গতকাল ছিল ঐতিহাসিক ১২ রবিউল আউয়াল। দেশজুড়ে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও শ্রদ্ধার সাথে পালিত হল দিনটি। এই দিনটি উদ্যাপন করা বেদাত কিনা, অথবা একে ঈদে মিলাদুন্নবী বলা হবে নাকি সিরাতুন্নবী বলা হবে তা নিয়ে দীর্ঘদিন থেকেই তর্কবিতর্ক, বাহাস করে আসছেন আমাদের আলেমগণ। এমন কি অনেক জায়গায় এই নিয়ে একদল আরেকদলকে প্রতিরোধ, হামলা, মারামারি পর্যন্ত হয়েছে। অথচ এটি বিতর্কের কোনো বিষয়ই নয়। মিলাদ, মাওলিদ এবং মাওলুদ এ তিনটি শব্দের আভিধানিক অর্থ যথাক্রমে জন্মদিন, জন্মকাল ও জন্মস্থান প্রভৃতি। সুপ্রসিদ্ধ আল মুনজিদ নামক আরবি অভিধানের ৯১৮ পৃষ্ঠায় রয়েছে, অর্থাৎ মিলাদ অর্থ জন্মসময়। মাওলিদ অর্থ জন্মস্থান অথবা জন্মসময়। মাওলুদ অর্থ ছোট শিশু। অনুরূপ মিসবাহুল লুগাতের ৯৬৬ পৃষ্ঠায় রয়েছে, ‘মিলাদ’ অর্থ জন্মসময়। ‘মাওলিদ’ অর্থ জন্মস্থান অথবা জন্মসময়। ‘মাওলুদ’ অর্থ ছোট শিশু।
রাসুলাল্লাহ সোমবারে রোজা বা সওম রাখতেন। আবু কাতাদা (রা.) হতে বর্ণিত, রসুলাল্লাহর দরবারে আরজ করা হলো তিনি প্রতি সোমবার রোজা রাখেন কেন? উত্তরে তিনি বলেন, এই দিনে আমি জন্মগ্রহণ করেছি, এই দিনেই আমি প্রেরিত হয়েছি এবং এই দিনেই আমার উপর পবিত্র কোর’আন নাযিল হয়। [সহিহ মুসলিম শরীফ ২য় খণ্ড, ৮১৯ পৃষ্ঠা, বায়হাকী: আহসানুল কুবরা, ৪র্থ খণ্ড ২৮৬ পৃঃ, মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল ৫ম খণ্ড ২৯৭ পৃ:, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক ৪র্থ খণ্ড ২৯৬পৃ:, হিলিয়াতুল আউলিয়া ৯ম খণ্ড ৫২ পৃ:] যারা নবী করিম (সা.) এর জন্মদিনকে ঈদের মতো উৎসব আকারে পালন করেন তারা এই হাদিসটি দলিল হিসাবে পেশ করেন।
সিরাতও একটি আরবি শব্দ। এর বহুবচন হচ্ছে সিয়ার। অর্থ চাল-চলন, গতি ইত্যাদি। আরবি ভাষার বিখ্যাত অভিধান‘আল মুজাম আল আজম’ ও ‘মিসবাহুল লুগাত’-এ সিরাত শব্দের অর্থ করা হয়েছে- (১) যাওয়া, প্রস্থান করা, চলা; (২) গতি, পথ, পদ্ধতি, ধারা; (৩) আকার, আকৃতি, মুখাবয়ব; (৪) চেহারা, আকৃতি; (৫) অবস্থা; (৬) কর্ম-নৈপুণ্য, ঢঙ, চাল; (৭) সুন্নত; (৮) জীবন চলার ধরণ, প্রকৃতি, কাজকর্ম করার ধরণ, জীবন পরিচালনার ঢঙ; (৯) অভ্যাস; (১০) কাহিনী, পূর্ববর্তীদের গল্প বা কাহিনী এবং ঘটনাবলীর বর্ণনা ইত্যাদি।
অন্যদিকে ‘ইসলামী বিশ্বকোষ’ সিরাতের অর্থ লিখেছে- (১) যাওয়া, যাত্রা করা, চলা; (২) মাজহাব বা তরিকা; (৩) সুন্নাহ; (৪) আকৃতি; (৫) অবস্থা; (৬) কীর্তি; (৭) কাহিনী, প্রাচীনদের জীবন ও ঘটনাবলীর বর্ণনা; (৮) নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর গাজওয়ার (যুদ্ধের) বর্ণনা; (৯) অমুসলিমদের সঙ্গে সম্পর্ক, যুদ্ধ এবং শান্তির সময়ে মুহাম্মদ (সা.) যা বৈধ মনে করতেন তার বর্ণনা কিংবা মোহাম্মদ (সা.)-এর জীবন চরিত; সম্প্রসারিত অর্থে বীরপুরুষদের কীর্তির বর্ণনা।
