মো. মশিউর রহমান
একটি জাতির ক্ষুদ্রতম অংশ হচ্ছে ব্যক্তি মানুষ। ভিন্ন ভিন্ন মানুষের চিন্তাধারা, রুচি, অভিরুচির মধ্যে স্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট। এই স্বতন্ত্র সত্তার অধিকারী বহুসংখ্যক মানুষকে নিয়ে একটি সমাজ গঠিত হয়। এই সমাজের সংগঠিত, সমন্বিত এবং বিস্তৃত রূপই হলো জাতি। একটি জাতি তৈরির পিছনে বেশ কিছু শর্ত বিদ্যমান থাকে। জাতি মূলত ব্যক্তিরই বৃহত্তর সংস্করণ। অতএব জাতির অস্তিত্বের উপর সমাজের ও ব্যক্তির অস্তিত্ব নির্ভর করে। জাতি হচ্ছে একটি বিল্ডিং-এর মতো এবং ব্যক্তি সেই বিল্ডিং-এর এক একটি কামরা। বিল্ডিংটাই যদি ধ্বংস হয়ে যায় তবে তার কামরার কোন অস্তিত্ব থাকে না।
মানবজাতি তার ক্রমবিকাশের বিভিন্ন স্তরকে অতিক্রম করে আজকের এই জায়গায় এসে উপনীত হয়েছে। কালের পরিক্রমায় শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ইত্যাদির চর্চা মানবজাতিকে বর্তমানের অবস্থানে নিয়ে এসেছে। কালের ধারায় বিভিন্ন যুদ্ধ, সংঘর্ষ ইত্যাদির ফলে বিভিন্ন জাতিসত্তা গড়ে উঠেছে। ভাষা, বর্ণ, ধর্ম ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় দুইশতের মতো ভৌগলিক রাষ্ট্র এবং জাতিসত্তা গড়ে উঠেছে।
জাতিসত্তা গড়ে উঠলেও সেই জাতিগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ বিদ্যমান। অনেকগুলো জতিসত্তা আজ হুমকির মুখে। ধর্মকে ভিত্তি করে গড়ে উঠা জাতিসত্তার অনেকগুলো আজ বিলীন হয়ে গেছে। বৃহত্তর শক্তির ক্রমাগত চাপে ক্ষুদ্রতর জাতিগুলো তাদের বিশ্বাস, চেতনা, ঐতিহ্য হারিয়ে বিলীন হয়ে গেছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে বহু বৃহৎ রাষ্ট্র ভেঙে ক্ষদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। পুরাতন পরাশক্তি নতুন পরাশক্তির পদানত হয়েছে, অনেক ভূখণ্ড স্বাধীন হয়েছে। অনেক রাজা রাজ্য হারিয়েছে, অনেক সরকার গদিচ্যুত হয়েছে। জনগণ হারিয়েছে তাদের পরিবার ও সংসার। বিশ্বযুদ্ধের দ্বারা মানুষের সুখ শান্তি সব বিলীন হয়ে গিয়েছে।
আমরা বাংলার মানুষ, তাই আমরা বাঙালি। আমাদের জাতিসত্তাও আজ হুমকির মুখে। আমাদের থেকে শিক্ষা, সামরিক, অর্থনীতি, শিক্ষা ইত্যাদি দিক দিয়ে পরাশক্তিধর সাম্রাজ্যবাদী জাতিগুলো অধিক এগিয়ে রয়েছে। শক্তিমান দুর্বলের উপর প্রভাব বিস্তারের প্রয়াস করবেই- যার সাক্ষী ইতিহাস। আমরা আজ এই সঙ্কটের মধ্যে অবস্থান করছি। আমরা অখণ্ড জাতিসত্তা গঠনের লক্ষ্যে আজ পর্যন্ত অগ্রসরই হই নি। বরং যত উপায়ে বিভাজন সৃষ্টি করে গেছি। আজ পর্যন্ত আমরা সেই ঔপনিবেশিক যুগের দাসত্বের জীবনব্যবস্থাকেই অনুসরণ করে যাচ্ছি। নিজেদের দেশের, জাতির মনমানসিকতা, ধর্ম, নীতিনৈতিকতার মূল্যবোধের সঙ্গে যায় এমন কোনো জীবনব্যবস্থা আমরা আজও গ্রহণ করতে পারি নি। পাশ্চাত্যের অনুসৃত ও তাদের রেখে যাওয়া জীবনব্যবস্থাকেই এদেশের মানুষের জীবনের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। মেয়েদের পোশাক যেমন পুরুষের শরীরে বেমানান হয়, তেমনি পাশ্চাত্যের দর্শন ও জীবনব্যবস্থা প্রাচ্যের মানুষের গায়ে বেমানান। এই সরল বিষয়টি বোঝার জন্য আমরা ৪৬ বছর সময় পেয়েছি, তবু তা আমাদের নীতিনির্ধারকদের বোধগম্য হচ্ছে না।
