আদিবা ইসলাম
মহান আল্লাহ আখেরী নবীর মাধ্যমে যে দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা পাঠিয়েছেন সেটা ভারসাম্যযুক্ত জীবনব্যবস্থা। এই ভারসাম্য হচ্ছে দুনিয়া ও আখেরাতের ভারসাম্য, দেহ ও আত্মার, শরিয়াত ও মারেফতের ভারসাম্য। এই দ্বীন সহজ-সরল, কোনো রকম আধিক্য বা বাড়াবাড়ির স্থান আল্লাহ রাখেননি। কারণ দ্বীনের কোনো কিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি করার অর্থ দ্বীনের বিকৃত হয়ে যাওয়া, যেমনটা অতীতের জনগোষ্ঠীগুলোর ক্ষেত্রে হয়েছিল। এই দ্বীন নিয়ে বাড়াবাড়ির ফলে দ্বীনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে, জাতির উদ্দেশ্য হারিয়ে গেছে এবং জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। শেষ ইসলামের ক্ষেত্রেও যেন তেমনটা না ঘটতে পারে সেজন্য আল্লাহর রসুল সদা সতর্ক থেকেছেন এবং যখনই দ্বীনের কোনো বিষয়ে কাউকে বাড়াবাড়ি করতে দেখেছেন তখন কঠোর ভাষায় সাবধান করে দিয়েছেন। তেমনি একটি ঘটনা ঘটে মদীনায়।
একদিন রসুলাল্লাহ এমনভাবে কেয়ামতের বর্ণনা দিলেন যে, জনগণের মন তাতে বিগলিত হয়ে গেল। তাঁদের চোখ থেকে অশ্রুর ধারা প্রবাহিত হলো। রসুলাল্লাহর দশজন বিশিষ্ট সাহাবী উসমান বিন মা’আজুনের ঘরে একত্রিত হলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন আবু বকরসহ (রা.) আলী বিন আবু তালেব (রা.), আব্দাল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.), আব্দাল্লাহ বিন উমর (রা.), আবুযর গেফারী (রা.), সালিম মওলা আবু হোযায়ফা (রা.), মেকদাদ বিন আসওয়াদ (রা.), সালমান ফারসী (রা.), মাকল বিন মাকরু (রা.) এবং গৃহকর্তা উসমান বিন মা’আজুন (রা.)। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের লক্ষ্যে সংসার-ধর্ম ত্যাগ করবেন। সাধু সন্নাসী ও সুফীদের মতো জিন্দেগী যাপন করবেন, ছিন্নবস্ত্র পরিধান করবেন। সর্বদা দিনের বেলা সওম রাখবেন। সারা রাত এবাদত বন্দেগী করবেন। বিছানায় ঘুমাবেন না। গোশত, চর্বি এবং পুষ্টিকর কোন খাদ্য গ্রহণ করবেন না। বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত এবং গুহার মধ্যে বসবাস করবেন।
তাঁদের এই সিদ্ধান্তের খবর রসুলাল্লাহর নিকট পৌঁছলে তিনি উসমান বিন মা’আজুনের (রা.) ঘরে এলেন। উসমান তখন ঘরে ছিলেন না। রসুলাল্লাহ উসমান বিন মা’আজুনের (রা.) স্ত্রী খাওলা বিনতে আবু উমাইয়াকে বিষয়ের সত্যতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। খাওলা নিজ থেকে কিছ্ইু বললেন না। ঘটনাটি চেপেও গেলেন না। জবাবে বললেন, রসুলাল্লাহর নিকট যখন সংবাদ পৌঁছেছে তখন তা কি করে মিথ্যা হতে পারে?
