রিয়াদুল হাসান:
প্রতিটি জনগোষ্ঠীরই অবিচ্ছেদ্য অংশ এর সংস্কৃতি। সুস্থ সমাজ বিনির্মাণে এবং দেশ, সমাজ ও জাতি গঠনে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ভূমিকা অপরিসীম। সংস্কৃতির মধ্য দিয়েই একটি জাতির প্রকৃত চরিত্র প্রতিফলিত হয়। সমাজ থেকে অন্যায় অবিচার ও বৈষম্য দূরীকরণে একটি দেশের সংস্কৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। প্রতিটি জাতিরই নিজ নিজ সংস্কৃতি রয়েছে। তাই আমারা পৃথিবী জুড়ে নানান রকম সংস্কৃতি, আচার-অনুষ্ঠান দেখতে পাই। প্রত্যেক জাতিই তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির মর্যাদা যেন অটুট থাকে সে সম্পর্কে থাকে সচেতন। প্রত্যেক ধর্মের সাথেও সংস্কৃতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কিন্তু আজ এক শ্রেণীর ধর্ম ব্যবসায়ীদের মিথ্যে ফতোয়ার কারণে সাংস্কৃতিক অঙ্গন, ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। অথচ সুর, সঙ্গীতের স্রষ্টা মহান আল্লাহ এবং কোনো ধর্মেই সুস্থ সংস্কৃতি, বাক স্বাধীনতা, সৃজনশীলতা, মেধা বিকাশে সহায়ক এমন কোন কাজ নিষিদ্ধ নয়।
মানবজাতি সৃষ্টির পর জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষ পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বিভিন্ন স্থানে আবহাওয়া ও জলবায়ুর তারতম্য, পরিবেশের বিভিন্নতার কারণে মানুষের শারীরিক ও মানসিক গঠনে পরিবর্তন সৃষ্টি হয়। এক স্থানের মানুষের ভাষা, ভাবের আদান প্রদান, আচার-আচরণ, প্রথা, রীতি-নীতি ইত্যাদির সাথে অন্য স্থানের মানুষের বিরাট পার্থক্য তৈরি হয়। ফলে স্থানভেদে সৃষ্টি হয় ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি। আজ আমরা পৃথিবীর বুকে তাকালে হাজারো ভিন্ন রকম সংস্কৃতি, প্রথা, আচার অনুষ্ঠান দেখতে পাই। প্রতিটি জাতিই তাদের স্বকীয় সংস্কৃতি ধারণ করে। পৃথিবীতে যতগুলো দেশ রয়েছে তাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি। আবার একটি দেশের মাঝেও বিভিন্ন স্থানে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি।
উদাহরণ হিসেবে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক। জাতিগতভাবে আমাদের কিছু সংস্কৃতি, আচার অনুষ্ঠান রয়েছে যা সকল বাঙালিই পালন করে থাকেন। যেমন: বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, মাতৃভাষা দিবস, পহেলা বৈশাখ ইত্যাদি। আবার আমাদের দেশে রয়েছে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ। তাদের প্রত্যেক ধর্মেরই রয়েছে নিজস্ব কিছু সংস্কৃতি, আচার অনুষ্ঠান। এগুলোর মধ্যে প্রধান প্রধান উৎসব হল মুসলিমদের ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা, ঈদ এ মিলাদুন্নবী; হিন্দুদের দুর্গাপূজা, কালীপূজা, স্বরস্বতী