মোহাম্মদ আসাদ আলী
কোনো উগ্রবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠী যখন কোনো দেশে প্রভাব বিস্তার করে কিংবা রাষ্ট্রক্ষমতায় যায়, তখন তাদের আচরণ কেমন হয়, শাসনব্যবস্থা কেমন হয়, বিচারব্যবস্থা কেমন হয় ও সমাজব্যবস্থা কেমন হয় তা আমাদের মোটামুটি জানা। এসব নিয়ে সমালোচনার অন্ত নেই। কিন্তু যারা সেই সমালোচনায় সবচেয়ে মুখর থাকেন, সেই সুশীলদের অবস্থাও একটু বিচার করা দরকার। ধর্মান্ধদের নিন্দার পাশাপাশি এদিকটাও খতিয়ে দেখা দরকার যে, দেশে লক্ষ লক্ষ পশ্চিমা শিক্ষিত সুশীল নাগরিক থাকা সত্ত্বেও কীভাবে একটি ধর্মান্ধ গোষ্ঠী শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে এবং ক্ষমতার শীর্ষে আরোহন করতে পারে। গলদটা কোথায়?
আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণে প্রথম ও প্রধান যে গলদটা দেখতে পাই তাহলো উগ্রবাদী ধর্মান্ধরা তাদের বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত থাকলেও কথিত শিক্ষিত ও সুশীল গোষ্ঠী একবিন্দু ত্যাগও স্বীকার করতে চায় না ধর্মান্ধতা মোকাবেলার জন্য। এটাই তথাকথিত সুশীলদের খুঁটিকে নড়বড়ে করে দেয় অনেকাংশে।
কথিত এই সুশীলদের চরিত্র হলো- তারা লিখবে, গাইবে, ছবি আঁকবে, ফিল্ম তৈরি করবে, ফূর্তি করবে আর একদল বেতনভুক্ত সৈন্য পালবে তাদেরকে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য, ব্যাস! তারপর সেই সৈন্যরা পরাজিত হলে সুশীল সাহেবরা উগ্রবাদীদের হাতে দেশ সঁপে দিয়ে টাকা পয়সা নিয়ে বিদেশে পালিয়ে যাবে। কেঁদে কেঁদে বলবে- অমুক দেশ আমাদের কেন বাঁচালো না, অমুক সরকার আমাদের কেন নিরাপত্তা দিতে পারল না! অথচ তাদের চোখের সামনেই সবকিছু ঘটেছে, যখন তারা স্বার্থপরের মত দিন কাটিয়েছে। তাদের সামনেই উগ্রবাদের জন্ম হয়েছে, বিস্তার লাভ করেছে, শক্তিশালী হয়েছে এবং পুরো দেশকে গ্রাস করে ফেলেছে, কিন্তু তথাকথিত সুশীল শ্রেণির সেদিকে মনোযোগ ছিল না, যতটা মনোযোগ ছিল দুর্নীতি ও লুটপাট করার দিকে, কিংবা ভোগ বিলাসী জীবন যাপনের দিকে।
যখন উগ্রবাদী ধর্মান্ধরা তাদের বিকৃত মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দেয়, তখন এরা ঘরে বসে বসে গান গায়, ছবি আঁকে, খেলা দেখে, সিনেমা দেখে। যখন উগ্রবাদীরা বিষাক্ত মতবাদ ছড়িয়ে দিয়ে দরিদ্র বঞ্চিত ছেলেদেরকে একটু একটু করে বিপথগামী করতে থাকে তখন এরা নিজেদের সন্তানদেরকে বিদেশে পড়াশোনা করে সেটেল হতে পাঠায়। যখন দেশের বিভিন্ন অংশে উগ্রবাদীরা অবহেলিত মানুষের সমর্থন আদায় করে নেয়, তখন এরা শহুরে বিলাসবহুল প্রাসাদে এসি কামরায় বসে প্রেমের কবিতা লেখে, গল্প লেখে, উপন্যাস লেখে।
তারপর একদিন শুরু হয় পরিণতি ভোগের পালা। শুরু হয় কান্নাকাটি, আহাজারি। তারা করুণ কণ্ঠে প্রতিবেশী দেশ বা আন্তর্জাতিক পরাশক্তিদের সাহায্য ভিক্ষা করেন আর বলেন- প্লিজ আমাদেরকে বাঁচান, ওই দেখুন শিল্পির কণ্ঠ থামিয়ে দিচ্ছে, সুরের গিটার ভেঙে দিচ্ছে, নারীর অধিকার কেড়ে নিচ্ছে, ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা গুড়িয়ে দিচ্ছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করছে ইত্যাদি ইত্যাদি!