আমরা এমন কোনো জীবনব্যবস্থা প্রণয়ন করতে পারি নি যা আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, ধর্মীয় এবং বৈষয়িক সমস্যার সমাধান করতে পারে। আমরা দুইশ বছর ঔপনিবেশিক শক্তির অধীনে ছিলাম। সেই সময় আমরা বঞ্চিত হয়েছি সকল দিক থেকে। প্রথম একশ বছর তো তাদের বিরুদ্ধে বহু বিদ্রোহ হলো। সিপাহী বিদ্রোহের পর তাদের শাসনের আসন পাকাপোক্ত হলো। পরবর্তীতে তারা যখন শিক্ষা, সাহিত্যের মাধ্যমে তাদের প্রচার প্রসার শুরু করলো তখন আমাদের ধর্মগুরুরা ইংরেজি ভাষাকে হারাম বলে ফতোয়া দিলেন। আমরা তখনই যোগাযোগের দিক থেকে পিছিয়ে গেলাম। একই সাথে আমরা জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত দিক দিয়েও পিছিয়ে গেলাম। আর সামরিক শক্তির কথা বলতে গেলে, সেই শক্তি হারানোর ফলেই তো তাদেরকে গোলাম হতে হলো। ক্রমান্বয়ে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উন্নতির আশায় একদল মানুষ মুসলিমদের মধ্যে জাগরণ, রেনেসাঁর সৃষ্টি করার জন্য জাতির মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের প্রচেষ্টা করলেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নবাব আবদুল লতিফ, নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, আমির আলি, ওয়াজেদ আলী খান পন্নী, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন প্রমুখ। এরা জাতিকে শিক্ষিত করার ব্রত নিয়ে নামলেন। কিন্তু ততদিনে মুসলিমরা একশ বছর পিছিয়ে গেছে। তাদের থেকে আমরা নামে মাত্র স্বাধীনতা লাভ করলাম। নামে মাত্র বলার কারণ ভৌগোলিক স্বাধীনতা পেয়েও আমরা তাদেরই রেখে যাওয়া রাজনৈতিক ব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা, শিক্ষব্যবস্থা ইত্যাদিকে আমাদের জীবনে প্রয়োগ করলাম। যার পরিণতিতেই আমাদের বর্তমান করুণ দুর্দশা। কেবল হানাহানী, অসন্তষ্টি, রাজনৈতিক বিদ্বেষ, অনৈক্যই আমাদের জাতীয় পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমানের বিশ্বপরিস্থিতির কথা চিন্তা করে জাতিকে এখন শক্তিশালী একটি ভিত্তির উপর দাঁড় করানো অত্যন্ত জরুরি। একদিকে আঞ্চলিক শক্তিগুলি প্রাধান্য বিস্তারে মত্ত অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিগুলো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরিতে প্রচেষ্টা করছে। সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিগুলোর অর্থনৈতিক কাঠামো নির্ভর করে অস্ত্র ব্যবসার উপর। তারা তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে বিশ্বজুড়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ, যুদ্ধ-বিগ্রহ লাগিয়ে রাখতে চায়। ধ্বংস করার পর পুনর্গঠনের নামে তারা ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান ইত্যাদি বহু রাষ্ট্রে নির্মাণ কাজ করছে। বহুবিধ পথে ধ্বংস হওয়া জাতিটিকেও তারা শোষণ করে যাচ্ছে। বিশেষ করে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে জঙ্গিবাদ ইস্যুর মাধ্যমে সঙ্কটে ফেলার প্রচেষ্টায় রয়েছে। বর্তমানের রোহিঙ্গা ইস্যুও বড় ধরনের সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। আমরা লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে এই দেশকে অর্জন করেছি। বর্তমানে এই জাতিকে শাক্তিশালী করে গড়ে তোলা এবং বিশ্বের দরবারে মর্যদাশীল আসনে অধিষ্ঠিত করা প্রয়োজন। কি করে সম্ভব?