পূজা, জন্মাষ্টমী, ভাইফোঁটা; বৌদ্ধদের বুদ্ধ পূর্ণিমা, প্রবারণা পূর্ণিমা, মাঘী পূর্ণিমা, ফাল্গুনী পূর্ণিমা; খ্রিষ্টানদের বড়দিন। এগুলো ছাড়াও আরো অসংখ্য ছোট-বড় উৎসব অনুষ্ঠান রয়েছে। তাছাড়া আমাদের দেশে বিভিন্ন আদিবাসী ও উপজাতি রয়েছে। তাদেরও প্রত্যেকের রয়েছে নিজস্ব আচার অনুষ্ঠান। এগুলোর মধ্যে রাখাইনদের সাং গ্রে পোয়ে বা নববর্ষ উৎসব, বর্ষা উৎসব; মারমাদের ওয়াছো পোয়ে, ওয়াগ্যোয়াই পোয়ে; গারোদের ওয়ানগালা; চাকমাদের বিজু উৎসব; মণিপুরীদের বিষু এবং চৈরাউবা উৎসব; মুরংদের চিয়া চট পণ্ডাই বা গো হত্যা উৎসব ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এমনকি অঞ্চলভেদেও কিছু কিছু আচার অনুষ্ঠান পালিত হয় যা আরেক অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতি থেকে আলাদা।
আমাদের ছোট্ট একটি দেশেই সংস্কৃতির কি বিশাল বৈচিত্র্য! তাহলে এটা সহজেই অনুমেয় যে সমস্ত পৃথিবী জুড়ে কত রকমের সংস্কৃতি, আচার অনুষ্ঠান রয়েছে। আর এই সংস্কৃতি থেকে জাতিকে আলাদা করা সম্ভব নয়। প্রাকৃতিকভাবেই সৃষ্ট এই সকল সংস্কৃতি মানবজাতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু এক শ্রেণীর ধর্মব্যবসায়ীদের ফতোয়ার কারণে সাধারণ মানুষের মাঝে এক বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে যে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এসব সংস্কৃতি কতটা বৈধ।
প্রকৃতপক্ষে কোন ধর্মই সত্য ও সুন্দর, মানুষের সুকোমল বৃত্তি, প্রতিভা, সুর, সঙ্গীত, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, নাটক ইত্যাদিকে অবৈধ বলে না। অবৈধ হচ্ছে অসত্য, অশ্লীলতা এবং স্রষ্টার অবাধ্যতা। কোন ধর্মই এসবকে নাজায়েজ করতে পারে না। কেননা স্বয়ং স্রষ্টাই সুর ও নৃত্য সৃষ্টি করেছেন। শেষ প্রেরিত গ্রন্থ আল কোর’আনকে আল্লাহ পাঠিয়েছেন ছন্দবদ্ধ করে। কেবল কোর’আন নয়, যবুর, গীতা, পুরান ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থও কাব্যময়। গীতা শব্দের অর্থই তো গান। নৃত্য হচ্ছে শৃঙ্খলার অনুপম নিদর্শন। পাখি আকাশে ওড়ে- তাদের মধ্যে বিরাজ করে শৃঙ্খলা। পাখির দল যে দিকে ওড়ে এক সাথেই ওড়ে, দলপতির অনুসরণ করে সামনে যায়, ডানে বায়ে ঘুরে ঘুরে উপরে উঠে, নিচে নামে- সব করে একতালে। পাখির কণ্ঠে তিনিই সুর ও সঙ্গীত দান করেছেন। সাগরের ঢেউয়েও আছে অপরূপ নৃত্য। সবুজ মাঠে ধানের শীষ যখন আন্দোলিত হয়- তাতেও দেখা যায় এক অপরূপ নৃত্যের নিদর্শন। আযান ইসলামের এক অনন্য সঙ্গীত। সুতরাং যিনি সুরকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি সেই সুরকে নাজায়েজ করতে পারেন না।
