত আমরা আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারতাম। ঈশ্বর বলেছেন আমি সেই তিনি, যিনি এক এবং অদ্বিতীয়। বাইবেলে বর্ণিত আদমের দুই সন্তানের মধ্যে একভাই ঈশ্বরভক্ত ছিলেন, তাকে আরেক ভাই হিংসা করে হত্যা করে ফেলেন। সেই থেকে মানবজাতির মধ্যে সংঘাত শুরু। কিন্তু আজ এই সংঘাত প্রকট ও অসহনীয় রূপ ধারণ করেছে। এ থেকে বাঁচার জন্য আমাদেরকে এখন ঐক্যবদ্ধভাবে চিন্তা করতে হবে। দেশেরপত্রের এই উদ্যোগে, তাদের একজাতি হওয়ার আহ্বান সম্বলিত লিফলেটখানা পড়ে আমি প্রচণ্ডভাবে উজ্জীবিত হয়েছি।’ তিনি ৪৭ ও একাত্তর সনের স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমরা পরাধীনতার মধ্যেও স্বাধীনতার স্বাদ খোঁজার চেষ্টা করেছি।’ মাননীয় এমামুয্যামানের একজাতি হওয়ার আহ্বানকে তিনি অন্যায় থেকে মুক্তির ডাক হিসাবে মূল্যায়ন করেন।’ তিনি ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক রুফায়দাহ পন্নীর বক্তব্যের রেশ ধরে বলেন, তাঁর বাবা যে দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন আমরা যদি তা ধারণ করতে পারি তাহলে আমরা সমগ্র মানবজাতি এক কাতারে আসতে পারি। তিনি স্থানীয় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে বলেন, ‘আমাদেরকে যখনই ডাকবেন আমরা তখনই সাড়া দেব এবং মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে একাত্ম হয়ে কাজ করব।’
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি রুহুল আলম চৌধুরী (মিন্টু) সকল মানুষকে যার যার ধর্ম তার তার বিশ্বাসের মাঝে সীমাবদ্ধ রেখে মানবতার কল্যাণে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমরা পরিবারে দশজন সদস্য দশরকম পেশাজীবন নিয়ে আছি। কিন্তু যদি আমরা নিজেদের বসবাসের জন্য একটি বাড়ি তৈরি করতে চাই তখন কিন্তু আমরা সবাই সেই বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে, সবাই যার যার সামর্থ্যমত অর্থ দিয়ে শ্রম দিয়ে সেই বাড়িটা গড়ে তুলি। কারণ এই বাড়ি আমাদের সবার, এটা সুন্দর করে গড়ে তুললে গ্রামে আমাদের সম্মানই বৃদ্ধি পাবে। একইভাবে আমাদের এই দেশ মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবার, তাই এদেশকে সুন্দর করে বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য আমাদের সবারই সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে. ক্ষমতায় যেই দলই আসুক না কেন, দেশটা কিন্তু আমাদের সবার। এই দেশ না থাকলে, সমাজ না থাকলে আমাদের কারও অস্তিত্বই থাকবে না। আমি আশা করব গ্রাম, থানা, জেলা এভাবে পর্যায়ক্রমে সিলেটকে যদি সুন্দর করতে পারি, অন্যরা যার যার জেলাকে সুন্দর করে তোলেন তবেই দেশ এগিয়ে যাবে। সরকার দেশেরপত্রের কাজে সহযোগিতা করছে, আমাদেরও উচিৎ সরকারের ভালো কাজের সহযোগিতা করা। দেশেরপত্র এখানে ভালো একটি কাজের জন্য এসেছে, মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে এসেছে, এর চেয়ে ভালো কাজ আর হতে পারে না। কিন্তু আমরা সিলেটের মানুষ যদি তাদের সহায়তা না করি তাহলে তারা এটা করতে পারবেন না। তাই আমাদেরকে তাদের পাশে থাকতে হবে।’
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সিলেটের জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ধর্ম এসেছে মানুষের জন্য, সকল ধর্মেই মানুষের কল্যাণের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ধর্মগুলি ব্যবহার করেই আমাদের সমাজে মানুষের জন্য অকল্যাণকর ও দুর্ভাগ্যজনক বহু ঘটানা ঘটানো হয়েছে এবং হচ্ছে। তিনি বলেন, বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সময় হল মুক্তিযুদ্ধ। তখন আমাদের ঘরে কয়েকটি হিন্দু পরিবার নয় মাস বাস করেছিল। তারা আমাদের রান্না খেতেন, আবার নিজেরাও রান্না করে খেতেন। অর্থাৎ একাত্তর এই জাতিটিকে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। কিন্তু সেই ঐক্য আমরা ধরে রাখতে পারি নি। যদি ধরে রাখতে পারতাম তাহলে এত হানাহানি থাকতো না। হানাদারেরা যখন আমাদের দেশে আক্রমণ করে তারা কিন্তু হিন্দু-মুসলিম বা কোন বিশেষ জাতি গোষ্ঠীর উপরে হামলা করে নি। সবাই তাদের দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। তখনও তাদেরকে সহায়তা করেছে এক শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী। এভাবে এখনও ধর্মব্যবসা আছে। যেখানে যে জাতির লোক বেশি সেখানে সেই জাতির মধ্যে ধর্ম নিয়ে ব্যবসাও বেশি। এই ধর্মব্যবসায়ীদের প্রতিরোধ করতে হবে। আমি জেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত বলে দিয়েছি যেন সকলে দেশেরপত্রের সঙ্গে একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করে, কারণ তারা মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করছে।’ তিন ঘণ্টা ধরে অনুষ্ঠিত এ সেমিনারে আগত অতিথিরা অখণ্ড মনোযোগের সঙ্গে সবার বক্তব্য শোনেন। পরিশেষে মানবজাতিকে ন্যায়ের পক্ষে একতাবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করেন অনুষ্ঠানের সভাপতি দেশেরপত্রের বিশেষ প্রতিনিধি আজমল হোসাইন।