আল্লাহ আদম (আ.) থেকে শুরু করে তার প্রত্যেক নবী-রসুল (আ.) কে পাঠিয়েছেন একটিমাত্র উদ্দেশ্য দিয়ে। তাহল যার যার জাতির মধ্যে আল্লাহর তওহীদ ও তাঁর দেওয়া জীবন ব্যবস্থা দীন প্রতিষ্ঠা করা। শেষ নবীকে পাঠালেন সমস্ত মানব জাতির উপর এই দীন প্রতিষ্ঠা করার জন্য (কোর’আন-সুরা আল-ফাতাহ-২৮, সুরা আত-তওবা-৩৩, সুরা আস-সফ্-৯)।
পূর্ববর্তী নবীদের উপর অর্পিত দায়িত্ব তাঁরা অনেকেই তাদের জীবনেই পূর্ণ করে যেতে পেরেছিলেন, কারণ তাদের দায়িত্বের পরিসীমা ছিল ছোট। কেউ এসেছিলেন একটি গোত্রের জন্য, কেউ বা কোনো নির্দিষ্ট জনপদের অধিবাসীদের জন্য। কিন্তু এই শেষ রসুলের দায়িত্ব ছিল সমগ্র পৃথিবীর উপর আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করা। এত বড় কাজ এক জীবনে করে যাওয়া অসম্ভব। তাই আল্লাহর নির্দেশে তিনি এমন একটি জাতি বা উম্মাহ সৃষ্টি করলেন পৃথিবী থেকে তাঁর চলে যাওয়ার পরও যে জাতি তার উপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পূর্ণ করার জন্য তারই মত জেহাদ, সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। এই জাতি হলো তার উম্মাহ-উম্মতে মোহাম্মদি- মোহাম্মদের জাতি।
রসুলাল্লাহ যতদিন এই পৃথিবীতে রইলেন ততদিন তিনি নিজে তাদের ভবিষ্যৎ কাজের জন্য প্রশিক্ষণ দিলেন। মাত্র দশ বছরের মধ্যে আটাত্তরটি যুদ্ধ সংঘটিত করে, একটি দুর্র্ধষ যোদ্ধা জাতি গঠন করে তিনি তাঁর প্রেরক প্রভুর কাছে চলে গেলেন।
যে অপরাজেয় যোদ্ধা জাতিটি তিনি গঠন করে গেলেন সে জাতির আকিদার মধ্যে তিনি সুস্পষ্টভাবে গেঁথে দিয়ে গেলেন যে তাঁর ওপর আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব হচ্ছে সর্বাত্মক সংগ্রামের মাধ্যমে সমস্ত পৃথিবীতে এই দীন প্রতিষ্ঠা করা। তাঁর অবর্তমানে তাঁর গঠিত এই উম্মাহর ওপরই এ দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মধ্যে প্রথম যিনি বিশ্বনবীকে প্রেরিত বলে স্বীকার করে এই দীনে প্রবেশ করলেন; অর্থাৎ আবু বকর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেই রসুলাল্লাহকে জিজ্ঞাসা করলেন- ‘হে আল্লাহর রসুল! এখন আমার কাজ কী? কর্তব্য কী?’ আল্লাহর শেষ নবী যে উত্তর দিয়েছিলেন তা আমরা ইতিহাসে ও হাদিসে পাই। তিনি বললেন, ‘এখন থেকে আমার যে কাজ তোমারও সেই কাজ।’
কোনো সন্দেহ নেই যে যদি প্রত্যেকটি মানুষ-যারা ঈমান এনে মহানবীর হাতে মুসলিম হয়েছিলেন তারা আবু বকরের (রা.) মতো- যদি ঐ প্রশ্ন করতেন তবে তিনি প্রত্যেককেই ঐ জবাব দিতেন। ‘আমার যে কাজ’ বলতে তিনি কী বুঝিয়েছিলেন? তাঁর কী কাজ ছিল? তাঁর কাজ তো মাত্র একটা, যে কাজ আল্লাহ তাঁর উপর অর্পণ করেছেন। সেটা হলো সমস্ত রকমের জীবনব্যবস্থা ‘দীন’ পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে এই শেষ দীনকে মানব জীবনে প্রতিষ্ঠা করা।
ইতিহাসে পাচ্ছি, শেষ-ইসলামকে গ্রহণ করার দিনটি থেকে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আবু বকরের (রা.) কাজ একটাই হয়ে গিয়েছিল। সেটা ছিল মহানবীর সংগ্রামে তাঁর সাথে থেকে তাঁকে সাহায্য করা। শুধু আবু বকর (রা.) নয়, যে বা যারা নবীকে বিশ্বাস করে মুসলিম হয়েছেন সেই মুহূর্ত থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি বা তারা বিশ্বনবীকে তাঁর ঐ সংগ্রামে সাহায্য করে গেছেন, তাঁর সুন্নাহ পালন করে গেছেন। আর কেমন সে সাহায্য! স্ত্রী-পুত্র-পরিবার ত্যাগ করে, বাড়ি-ঘর, সম্পত্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য ত্যাগ করে, অর্ধাহারে-অনাহারে থেকে, নির্মম অত্যাচার সহ্য করে, অভিযানে বের হয়ে গাছের পাতা খেয়ে জীবন ধারণ করে এবং শেষ পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রে জীবন বিসর্জন দিয়ে। এই হলো তার উম্মাহ, উম্মতে মোহাম্মদি, তাঁর প্রকৃত সুন্নাহ পালনকারী জাতি। তারা তাদের দায়িত্ব সম্বন্ধে কতখানি সচেতন ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় বিশ্বনবীর ইন্তেকালের পর তাঁর উম্মাহর ইতিহাস থেকে।
নেতার পৃথিবী থেকে বিদায় নেবার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত জাতিটি স্বদেশ (আরব) থেকে বের হয়ে উত্তাল ঢেউয়ের মত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল এবং সর্বদিক দিয়ে তাদের চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী দুইটি বিশ্বশক্তিকে সামরিকভাবে পরাজিত করে তদানীন্তন অর্ধেক পৃথিবীতে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব অর্থাৎ তওহীদ ভিত্তিক সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করল। ঐ উম্মাহর শতকরা আশি জনেরও বেশির কবর তাঁদের স্বদেশ আরবের বাইরে হয়েছে। এটাই হচ্ছে উম্মতে মোহাম্মদির পরিচয়।
বর্তমানে উম্মতে মোহাম্মদি হিসাবে যারা পরিচয় দেন, তাদের কাছে ইসলামের মূল কাজ হলো টাখনুর উপর পায়জামা, খাওয়ার পূর্বে লবন খাওয়া, ডান কাত হয়ে শোওয়া, লম্বা জোব্বা, পাগড়ি, লম্বা দাড়ি, কাঁধে চেক রুমাল আর পাড়া মহল্লা কাঁপিয়ে মিলাদ ও জেকের করা, ব্যাস এই হলো উম্মতে মোহাম্মদি। এদের সামনে জেহাদ অপরিচিত। দুনিয়াময় ইহুদী খ্রিষ্টান ‘সভ্যতা’ অর্থাৎ দাজ্জালের শাসন, তাগুতের সার্বভৌমত্ব চলছে নাকি আল্লাহর সার্বভৌমত্ব চলছে, এটা তাদের বিবেচ্য নয়, দুনিয়াময় মুসলিম নামক জাতিটি অন্য জাতির লাথি খাচ্ছে খাক, নির্যাতিত হোক, এদের নারীরা ধর্ষিতা হচ্ছে হোক এটাও তাদের কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়। এদের কেউ মসজিদে গিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে বাধা দিচ্ছে না, জেকের করতে বাধা দিচ্ছে না এতেই তারা খুশি। এ জাতীয় নির্জীব, নির্বিকার অন্তর্মুখী বিচ্ছিন্ন জনসংখ্যাকে মানবজাতির সেরা বিপ্লবী রসুলাল্লাহ অন্তত আর কিছু হোক তাঁর উম্মাহ বলে স্বীকার করবেন না।