কিন্তু আজ পাশ্চাত্য ‘সভ্যতা’ দাজ্জালের অনুসারী আত্মাহীন, নৈতিকতাহীন একদল মানুষ তারই সৃষ্টি মানুষ সুর সঙ্গীত ও নৃত্যকলাকে কলুষিত করছে। নাচ, গান, বাদ্যযন্ত্র, ছবি আঁকা, ভাস্কর্য নির্মাণ ইত্যাদি সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ড ও শিল্পকলা আল্লাহ কোথাও নিষেধ করেননি। সুতরাং মানুষ যত খুশি গান গাইতে পারে, ছবি আঁকতে পারে, ভাস্কর্য নির্মাণ করতে পারে, কেউ বিকৃত ফতোয়ার চোখ রাঙানিতে তার সৃষ্টিশীলতার পথ রুদ্ধ করতে পারে না।
আমাদের শেষ রসুল (দ.) একটি আধুনিক সভ্যতার ভিত রচনা করেছিলেন। ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি সেই নতুন সভ্যতা অর্ধ দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। যে সভ্যতা একজন অসৎ মানুষকে সোনার মানুষে পরিণত করত। সেই প্রকৃত ইসলামের সময় এই সমস্ত ফতোয়াবাজি ছিল না। একটি সরল সত্য হোল, ইসলামের বৈধ-অবৈধ নির্দ্ধারণের বেলায় মানদণ্ড হচ্ছে আল্লাহর আদেশ এবং নিষেধ অর্থাৎ আল-কোর’আন যেটি স্রষ্টা প্রেরিত সর্বশেষ গ্রন্থ। রসুলাল্লাহ জানতেন যে, তাঁর বাণীকে ভবিষ্যতে বিকৃত করা হবে, অনেক বৈধ বিষয়কে অবৈধ ঘোষণার জন্য সেটিকে তাঁর উক্তি বলে চালিয়ে দেওয়া হবে, তাই তিনি বলে গেছেন, আমি তোমাদের জন্য সেটাই হালাল করেছি যেটা আল্লাহ হালাল করেছেন, সেটাই হারাম করেছি যেটা আল্লাহ হারাম করেছেন। তিনি আরও বলেন, আমার কোন কথা কোর’আনের বিধানকে রদ করবে না, তবে কোর’আনের বিধান আমার কথাকে রদ করবে (হাদীস)।
সুতরাং যে কোন জিনিস হারাম কিনা তা জানার জন্য আমাদেরকে আল্লাহর কেতাব দেখতে হবে। কোর’আনে যা কিছু নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেগুলি ছাড়া আর সবই বৈধ। এখন কোর’আন খুলে দেখুন গান, বাদ্যযন্ত্র, কবিতা, চলচ্চিত্র, নাট্যকলা, অভিনয়, নৃত্য, চিত্রাঙ্কন, ভাষ্কর্য নির্মাণ ইত্যাদি আল্লাহ হারাম করেছেন কিনা? যদি না করে থাকেন তাহোলে এগুলি নিয়ে বাড়াবাড়ি করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। আল্লাহ যেটিকে বৈধ করেছেন, সেটিকে কোন আলেম, মুফতি, ফকীহ, মুফাসসির হারাম করার অধিকার রাখেন না।
ভাবতেও অবাক লাগে, প্রকৃত ইসলামের যুগে যে মুসলিমরা দুর্দান্ত গতিতে অর্ধ পৃথিবী জয় করে সেখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করল; ধনে, জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে, শিক্ষায়, সামরিক শক্তিতে সকল ক্ষেত্রে সবার ঊর্ধ্বে আরোহণ করল; সেই জাতি আজ সকল জাতির গোলামে পরিণত হয়ে অন্য জাতিগুলির দ্বারা অপমানিত, লাঞ্ছিত হচ্ছে। এই অপমান, লাঞ্ছনা থেকে পরিত্রাণের উপায় না খুঁজে তারা আজ অতি তুচ্ছ বিষয়গুলি নিয়ে জায়েজ, না’জায়েজের ফতোয়াবাজীতে ব্যস্ত; কূপমণ্ডুকতার গহ্বরে বসে প্রশ্ন করে, টিভি দেখা, ছবি তোলা, গান-বাজনা করা জায়েজ না না’জায়েজ। কী পরিহাস!
আমরা অতীতের দিকে তাকালে দেখতে পাই রসুলের আনীত ইসলাম অর্ধদুনিয়ায় কায়েমের ফলে পরবর্তী মুসলিম জাতিটি সর্বদিক দিয়ে পৃথিবীর শি¶কের আসনে আসীন হন। কি সঙ্গীত, কি কাব্য, কি নতুন নতুন সুর রচনায়- কোথায় নেই তারা। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সুন্দর সুন্দর কবিতা, গান লিখে গেছেন। সেসব আজও সমাদৃত। যারা সঙ্গীতকে নাজায়েজ মনে করেন তারাও ওয়াজের মধ্যে কবি সাহিত্যিকদের সুর ছন্দ নির্দ্বীধায় ব্যবহার করেন। কিন্তু কালের পরিক্রমায় আজকে সঙ্গীত বৈধ কি অবৈধ, নৃত্য বৈধ কি অবৈধ তার প্রশ্ন উঠছে।
এর কারণ হচ্ছে সভ্য জাতি গঠনে এগুলো আজ কোন কোন ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নৈতিক পদস্খলনের হাতিয়ারে এসব পরিণত হচ্ছে। কাব্যের নামে, নৃত্যের নামে আজ অশ্লীলতা, বেহায়াপনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কথা সবাই স্বীকার করবেন যে- যে কোন কিছুর সাথেই হোক অশ্লীলতা, বেহায়াপনা- যা মানুষের ¶তি করে তাকে কোন ধর্মই বৈধতা দিতে পারে না। অশ্লীলতার প্রসারে সমাজে কিভাবে অপরাধ বৃদ্ধি পায় তা প্রত্য¶ করে ইউরোপ আমেরিকার অনেক দেশেও অশ্লীলতা-বিরোধী উদ্যোগ নিচ্ছে, আইন-পাশ করছে। আশা করি কোন সুস্থ মানুষই গণমাধ্যম তথা চলচ্চিত্র, সঙ্গীত, সাহিত্যের এই নেতিবাচক দিকটিকে অস্বীকার করতে পারবেন না। তাই বলে কাব্যকে, সঙ্গীতকে, নৃত্যকে, সাহিত্যকেই একচেটিয়াভাবে নিষিদ্ধ করে রাখা ধর্মান্ধতা ও কূপমণ্ডুকতার সামিল। মাথায় ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলা কোন সমাধান নয়, বরং সঠিক চিকিৎসা করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
আমাদের মনে রাখতে হবে একই সুরে, একই কবিতায় আমরা সৃষ্টি ও স্রষ্টার মহিমা প্রচার করতে পারি, সমাজে এর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে পারি- আবার সেই সুর দিয়ে, সেই কথা দিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যও করতে পারি। ভাল কি মন্দ তা নির্ভর করে এর ফল ব্যবহার এবং ফল কী দাঁড়াচ্ছে এর উপর। একটি বন্দুক দিয়ে আপনি ডাকাতকে প্রতিরোধ করতে পারেন আবার সেই বন্দুক দিয়ে নিরীহ মানুষকে খুনও করতে পারেন। বন্দুক এখানে শুধু একটা মাধ্যম। এটি দিয়ে কি করা হচ্ছে- ভালো করা হচ্ছে না কি মন্দ করা হচ্ছে তা-ই বিবেচ্য বিষয়। তেমনি সঙ্গীতে আপনি সুন্দর সমাজ গঠনের কথা বলবেন, ভালো কাজকে উৎসাহ দিবেন- নাকি বেহায়াপনা করবেন, না কি অশ্লীলতার বিস্তার ঘটাবেন সেটাই বিচার্য। সাহিত্যের মাধ্যমে আপনি সমাজ সংস্কার করবেন নাকি, মানুষকে অরাজকতা করতে উষ্কে দিবেন, মানুষকে স্রষ্টামুখী করবেন, নাকি মানুষকে স্রষ্টাবিমুখ করবেন- এটা আপনার ব্যাপার। কিন্তু সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, মানুষ হিসেবে আমাদের সকলের উচিত চলচ্চিত্র, নাটক, গান, সাহিত্যের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য ও সুন্দরকে তুলে ধরা।