রসুলাল্লাহ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ফিরে গেলেন। খানিক বাদেই উসমান বিন মা’আজউন ঘরে ফিরে এলেন। তিনি শুনলেন আল্লাহর রসুল এসেছিলেন, তাঁর খোঁজ করেছেন। খবর শুনে উসমান আর দেরী করলেন না। তৎক্ষণাৎ সঙ্গীদের নিয়ে রসুলাল্লাহর দরবারে রওয়ানা হলেন। রসুল তাঁদেরকে বিষয়ের সত্যতা জিজ্ঞাসা করলে তারা বললেন, ইয়া রসুলাল্লাহ আমরা তেমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি শুধুই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে, অন্য কিছু নয়।
আল্লাহর রসুল বললেন, “তোমাদের উপর তোমাদের নফ্সের হক রয়েছে। নফল সওম রাখো এবং (কোন কোন সময়) তা থেকে বিরত থাকো। রাতের বেলা কখনো তাহাজ্জুদের সালাহ কায়েম করো এবং কখনো ঘুমাও। আমি তাহাজ্জুদের সালাহ কায়েম করি এবং ঘুমাইও। কোনো কোনো সময় সওম রাখি। আবার কোনো কোনো সময় সওম ত্যাগও করি। গোশত খাই, চর্বিও খেয়ে থাকি। স্ত্রীদের নিকটও যাই। যে আমার সুন্নাহÑতরিকা ত্যাগ করে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’’
রসুলাল্লাহর কাছে এই ধরনের সতর্কবাণী শুনে তারা সাবধান হয়ে গেলেন। কিন্তু আল্লাহর রসুল ক্ষান্ত হলেন না। কারণ তিনি জানেন, এই বৈরাগ্যবাদ মুসা (আ.) এবং ঈসা (আ.) এর উম্মাহদেরকে আসমানী দীনের পথ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়েছে। এর সাথে উম্মাহর জীবন-মরণ জড়িত। কাজেই ভবিষ্যতেও যাতে উম্মাহর মধ্যে এই বৈরাগ্যবাদী ধ্যান-ধারণা গজিয়ে উঠতে না পারে সে ব্যাপারে উম্মাহকে আরও বিষদভাবে সতর্ক করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করলেন তিনি। সাহাবায়ে কেরামদের মসজিদে সমবেত হওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলো। এরপর সমবেত লোকজনের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন, ‘‘লোকজনের কি হলো তারা নিজেদের জন্য স্ত্রীলোক, আহার্য্য, সুগন্ধি এবং দুনিয়ার পছন্দনীয় জিনিস নিষিদ্ধ করেছে? আমি তোমাদেরকে সংসারবিমুখ পাদ্রী এবং রাহিব-সন্ন্যাসী হওয়ার জন্য হুকুম করতে পারি না। আমার দীনের মধ্যে গোশ্ত (পুষ্টিকর খাদ্য) বর্জন, স্ত্রীলোক ত্যাগ এবং দরবেশ-সন্নাসীদের খান্কা ও আখ্ড়া গ্রহণ করার নিয়ম নেই। এবং সওম আমার উম্মতের এবাদত বন্দেগীর সফর আর জেহাদ হলো তাদের বৈরাগ্যবাদ-সংসার ত্যাগ। আল্লাহর এবাদত করো। তাঁর সাথে কাউকেও শরীক করো না। হজ্ব ও উমরাহ পালন করো, যাকাহ প্রদান করো এবং সিয়াম পালন করো। দীনের কাজে দৃঢ়পদ থাকো, আল্লাহ তোমাদেরকে সুদৃঢ় করে দিবেন। তোমাদের পূর্ববর্ত্তীগণ আধিক্য ও বাড়াবাড়ির জন্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। যখন তারা (দ্বীনের ব্যাপারে) বাড়াবাড়ি করল তখন আল্লাহও তাদের উপর কঠিন অবস্থা আরোপ করলেন। তাই এখন তারা রাহিবদের খান্কা ও আখ্ড়ায় বেঁচে আছে মাত্র (দ্বীন তাদের হাতে নেই)। আল্লাহর বাণী স্মরণ রেখো- ‘হে মো’মেনগণ! আল্লাহ তোমাদের জন্য যা হালাল করেছেন তা তোমরা হারাম কর না। সীমালঙ্ঘন করো না। এ ধরণের লোককে আল্লাহ পছন্দ করেন না। (সুরা মায়েদাহ ৮৭)’’
তথ্যসূত্র: ‘বিশ্বনবী মোহাম্মদ (সা.) এর ভাষণ’ গ্রন্থ।