ধর্মীয় অনুভূতিগুলো কীভাবে আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলকে প্রভাবিত করে সেটা যারা জঙ্গিবাদ ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন তাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা শিল্পসংস্কৃতি সমাজপরিবর্তনের হাতিয়ার আর এই হাতিয়ারটিকে ফতোয়া দিয়ে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। অধিকাংশ প্রগতিশীল ব্যক্তিই ধর্মের প্রতি এতটাই বীতশ্রদ্ধ যে পারলে ধর্মকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে ফেলেন। কিন্তু পারিবারিক, সামাজিক সংস্কৃতির কারণে তারা অনেকেই ধর্মকে দু একটি দিবসের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমিত আকারে চর্চা করেন। আমরা ইতিহাস নিরীক্ষন করলে দেখতে পাই ধর্ম ও সংস্কৃতি উভয়ই চিরকাল একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। বাঙালি সংস্কৃতির উজানে গেলে আমরা দেখব সেখানে হিন্দু ধর্মের বিপুল প্রভাব। তাহলে ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে এই বিরোধ কীভাবে সৃষ্টি হলো?
এর কারণ হলো প্রতিটি ধর্মেই অশস্নীলতাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শিল্প-সংস্কৃতির মাধ্যমে যখন অশস্নীলতার চর্চা প্রসার লাভ করেছে তখন স্বভাবতই ধর্ম সেই অশস্নীলতাকে পরিহার করার নির্দেশ দিয়েছে। কারণ অশস্নীলতার ফলে মানবসমাজে শান্তি বিনষ্ট হয়। ধর্মগুরুত্ব এই অশস্নীলতা রোধ করতে গিয়ে শিল্পচর্চাকেই হারাম বলে ফতোয়া প্রদান করে থাকেন। ব্যাপারটা যেন মাথাব্যথার চিকিৎসা করতে গিয়ে মাথাই কেটে ফেলা। বস্তুতঃ অশস্নীলতামুক্ত কোনো শিল্পচর্চা নিষিদ্ধ হওয়ার কোনো বিধান আলস্নাহ দেন নি। গান, নাচ, ভাস্কর্য নির্মাণ, ফটো তোলা, চিত্রাঙ্কন, অভিনয় ইত্যাদিকে আমরা শত শত বছর ধরে হারাম বলে জানি, মুসলিম পরিবারের যারা এসকল ক্ষেত্রে অবস্থান তৈরি করেছেন তাদেরকে বহু সামাজিক প্রতিবন্ধকতার মোকাবেলা করতে হয়েছে। যারা শিল্পচর্চা করেন তারা সারাজীবন একটি অপরাধবোধে ভোগেন যে তিনি গোনাহের কাজ করছেন। শেষ বয়সে তারা বহু অনুশোচনা করেন। প্রকৃত সত্য না জানার কারণে তারা তাদের মেধাকে পূর্ণরূপে বিকশিত করতে পারেন না।
আইয়্যামে জাহেলিয়াতের সময়ে নর্তকীরা গান করতেন, তারা দেহব্যবসাও করতেন। আল্লাহর রসুল সেই নোংরামীকে নিষিদ্ধ করেন, কিন্তু গান গাইতে বা নাচতে নিষেধ করেন নি। মদীনায় তার ঘরের মধ্যে মেয়েরা দফ বাজিয়ে গান গেয়েছে। আবু বকর (রা.) তাদেরকে নিষেধ করলেও রসলাল্লাহ বলেছেন, তাদেরকে গাইতে দাও। যুদ্ধ থেকে ফেরার পর কোনো নারী সাহাবী মানত পুরণের জন্য রসুল ও সাহাবীদের সামনে নাচ ও গান পরিবেশন করেছেন এমন ঘটনাও সহীহ হাদীসগ্রন্থে আছে।যারা প্রগতিশীল আন্দোলন করেন তারা জানেন যে কোনো দেশে রাজনৈতিক বিপলব ঘটাতে হলে আগে গান, নাটক, সাহিত্য ইত্যাদির মাধ্যমে সংস্কৃতিক বিপলব ঘটাতে হয়। চীনেও সেটা হয়েছে। আমাদের দেশেও মুক্তিযুদ্ধে চেতনা যুগিয়েছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। কাজেই শুদ্ধ সংস্কৃতি, যা মানুষকে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করে, মানবতার মুক্তির সংগ্রামে উজ্জীবিত করে, সত্যগ্রাহী করে তোলে তা কেবল বৈধই নয়, তা এবাদত। বাদ্যযন্ত্র হারাম হওয়ার কোনো কারণ নেই, সুর সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ। ইমাম গাজ্জালি (র.) বলেছেন, কোকিলের বা মানুষের কণ্ঠনিসৃত সুর বা তারযন্ত্রের দ্বারা সৃষ্ট সুর হারাম নয়।
যারা সংস্কৃতিবান মানুষ তাদের এ বিষয়ে কথা বলতে হবে। না বললে বারবার রমনা বটমূলে হামলা হবে, উদীচীর অনুষ্ঠানে হামলা হবে, ভাস্কর্য ভাঙ্গা হবে, আলাউদ্দিন আলী খাঁ’র সঙ্গীতালয় ভাঙ্গা হবে। ধর্মের নামে চলা অধর্মের দেয়ালকে ভাঙ্গার এই সংগ্রামে আমরা হেযবুত তওহীদ সকল প্রগতিবাদী মানুষকে পাশে চাই।