সুলতানা রাজিয়া
নির্দিষ্ট কোনো ইস্যুকে কেন্দ্র করে, নির্দিষ্ট কোন সমস্যাকে ভিত্তি করে আন্দোলন করার রেওয়াজ বর্তমানে সর্বব্যাপী। গণতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী দলগুলো শতাব্দীর অধিক কাল ধরে পাশ্চাত্যের শেখানো এই পদ্ধতি মেনে বিক্ষোভ, মানববন্ধন, লংমার্চসহ বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি পালন করে আসছে। তাদের দেখাদেখি বহু ইসলামি দল ও ধর্মীয় সংগঠন যুগের নিয়ম ভেবে ঐ পন্থাতেই তাদের দাবি দাওয়া আদায়ের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যেমন তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের ধুয়ো তুলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে জ্বালাও-পোড়াও ভাঙচুরের মতো অগ্রহণযোগ্য কর্মসূচি পালন করে থাকে, তেমনি ধর্মীয় অনেক সংগঠনও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে রাস্তায় নেমে সহিংসতার পরিচয় দিয়ে থাকে। আর রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে দেশ অচল করে দেওয়ার হুমকি তো বলতে গেলে তারা প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার দিয়ে থাকে।
ধর্মভিত্তিক দলগুলোর এ ধরনের হুমকি কিংবা সহিংস কর্মসূচি কখনো কোনো ফলাফল বয়ে আনতে পারে নি এমন কথা আমরা বলবো না। তাদের অনেক দাবি অতীতে পূরণ হয়েছে। বিশেষ করে এভাবে কোনো একটি সুনির্দিষ্ট ইস্যুকে কেন্দ্র করে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের অনুক‚লে সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের বহু সংগঠন বহুবার সফল হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত ইসলামের কতটুকু লাভ হলো, আল্লাহ ও রসুলের ইজ্জত কতটা বাড়ল আর সাধারণ জনগণেরই বা কতটুকু উপকার হলো, সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
আমরা দেখেছি, এ ধরনের ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ইসলাম, আল্লাহ ও তাঁর রসুল এবং সাধারণ মানুষের আজ পর্যন্ত তেমন কোনো উপকার হয় নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের আন্দোলনের বিষয়বস্তুগুলো এমন হয়ে থাকে যার সাথে মানুষের জাগতিক কল্যাণ-অকল্যাণ, শান্তি-অশান্তির কোনো সম্পর্কই থাকে না। ফলে তাদের এ ধরনের আন্দোলন দ্বারা মানুষের উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনাই থাকে না। আর ইসলামের উপকারের প্রশ্ন যদি আসে, তবে বলতে হবে, বাইরে থেকে দেখে মনে হতে পারে ইসলামের অনেক বড় উপকার তারা করেছেন। কিন্তু বাস্তবে তাদের এ ধরনের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ইসলামের কোনো উপকার হয় না বলে আমরা মনে করি। আমাদের এ বক্তব্যের স্পষ্ট ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই আমরা এ নিবন্ধেই দেব।
তার আগে প্রথম কথা হচ্ছে, ধর্মভিত্তিক দলগুলো যারা বিভিন্ন ইস্যুকেন্দ্রিক আন্দোলন করেন, বিক্ষোভ, ভাঙচুর ইত্যাদির মধ্য দিয়ে সহিংসতার পরিচয় দিয়ে থাকেন, তারা দাবি আদায়ের এ পদ্ধতিটি শিখেছেন কার কাছ থেকে? প্রশ্নটা আরেকটু পরিষ্কার করা দরকার। যে কোনো ইসলামি সংগঠন যদি নিজেদেরকে ইসলামের সঠিক পথে পরিচালিত বলে দাবি করেন বা বিশ্বাস করেন, তবে তাদেরকে অবশ্যই ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর দেখানো পথে হাঁটতে