কাজী মাহফুজ:
সকল উন্নতি, প্রগতি, শক্তি, সমৃদ্ধির মূল হচ্ছে ঐক্য। ঐক্য ছাড়া কোনো অভীষ্ট, কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। আল্লাহ যে সকল প্রাকৃতিক নিয়ম দ্বারা তাঁর সৃষ্টিজগৎ পরিচালনা করেন তার মধ্যে একটি অপরিবর্তনীয় ও অলঙ্ঘনীয় নিয়ম হচ্ছে ঐক্য অনৈক্যের উপর সর্বদাই বিজয় লাভ করবে। দশজন ঐক্যবদ্ধ লোক একশ’ জন ঐক্যহীন লোকের সঙ্গে বিজয়ী হয়। এ চিরন্তন সত্যটি হাজার বছর আগেও সত্য ছিল হাজার বছর পরেও সত্যই থাকবে। এক্ষেত্রে ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ে পড়ে আসা “একতাই বল” গল্পটি স্মরণ করা যেতে পারে। একদা মৃত্যুপথযাত্রী দরিদ্র কৃষক তার দশজন সন্তানকে ডেকে আনলেন। তিনি একসাথে দশটি লাঠির আঁটি বেঁধে প্রত্যেককে ভাঙ্গতে দিলেন। কিন্তু ছেলেদের কেউই তা ভাঙ্গতে পারলো না। আঁটি খুলে যখন প্রত্যেকের হাতে একটি করে লাঠি দিলেন তখন তারা খুব সহজেই লাঠিগুলো ভেঙ্গে ফেলল। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, এ থেকে তোমরা কী বুঝলে? ছেলেরা কোনো উত্তর দিতে পারলো না, তখন বাবা নিজেই ব্যাখ্যা করে বললেন, আমি হয়তো আর বেশিদিন বাঁচবো না। আমার মৃত্যুর পর যদি তোমরা এক আঁটির ন্যায় ঐক্যবদ্ধ থাকো তাহলে কেউ তোমাদের পরাজিত করতে পারবে না। আর যদি তোমরা ঐক্যহীন হয়ে পড়ো তাহলে শত্র“রা সহজেই তোমাদের পরাজিত করে ফেলবে। তখন আমার রেখে যাওয়া সম্পত্তিও তোমরা হারাবে। আর এটাই হচ্ছে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার নৈতিক শিক্ষা। পাকিস্তানি শাসকদের দুঃশাসন, বৈষম্যমূলক শাসননীতি, অন্যায়, অবিচার ও অশান্তি এবং ধর্মীয় বিভেদ-বিভাজন বাঙ্গালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল বাঙালি জাতি। বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্ত্রী-পুত্র, পরিবার, সহায় সম্পত্তি ত্যাগ করে সাত কোটি বাঙালি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত ও শক্তিশালী বাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটায়। গত ৪৩ বছরে আমরা যদি একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে থাকতাম, তবে এ দেশটি সমসাময়িক মালয়েশিয়া, থাইল্যাণ্ড, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ার মতো উন্নতিতে, প্রগতিতে, শক্তিতে, সমৃদ্ধিতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াতাম তা কল্পনার বাইরে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ জাতি ৭১এর সেই ঐক্য ধরে রাখতে পারে নি। নিয়তির পরিহাস এই যে, আমরা জাতিগতভাবে সেই চিরন্তন নিয়মটি অস্বীকার করেছি ফলে আমরা আজ সংখ্যায় ১৬ কোটি হলেও পৃথিবীতে আমাদের কোনো প্রভাব নেই, আমাদের সমাজে শান্তি নেই। এ জাতি আজ পূর্বের চেয়ে বেশি ঐক্যহীন ও বিভক্তিতে নিমজ্জিত হয়ে আছে। এই বিভক্তির পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী ধর্মব্যবসায়ী মোল্লা শ্রেণি যারা ধর্মের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে জাতিকে নানা মাজহাব, ফেরকায়, ধর্মীয় মতাদর্শে খণ্ড-বিখণ্ড করে রেখেছে, নানা তাবুতে বিভক্ত করে রেখেছে। আবার এক শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ীরা ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় জড়িয়ে আরও বিভক্ত ও ঐক্যহীন করে ফেলেছে। এই ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণিটি ধর্মকে শুধুমাত্র তাদের রুটি-রুজির মাধ্যম ও স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে। আল্লাহ কোর’আনে ধর্মকে পার্থিব স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার বানাতে এবং ধর্মীয় কাজের বিনিময় নিতে নিষেধ করেছেন। [সুরা বাকারাঃ ১৭৪] এই শ্রেণিদের রসুলাল্লাহ আসমানের নিচে সবচেয়ে নিকৃষ্ট জীব হিসেবে বর্ণনা করেছেন। [হাদিস- আলী রাঃ থেকে বায়হাকী, মেশকাত] আমরা সকলেই যদি শান্তি চাই, সকলেই যদি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি শান্তিময় পৃথিবী উপহার দিতে চাই, তবে এজন্য আমাদেরকে সকল প্রকার বিদ্বেষ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, এ কথাতে নিশ্চয়ই আপনারা সবাই একমত হবেন? কিন্তু আমরা বিভিন্ন ধর্মের মানুষ ঐক্যব
দ্ধ হবো কিসের ভিত্তিতে? সেটাই আজ খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের সকলের স্রষ্টা এক, একই পিতা-মাতার রক্ত আমাদের সবার দেহে। সকল নবী-রসুল-অবতারগণও এসেছেন সেই এক স্রষ্টার পক্ষ থেকে। তাই শান্তি পেতে হলে আমাদেরকে স্রষ্টার হুকুমের উপর ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমাদেরকে পাশ্চাত্য ‘সভ্যতা’র চাপিয়ে দেওয়া তন্ত্রমন্ত্রকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে, সর্বপ্রকার ধর্মব্যবসা ও ধর্ম নিয়ে অপরাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে সকল প্রকার সন্ত্রাস, হানাহানির বিরুদ্ধে এবং সকল ন্যায় ও সত্যের পক্ষে। আল্লাহর শেষ রসুলও সকল জাতির উদ্দেশে ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন, “গ্রন্থের অধিকারী সকল সম্প্রদায়, একটি বিষয়ের দিকে এসো যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে এক, তা হল- আমরা আল্লাহ ছাড়া আর কারও এবাদত করব না, তাঁর সাথে কোনো অংশীদার সাব্যস্ত করব না, আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে প্রভু বলে মানবো না (সুরা এমরান ৬৪)”। অতএব, আসুন, আমরা কোন কোন বিষয়ে আমাদের মিল আছে সেগুলি খুঁজে বের করি, অমিলগুলো দূরে সরিয়ে রাখি, বিচ্ছেদের রাস্তা না খুঁজে সংযোগের রাস্তা খুঁজি। আজকে যারা ধর্মের নামে, রাজনীতির নামে বিভেদের মন্ত্র শেখায়, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস বিস্তার করে তারা আল্লাহর উপাসক নয়, তারা শয়তান বা আসুরিক শক্তির উপাসক। এদের ব্যাপারে সবাইকে সচেতন থাকা আবশ্যক।