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পারি, আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে আরবের জাতির পরিস্থিতি কেমন ছিল। কোনো একক সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা, সরকার ব্যবস্থা ছিল না। নিজস্ব কোন সংবিধান এবং সরকার প্রধান বা রাষ্ট্র প্রধান ছিল না। পুরো জাতির নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল না। জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতি ও প্রগতি সম্পর্কে তারা অজ্ঞ ছিল। এই অন্ধত্ব, কূপমণ্ডূকতা, অযৌক্তিক কর্মকাণ্ড, পশ্চাৎপদতার ফলে ইতিহাসে সেই সময়কে আইয়্যামে জাহেলিয়াত বা অন্ধকারের যুগ বলা হয়।
তখন একদিকে রোমান ও পারস্য পরাশক্তির আসনে অসীন। তারা ছিল জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে, সাহিত্যে ইত্যাদি সকল দিক দিয়ে অগ্রগামী। তারা আরবদের ঘৃণা ও অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখত। আরবে না ছিল কোন উর্বর কৃষি জমি, না ছিল কোনো খনিজ সম্পদ যার ফলে পরাশক্তিগুলো আরব দখলের কোন ইচ্ছাই প্রকাশ করতো না। আরবের লোকেরা অভ্যন্তরীণভাবে বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত ছিল। এক গোত্র আরেক গোত্রের সাথে মারামারি, দাঙ্গা হাঙ্গামায় লিপ্ত থাকত। সমাজে কোন শান্তি ছিল না। জীবন্ত মেয়ে মানুষকে কবর দেয়া ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। আরবদের চিন্তা চেতনা এতটাই স্থবির হয়ে পড়েছিল যে তারা মূর্তির সামনে বসে থাকত, তারা মনে করতো কাঠ পাথরের এই মূর্তিগুলো তাদের যুদ্ধে ও সংগ্রামের বিজয় দান করবে, তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করবে। তাদের সাহিত্যের মূল উপজীব্য ছিল অশ্লীলতা। এমনকি তারা হজের অনুষ্ঠানও পালন করতো উলঙ্গ হয়ে। এমন একটি জাতি কখনই শ্রেষ্ঠ হওয়ার আশা করতে পারে না যখন তাদের নিজেদের অস্তিত্বই সঙ্কটাপন্ন। পশুর মতো শুধু বেঁচে থাকার জন্য তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মারামারি ও কামড়াকামড়ি করত।
এমন সময়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে এক মহান আদর্শ নিয়ে আবির্ভূত হলেন শেষ নবী মোহাম্মদ (স.)। তিনি আরবের এই পরিস্থিতি দেখে ব্যথিত হলেন। তিনি সেই পশ্চাৎপদ সমাজকে রক্ষার জন্য পথের অনুসন্ধান করতে লাগলেন। আল্লাহ তাঁকে হেদায়াহ, পথ প্রদর্শন করলেন। তিনি বুঝতে পারলেন সমাজের সকল মানুষকে একটি কথার উপর ঐক্যবদ্ধ করতে পারলে সমাজকে পুনরায় নতুন কাঠামোয় গড়ে তোলা সম্ভব। তিনি মানুষগুলিকে এক আল্লাহ ছাড়া আর কারও হুকুম মানি না এই কথার উপর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান করলেন। সকলকে যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে বললেন। যদি তারা ঐক্যবদ্ধ হয় তবে তাদের জাতি হবে একটি, নেতা হবেন একজন এবং তাদের লক্ষ্যও হবে একটি। জাতির নেতা যদি সত্যনিষ্ঠ, নির্ভিক, জাতির কল্যাণকামী ও আদর্শবাদী হন তবে তারা অবশ্যই তাদের লক্ষ্য অর্জনে সফল হবে। প্রথমে মহানবী (স.)-এর কষ্ট হলো। কিন্তু তিনি তাদের ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হলেন।
এরপর ইতিহাস থেকে আমরা দেখি আরব জাতির অবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধিত হলো। তারা সবাই একজন আরেকজনের ভাই হয়ে গেল, কোন শত্রুতা থাকলো না। স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা ইত্যাদি কোন কু-স্বভাব থাকলো না। জাতি পাঁচ দফা কর্মসূচির আওতার মাধ্যমে শৃঙ্খলার মধ্যে চলে আসলো। লক্ষ্যহীন জাতির একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য হলো। আল্লাহর প্রেরীত সত্যদীনকে পুরো মানবজাতির জীবনে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামে তারা নেমে পড়লেন। ফলে একটি যুগান্তকারী বিস্ময়কর ঘটনা মানবজাতি প্রত্যক্ষ করল। সেই অবজ্ঞাত অজ্ঞান আরবদের মাধ্যমে একটি সুমহান সভ্যতার উন্মেষ ঘটলো। কয়েকশ’ বছরেই তারা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, সামরিক শক্তিতে বিশ্বের শিখরে আরোহণ করলো। কিন্তু গত এক হাজার বছরে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভুলে যাওয়ায় ও আদর্শকে ত্যাগ করায় জাতি আজ পরাশক্তির গোলাম হয়ে আজকের নিন্দিত নিকৃষ্ট অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছে।
অতএব এখন আবার সেই আদর্শের ভিত্তিতে জাতিকে জাগিয়ে তুলে সেই গৌরবের আসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করা প্রয়োজন। আমরা যেন আমার উন্নত হতে পারি সেই লক্ষ্যে আল্লাহ সেই আদর্শটি দয়া করে পুনরাায় দান করেছেন। যার ফলে নতুন ইতিহাসের জন্ম দেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব। দিন পাল্টানো যায়, দিন এমনিতেও পাল্টায়। কিন্তু খারাপ দিন পাল্টে সুদিন আনার জন্য প্রয়োজন একটি আদর্শ, একটি উন্নত জীবনপদ্ধতি। আমরা সেই আদর্শ ও জীবনপদ্ধতির চর্চা করছি এবং সকলকে বলছি এর সঙ্গে সামিল হতে। যাচাই করার জন্য আমরা তা জনসাধারণের সামনে উপস্থাপন করছি যেন তারা তা গ্রহণযোগ্য হলে গ্রহণ করতে পারে। আমরা আল্লাহর উপর তাওয়াক্কল রেখে বলতে পারি, আমাদের আদর্শ আমাদের নিজেদের রচনা করা নয়। এটা আল্লাহ দান করেছেন। তাই এটি নির্ভুল। এটি গ্রহণ করলে বাঙালি জাতি যেমন বিশ্বের বুকে মর্যাদাশীল জাতি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে। তেমনি মুসলিমরাও তাদের লাঞ্ছনার জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে, আল্লাহর গজব ও লানত থেকে মুক্ত হয়ে সমগ্র মানবজাতিকে এক অখণ্ড জাতিসত্তায় পরিণত করতে সক্ষম হবে। কেবল তখনই শুধু রোহিঙ্গা নয় পৃথিবীর যত নিপীড়িত মানুষ আছে তাদের নিপীড়ন বন্ধ করা যাবে। দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার, দরিদ্রের উপর ধনীর বঞ্চনা, মজলুমের উপর জালেমের অত্যাচার রুখে দেওয়া সম্ভব হবে।