হবে, তার অনুসরণ করতে হবে। তিনি যে পদ্ধতিতে সত্য প্রতিষ্ঠার কাজ করে গেছেন সেই পদ্ধতির সাথে সাংঘর্ষিক পথ অনুসরণ করলে তা ইসলামের অনুসৃত পথ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। প্রশ্ন হলো আল্লাহর রসুলও কি এমন করে ভিন্ন ভিন্ন সমস্যাকেন্দ্রিক আন্দোলন করেছেন? তিনি কি মক্কার কাফেরদের কাছে বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরে, দাবি দাওয়া পেশ করে আন্দোলন করেছেন? কখনই না। আল্লাহর রাসুলের সমগ্র জীবনীতে এমন একটি ঘটনারও নজির নেই। কোনো ইতিহাসবিদ বা ধর্মজ্ঞানী ব্যক্তি একটি ঘটনার দৃষ্টান্তও দেখাতে পারবেন না যেখানে সুনির্দিষ্ট কোনো ইস্যুকে কেন্দ্র করে আল্লাহর রসুলের কোনো কর্মসূচি ছিল, বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত কোনো বিষয়কে নিয়ে তিনি মাতামাতি করেছেন, সহিংসতা তো দূরের কথা।
বরং আমরা তার পবিত্র জীবনীতে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখতে পাই। আরব যখন জাহেলিয়াতে নিমজ্জিত তখন রসুল (স.) দেখলেন ঘরে ঘরে মূর্তি পুজা চলছে। মদ খেয়ে লোকজন রাস্তায় মাতলামি করছে। পতিতাবৃত্তি, ব্যভিচার ইত্যাদি ব্যাপকভাবে চলছে। চুরি ডাকাতি, খুন রাহাজানি, নারীর প্রতি অবমাননা, কন্যাশিশুকে জীবন্ত দাফন, গোত্রগত সংঘাত, রক্তারক্তি ইত্যাদি ছিল ওই সমাজের প্রতিদিনকার ঘটনা। রসুল পারতেন সেগুলো একটি একটি করে তখনকার সমাজ নেতাদের সামনে তুলে ধরতে, সেগুলোর নিয়ে মাতামাতি করতে, সেগুলো বন্ধ করার দাবি নিয়ে আন্দোলন করতে। কিন্তু তিনি মোটেই সেই পথে হাটেন নি, তার পূর্ববর্তী কোনো নবী-রসুলও না। কারণ আল্লাহর পক্ষ থেকে হেদায়াতপ্রাপ্ত মহামানবরা জানতেন, এভাবে আলাদা আলাদা সমস্যা নিয়ে আন্দোলন করা, সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করা অর্থহীন। তাই সমস্ত সমস্যার গোড়া যেখানে তারা সেখানে হাত দিয়েছেন। একটি বৃক্ষের মূলে যদি পচন ধরে, সেখানে যদি ক্ষতিকর পোকা-মাকড় বাসা বাঁধে, তাহলে সেই বৃক্ষের ডাল পালা কিংবা পাতায় পাতায় পানি বা ওষুধ ঢেলে কী ফায়দা পাওয়া যেতে পারে? ওই বৃক্ষকে সুস্থ করতে হলে অবশ্যই আগে মূলে ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। এটা স্বাভাবিক কথা। ঠিক তেমনি একটি সমাজে বিরাজিত বিবিধ অন্যায়কে দূর করতে হলে সমাজে সেই পরিস্থিতি সৃষ্টির মূল কারণ চিহ্নিত করা ও সেই কারণের প্রতিকার করাই প্রথম কাজ। সেটা যখন হয়ে যাবে তখন বাকি সমস্যাগুলো আপনা থেকেই ঠিক হয়ে যাবে।
আল্লাহর রসুলের কাছে এটা স্পষ্ট ছিল যে তৎকালীন আরবে বিরাজিত যাবতীয় অন্যায়, অবিচারের গোড়ার কারণ হচ্ছে আরবরা আল্লাহর তওহীদকে প্রত্যাখান করেছে। তাই তিনি নিরলসভাবে মানুষকে কেবল এই তওহীদের স্বীকৃতি দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাতে থাকলেন। তার সামনে আরবের বহু বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত সমস্যা উপস্থিত ছিল। কিন্তু তিনি সেগুলো সম্পর্কে আলাদা আলাদাভাবে কোনো বক্তব্য দিলেন না। যতদিন না পর্যন্ত অন্তত একটি জনগোষ্ঠী (মদীনাবাসী) তাকে রসুল ও নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন, ততদিন পর্যন্ত তিনি আল্লাহর তওহীদের উপর সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করে গেলেন। সমাজের মানুষ এজন্য তাঁকে পাগল, গণক, যাদুকর, ভণ্ড, মুরতাদ, কবি ইত্যাদি অনেক কিছু বলেছিলেন কিন্তু তিনি তাদের এই সকল কথার দিকে কর্ণপাত করেন নি। একমনে তিনি মানুষকে সত্য আর মিথ্যা, ন্যায় আর অন্যায়ের পার্থক্য বলে গেছেন এবং আল্লাহর হুকুম মানবো, আর কারোটা মানবো না এই সিদ্ধান্তে আসার জন্য ডাক দিয়ে গেছেন।
সমাজ তখন ছিল ধর্মব্যবসায়ী ও কায়েমী স্বার্থবাদীদের হাতে বন্দী। আল্লাহর রসুল (স.) সেই সমাজকাঠামোর বিরুদ্ধে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করলেন। এক পর্যায়ে জাতি তাঁকে তাদের নেতা হিসাবে মেনে নিল। তারপর তিনি যে সিদ্ধান্ত দিলেন সেটাই নবগঠিত ওই রাষ্ট্রে বাস্তবায়িত হতে লাগল। তিনি তখন আল্লাহর হুকুম মোতাবেক সমাজের অপরাপর সমস্ত সমস্যার একটা একটা করে সমাধান দিতে লাগলেন। মূর্তি থাকবে নাকি থাকবে না, মদ্যপান চলবে নাকি বর্জন করা হবে, সুদ চলবে নাকি চলবে না ইত্যাদি সমস্ত বিষয়ের ফয়সালা হতে শুরু করলো আল্লাহর তওহীদের ভিত্তিতে জাতি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পর, আগে নয়। এখন যেমন একেকটি দাবিকে সামনে রেখে আন্দোলন বিক্ষোভ করা হয়, সেটাকে ব্যবহার করে সুবিধা আদায় করা হয় এমন কাজ রসুল কখনোই করেন নি।
ব্রিটিশ যুগে মহাত্মা গান্ধী দাবি আদায়ের জন্য অনশন করেছিলেন, অসহযোগ আন্দোলন করেছিলেন। মাও সেতুং দাবি আদায়ের জন্য সুদীর্ঘ পথ লং মার্চ করে বিখ্যাত হয়েছিলেন। আজকে ধর্মভিত্তিক দলগুলো বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে যে ধরনের কর্মসূচি পালন করছে সেগুলোর পথ প্রদর্শক আল্লাহর রসুল নন, বরং মহাত্মা গান্ধী, মাও সেতুংরা। আমাদের ইসলামিক আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের মনে রাখা উচিত, গান্ধীজী কিংবা মাও সেতুংদের প্রদর্শিত পথের অনুসরণ নয়, বরং আল্লাহর রসুলের প্রদর্শিত পথের সঠিক অনুসরণই সমাজে বিরাজিত যাবতীয় সমস্যার সমাধান ও ইসলামের গৌরব পুনরুজ্জীবিত করতে পারে। আজকে আপনারা বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন করে হয়তো রাষ্ট্রে অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি করতে পারবেন, সাময়িক একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ছোটখাটো দাবি দাওয়া আদায় করে নিতে পারবেন। কিন্তু সেগুলো করে ইসলামের কোনো উপকার হয় নি, ভবিষ্যতেও হবে না। আল্লাহ, তাঁর রসুল (স.) ও তাঁর দীনকে মর্যাদার জায়গায় নিয়ে আসতে হলে সবার আগে এই জনগোষ্ঠীকে ন্যায় ও সত্যের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়ের সুস্পষ্ট মানদণ্ড তাদের সামনে তুলে ধরে তাদেরকে ন্যায়ের পক্ষ অবলম্বন করার আহ্বান জানাতে হবে। মানুষ যদি তাদের সামষ্টিক জীবনে আল্লাহকে ইলাহ অর্থাৎ হুকুমদাতা হিসেবে মেনে নেয় তাহলে অন্যান্য সব কিছুর সমাধান সময়ের ব্যবধানে আপনা থেকেই হয়ে যাবে। আজকে মুসলিম নামধারী জনগোষ্ঠী যেখানে আল্লাহর তওহীদ থেকে সরে গেছে, সামগ্রিক জীবনে তার হুকুমকে প্রত্যাখ্যান করে তাদের সামষ্টিক জীবন যেখানে পশ্চিমাদের বেধে দেওয়া সিস্টেমে পরিচালিত হচ্ছে, সেখানে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম না করে বরং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইস্যু নিয়ে দাবি আদায় করতে মাঠ গরম করার সংস্কৃতি কাদের স্বার্থে চালু করা হয়েছে তা আমাদের বোধগম্য নয়।