আমার প্রশ্ন হলো- ধর্মান্ধ উগ্রবাদীরা এতদূর আসতে পারল কীভাবে? তারা ক্ষমতায় এলে সঙ্গীত নিষিদ্ধ করে দেয়, খেলাধুলা নিষিদ্ধ করে দেয়, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ধ্বংস করে দেয়, টিভি দেখা নিষিদ্ধ করে দেয়, নারী অধিকার হরণ করে নেয়, ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে- এসব তো আগে থেকেই জানা কথা। এসব যদি মানতে না পারেন তাহলে ক্ষমতায় আসতে দিলেন কেন? প্রতিরোধ গড়লেন না কেন? কেন লক্ষ লক্ষ মানুষ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান? এর অর্ধেকও যদি উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতেন তাহলে উগ্রবাদীরা পালানোর রাস্তা খুঁজে পেত কি? দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। তারাই তো যথেষ্ট যে কোনো দেশের উগ্রবাদী নারীবিদ্বেষীদের মোকাবেলার জন্য। কয়েক কোটি নারী যদি শুধু ঝাড়ু হাতে নিয়ে রাস্তায় বের হয় তাহলে উগ্রবাদীদের কী দশা হবে ভেবে দেখেছেন? অবাক করা বিষয় হলো- তারা বিমানের চাকায় চড়ে দেশ ছাড়তে গিয়ে জীবন দেন, কিন্তু উগ্রবাদীদের মোকাবেলা করতে জীবন দিতে চান না। তাহলে যেই যুদ্ধ তারা নিজেরা করতে চান না, সেই যুদ্ধ আমেরিকা এসে করবে কেন? ভারত করবে কেন? চীন করবে কেন? তারা নিজেরা কেন দাঁড়াতে চায় না?
কারণ একটাই- তাদের সেই মনোবল নাই। আর মনোবল নাই তার কারণ তাদের কোনো আদর্শ নাই। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয় উগ্রবাদী ধর্মান্ধরা বিকৃত হলেও কিন্তু “ধর্ম” দিয়ে উদ্বুদ্ধ। তাদের নৈতিক শক্তি টনটনে- কারণ তারা বিশ্বাস করে তারা আল্লাহর পথে লড়াই করছে, তাদের শাসন প্রতিষ্ঠা হলে মানুষ শান্তি পাবে, মুক্তি পাবে (যদিও বাস্তবে বিকৃত মতাদর্শ চর্চার কারণে শান্তি অধরাই থেকে যায়)। তারা এটাকে ভাবে বিপ্লব। অন্যদিকে পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত কথিত সুশীল নাগরিকদের “আদর্শ” বলতে কিছুই নেই। পশ্চিমা গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি মতাদর্শ তাদের কাছে কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের সিঁড়ি মাত্র। ক্ষমতায় যেতে পারলেই কিসের গণতন্ত্র আর কিসের ধর্মনিরপেক্ষতা- ওসব শিকেয় তুলে রাখা হয় আর দেশে চলে বিশুদ্ধ লুটপাটতন্ত্র। কাজেই আদর্শিকভাবে এই নেটিজেন সিটিজেনরা সর্বদাই দেউলিয়া হয়ে থাকে।
দ্বিতীয় যে বিষয়টা নৈতিক শক্তি তৈরি করতে পারত তা হলো সততা। এক্ষেত্রেও দেখা যায় সুশীলদের ভরাডুবি। তারা দেশের ক্ষমতার অংশীদার হয়ে যুগের পর যুগ গরীব-দুঃখী মেহনতী মানুষের রক্ত চুষে খান, বিদেশে সম্পদ পাচার করেন, দেশটাকে গরু ছাগলের চারণভূমি বানিয়ে রেখে নিজের সন্তানকে বিদেশে পড়তে পাঠান। যে দেশের মানুষ পেটপুরে খেতে পায় না, সেই দেশে তারা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে বিলাসবহুল প্রাসাদ বানান। আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হন। এভাবে তারাই তৈরি করে দেন বিপ্লবের পটভূমি। তাদের দুর্নীতি ও লুটপাট থেকেই মূলত উগ্রবাদীরা অক্সিজেন পায়। তাহলে তারা কীভাবে উগ্রবাদের মোকাবেলা করবে? না আছে আদর্শ, না আছে সততা। অগত্যা পালিয়ে জীবন বাঁচানোই উপায় হয়ে দাঁড়ায়।
এই যখন অবস্থা, তখন উগ্রবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠী ও পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত কথিত সুশীল গোষ্ঠী উভয়ের মধ্যে কোনো একটিকে বেছে নিতে হয় দেশের জনগণকে। সেটা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। আমরা দেখতে পাই একপক্ষ উগ্রবাদীদের বিরোধিতা করতে গিয়ে দুর্নীতিবাজ গোষ্ঠীকে সমর্থন দিতে বাধ্য হয়, আবার আরেকপক্ষ দুর্নীতিবাজ গোষ্ঠীর বিরোধিতা করতে গিয়ে উগ্রবাদী গোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়ে ফেলে। তবে কি সত্য অবাঞ্ছিত ও অবহেলিতই থেকে যাবে?
[মতামতের জন্য যোগাযোগ: ০১৬৭০১৭৪৬৫১, ০১৭১১৫৭১৫৮১, ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১০০৫০২৫]