সুতরাং বোঝা গেল মিলাদ ও সিরাত দুটো শব্দকে নিয়ে বিতর্কের কোনো জায়গা নেই। রসুলাল্লাহর জন্মদিনকে স্মরণ করে তাঁর জীবনাদর্শ নিয়ে আলোচনা করাটাই হচ্ছে এই দিনটিতে করণীয়। এর চেয়ে বেশি কিছু করাকে অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছুই নয়। আর দীন নিয়ে বাড়াবাড়ি নিষিদ্ধ, হারাম। এমনিতেই মুসলমান নামক জনগোষ্ঠী আজকে চরমভাবে লাঞ্ছিত পরাজিত, নিপীড়িত। তারা নিজেরাও হাজার হাজার ফেরকা-মাজহাবের জালে বন্দী হয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে শত্রুতায় লিপ্ত হয়ে আছে। তাদের অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে বিশ্বের পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো এখন মুসলমানদেরকে হত্যা করে তাদের ভূখণ্ডগুলোকে দখল করে নিচ্ছে। এই জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করার জন্য জঙ্গিবাদের ইস্যু সৃষ্টি করে দিয়ে একটার পর একটা দেশ ধ্বংস করে দিচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী। ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, লিবিয়া, ইয়েমেন ইত্যাদি ধ্বংস করে দিয়েছে। এই মুহূর্তে মুসলিম জতির আট কোটি মানুষ উদ্বাস্তু, লাখ লাখ নারী ইজ্জতহারা, ইউরোপের নানাদেশে তারা ভিক্ষা করছে। এ অবস্থায় জাতির অস্তিত্ব রক্ষা করাই যখন মুখ্য কর্তব্য তখন ঈদে মিলাদুন্নবী বলা হবে নাকি সিরাতুন্নবী বলা হবে, এটা বেদাত না বৈধ এ নিয়ে বিতর্ক, বাহাস, মারামারি করা কতটা নির্বুদ্ধিতা, মূঢ়তা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কাজেই আমরা ওসব অপ্রয়োজনীয় বিতর্কে না গিয়ে বরং রসুলাল্লাহর পবিত্র জীবনী নিয়েই আলোচনা করব।
যাই হোক, আজ এমন একটি দিন যেদিন গবেষকদের মতে রসুলাল্লাহর জন্মদিন ও ওফাত দিবস। এই দিনে আমাদের অঙ্গীকার হোক, আমরা তাঁর সেই আরাধ্য কাজ অর্থাৎ সমগ্র পৃথিবীময় সত্যদীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানবজীবন থেকে অন্যায় অবিচার দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য নিজেদের জীবন সম্পদ উৎসর্গ করব। তিনি যে তওহীদের সুতোয় জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে গেছেন আমরা আবারও সেই তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হবো। আমরা সকল জাতিবিনশী ফেরকা-মাজহাব, তরিকা, দল উপদল ভুলে একজাতিতে পরিণত হবো। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, ধর্মব্যবসা, অপরাজনীতি ইত্যাদির বিরুদ্ধে ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্তা গড়ে তুলব। তাহলেই এই দিনটির যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে।